গণপরিবহন, নারীর জন্য এক আতঙ্কের নাম!
কয়েকযুগ পেছনে যদি তাকাই, তখন নারীদের চার দেয়ালের মধ্যে থেকে হরহামেশা বের হওয়ার ক্ষমতা খুব একটা ছিলোনা। বর্তমানে সমাজ অনেকটা এগিয়েছে। নারীরাও ইচ্ছেমত সকল ক্ষেত্রে নিজের প্রতিভা বিকশিত করার সুযোগ পাচ্ছেন। সকল ক্ষেত্রেই বেড়েছে নারীর অংশগ্রহণ আর সেই সাথে যেন পাল্লা দিয়ে বেড়েছে হয়রানি। আজকাল নারীদের জন্য আতঙ্কের নাম হয়ে দাঁড়িয়েছে গণপরিবহন।
কিছুদিন আগে চলার পথে নারীরা তিরস্কারমূলক যেসব শব্দ শুনতে পায়, তা নিয়ে কয়েকজনের সাথে কথা বলছিলাম। তার মধ্যে একজন রাজধানীর একটি বেসরকারি ব্যাংকে কর্মরত সাথী আক্তার। পরিবার থেকে শুরু করে কর্মক্ষেত্র বিভিন্ন জায়গায় হয়রানির শিকার হলেও প্রথমেই তুলে ধরেছিলেন গণপরিবহনে হয়রানির প্রসঙ্গ।
তিনি বলেন," যখন অফিস যাওয়ার জন্য বাসে উঠি ঐ সময়টাতে তো ছোটোখাটো একটা যুদ্ধ জয় করতে হয়। আমাদের ঢাকা শহরের বাসের পরিস্থিতি কি তা আমরা মোটামুটি সবাই জানি। যখন বাসে উঠবো, তখন প্রায়শই ধাক্কার সাথে সাথে বেশ কিছু অসংবেদনশীল শব্দ কানে ভেসে আসে। এটা রোজই ঘটে। প্রতিবাদ করলেও তিরস্কার সহ্য করতে হয়৷ তাই এখন এ বিষয়টিকে ডেইলি রুটিনের মধ্যেই নিয়ে নিয়েছি"
সাথী আক্তারের মতো এমন আরো কয়েকজন নারীদের সাথে কথা বলেছি আমরা। বিভিন্ন শ্রেণী-পেশা এবং বিভিন্ন বয়সের সেই নারীদের মধ্যে এমন কেউই ছিলেননা যিনি গণপরিবহনে হয়রানির শিকার হননি। বরং বেশিরভাগ নারীই মনে করতে পারেননি শেষ কবে তিনি হয়রানির শিকার হননি। পরিবহনে ওঠা থেকে নামা পর্যন্ত প্রতি মুহূর্তে আতঙ্কিত থাকতে হয় নারীদের।
প্রয়োজনের খাতিরে বাইরে বের হওয়া এসব নারীদের বাস ধরতেই যেন এক বিশাল যুদ্ধ জয় করতে হয়। প্রথমত, পুরুষ যাত্রীদের আধিক্য ও হুড়োহুড়ি। দ্বিতীয়ত, হেলপার ও ড্রাইভারের নারী যাত্রী তোলা নিয়ে অনীহা। এসব কিছু ঠেলে একজন নারী যখন বাসে উঠতে সক্ষম হন তখনও পাশের থেকে ভেসে আসে কোনো হয়রানিমূলক শব্দ আর সাথে অনাকাঙ্ক্ষিত কিছু স্পর্শ।
শুধু যে বাসের যাত্রীদের কাছ থেকেই নারীরা হয়রানির শিকার হচ্ছেন তা নয়। পরিবহন-শ্রমিক, চালক, হেলপার এর থেকেও হয়রানির শিকার হন নারীরা। বাসে ওঠার সময় হেলপারের অশোভন আচরণ প্রায়শই সহ্য করতে হয় নারীদের। এ বিষয়ে অভিজ্ঞতার কথা বলে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী ফারহানা সুলতানা মুনা।
তিনি বলেন, " বাসে যখন উঠবো ঠিক তখনি হেল্পার এসে আমাকে সাহায্য করার ভান ধরে গায়ে হাত দিয়ে বসে। এই সমস্যা একদম ৯৯% হেলপারই করে। প্রতিবাদ করতে গেলেও তারা এমনভাবে ব্যবহার করে প্রায়সময়ই নিজেকেই আরো অপমানিত হতে হয়।"
গণপরিবহনে নারীদের সংরক্ষিত আসন থাকলেও নারীদের অভিযোগ বেশিরভাগ সময়ই ঐ সংরক্ষিত আসনগুলোও দখল করে থাকেন পুরুষ যাত্রীরা। এ প্রসঙ্গে এই বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী বলেন, " কখনো মহিলাদের সংরক্ষিত জায়গায় বসে আছে এমন কোনো পুরুষকে যদি বলি এখানে কেন বসেছেন বা তাকে ওঠার জন্য বলি তখন মাঝেমধ্যেই অনেক কটূক্তি শুনতে হয়। এমনও হয়েছে তারা হেসে হেসে বলছেন, সমান অধিকার তো দাঁড়িয়ে থাকতে পারবেন না কেন?"
নারী যেমন কখনো শিকার হচ্ছে মৌখিক হয়রানির আবার কখনো শারীরিক হয়রানির। যৌন হয়রানি, ধর্ষণ এবং ধর্ষণের পর হত্যার মতো ঘটনাগুলো ঘটে চলছে অহরহ। ২০২০ এর ফেব্রুয়ারিতে ব্র্যাকের প্রকাশিত ‘নারীর জন্য যৌন হয়রানি ও দুর্ঘটনামুক্ত সড়ক’ শীর্ষক এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশের গণপরিবহনে যাতায়াতের সময় ৯৪ শতাংশ নারী মৌখিক, শারীরিক বা অন্য কোনোভাবে যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছেন। ৪১ থেকে ৬০ বছর বয়সী পুরুষদের দ্বারাই যৌন হয়রানির শিকার হন বেশিরভাগ নারী, যার হার ৬৬ শতাংশ।
বছরজুড়ে বিভিন্ন সময়ই আলোচনায় আসে গণপরিবহনে ধর্ষণের ঘটনা।গণপরিবহনে নারীর সংরক্ষিত আসন যেমন রয়েছে, