Skip to content

২২শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দ | শুক্রবার | ৭ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

কুমুদিনী হাজং: বিদায় টঙ্ক আন্দোলনের মহান নেত্রী

শারমিন রহমান

কুমুদিনী হাজং আনুমানিক ১৯৩০ সালে নেত্রকোনা, বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি বিট্রিশ ভারতে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি টঙ্ক আন্দোলনের অন্যতম নেত্রী ছিলেন। তৎকালীন ময়মনসিংহের দূর্গাপুরের বহেরাতলী গ্রামে কৃষিজীবী হাজং পরিবারে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম অতিথ চন্দ্র রায় এবং মাতা জনুমণি হাজং। তিনি টঙ্ক আন্দোলনের অন্যতম নেতা লংকেশ্বর হাজংয়ের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন।

১৯৩০-এর দশকে শুরু হওয়া টঙ্ক আন্দোলনে হাজং সম্প্রদায় সম্পৃক্ত হয়ে পড়েছিল। তারপর ১৯৪৬ সালে ব্রিটিশ পুলিশ টঙ্ক আন্দোলনের নেতা লংকেশ্বর হাজংকে খুঁজে না পেয়ে কুমুদিনী হাজংকে গ্রেপ্তার করে। যাওয়ার পথে রাসিমণি হাজংয়ের দলের সঙ্গে বিবাদে জড়িয়ে পড়ে। বিবাদ ছড়িয়ে পড়লে পুলিশ কুমুদিনী হাজংকে গ্রেপ্তার না করেই প্রস্থান করে। পরবর্তী সময়ে স্বামীর সঙ্গে কুমুদিনীও আন্দোলনে যোগ দেন। ওই সময় বৃহত্তর ময়মনসিংহ তথা নেত্রকোণা, ময়মনসিংহ এবং শেরপুর জেলার বিভিন্ন স্থানে টঙ্ক প্রথা চলে আসছিল।

যা সাধারণ কৃষকদের রক্ত চোষার সামিল! মূলত টঙ্ক বলতে খাজনা বোঝানো হতো। কৃষকদের উৎপাদিত শস্যের ওপর খাজনা দিতে হতো। কিন্তু এর পরিমাণ এত বেশি ছিল যে, প্রচলিত খাজনার কয়েক গুণেরও বেশি। যা দরিদ্র কৃষকদের পক্ষে কোনোভাবেই দিয়ে ওঠা সম্ভব ছিল না। তবু ব্রিটিশ সরকার সাধারণ কৃষকদের ওপর চড়াও হতে থাকে ক্রমাগত৷ একসময় এর বিরুদ্ধে কৃষকরা আন্দোলন শুরু করেন।

শোষিত কৃষকেরা এই প্রথার বিরুদ্ধে কমরেড মণি সিংহের নেতৃত্বেই একত্রিত হযস। ১৯৩৭ সালের নভেম্বর মাসে একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এখান থেকেই মূলত আন্দোলনের শুরু। এরপর কমরেড মণি সিংহ ছয় দফা দাবি প্রস্তুত করেন। ছয় দফার মধ্যে অন্যতম ছিল: টঙ্ক প্রথার সম্পূর্ণ বিলুপ্তি, টঙ্ক কৃষকদের ভূমির অধিকারের স্বীকৃতি, পরগনায় নগদ টাকায় দেয় হারের নিরিখে খাজনা নির্ধারণ, টঙ্ক খাজনার বকেয়া দাবি না করা, জমিদারি প্রথার বিলুপ্তি এবং সাম্রাজ্যবাদের উচ্ছেদ।

মণি সিংহ, রশিমনি হাজং, কুমুদিনী হাজং, যাদুমনি হাজং, লতিকা এন মারাক, সুরেন্দ্র হাজং, ভদ্রমনি হাজং, মংগল হাজংরা টঙ্ক আন্দোলনের প্রধান বিপ্লবী ছিলেন। তাদের অদম্য সাহস ও দৃঢ় প্রত্যয়ে একসময় টঙ্ক প্রথা বিলোপ হয়।

১৯৫০ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমীন সুসং দুর্গাপুর এলাকায় পরিদর্শন করেন ভয়াবহ পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য। কিন্তু টঙ্ক প্রথা না তুলে নেওয়ায় এই আন্দোলন চলতে থাকে। অবশেষে পূর্ববঙ্গ জমিদারি অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইন ১৯৫০ পাস হলে এই নির্মম প্রথা বিলোপ সাধিত হয়।

এই আন্দোলনকে সফল করতে বহু নেতা প্রাণ বিসর্জন দিতেও পিছপা হননি। সর্বশেষ কৃষকেরা তাদের অধিকার ছিনিয়ে নিতে সক্ষম হন। টঙ্ক আন্দোলনে নারীদের ভূমিকা ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। অনেক নারী আন্দোলনকর্মী পরবর্তীকালে রাজনীতি এবং অন্য জাতীয় আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করেন।

পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে, ২০০০ সালে কুমুদিনীর স্বামী লংকেশ্বর হাজং মারা যান। তাদের পাঁচ সন্তানের মধ্যে বড় ছেলে লমিন হাজং আগেই মারা গেছেন। মেজ ছেলে অর্জুন হাজং নিজ গ্রামে। ছোট ছেলে সহদেব হাজং মুক্তিযুদ্ধের পর ভারতে চলে যান। বড় মেয়ে মেনজুলি হাজং মানিকগঞ্জে ও ছোট মেয়ে অঞ্জুলী হাজং থাকেন ঢাকায়।

সমাজসেবায় অবদানের জন্য ২০১৯ সালে কুমুদিনী হাজংকে সম্মানসূচক ফেলোশিপ দেয় বাংলা একাডেমি। এ ছাড়া তাকে অনন্যা শীর্ষদশ (২০০৩), আহমদ শরীফ স্মারক (২০০৫), কমরেড মণি সিংহ স্মৃতি পদক (২০০৭), সিধু-কানহু-ফুলমণি পদক (২০১০), জলসিঁড়ি (২০১৪) ও হাজং জাতীয় পুরস্কার (২০১৮) প্রদান করা হয়। এছাড়া ২০২১ সালে নেত্রকোনা জেলা প্রশাসক সম্মাননা, ২০২২ সালে পথ পাঠাগার সম্মাননা পেয়েছেন তিনি।

টঙ্ক আন্দোলনের অন্যান্য নেতাদের মতো কুমুদিনী হাজং একজন কিংবদন্তী নারী নেত্রী। সমাজে তার অবদানের কথা ভোলার নয়। এই বিদ্রোহী নারী ২৩ মার্চ ২০২৪ তারিখে বেলা ১টা ৪০ মিনিটে নিজ বাড়িতে মারা যান। তার বয়স হয়েছিল ১০২ বছর। তার প্রবল মনোবল ও অদম্য শক্তি ইতিহাসের পাতায় তাঁকে আজীবন অম্লান রাখবে।

কুমুদিনী হাজং শুধু টঙ্ক আন্দোলনের নেত্রীই নন, তিনি সাধারণ নারীদের কাছে একজন আদর্শ, প্রেরণার অংশ। নেত্রকোনার দুর্গাপুর উপজেলার সীমান্তবর্তী কুল্লাগড়া ইউনিয়নের বহেড়াতলী গ্রামে পাহাড়ী অঞ্চলের এক টিলায় বসবাস করতেন তিনি। হাজং বিদ্রোহের সাক্ষী কুমুদিনী হাজং দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধ, টঙ্ক আন্দোলন, ১৯৫২ এর ভাষা আন্দোলন, পাকিস্তানি জুলুম বৈষম্য, নিপীড়ন, ১৯৬৪ এর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, মহান স্বাধীনতা আন্দোলনসহ বিভিন্ন আন্দোলনের কালের সাক্ষী ছিলেন। রবিবার (২৪ মার্চ) সকালে স্থানীয় শশ্মানঘাটে তার শেষ ক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে। এই মহতী নারীর প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা।

ডাউনলোড করুন অনন্যা অ্যাপ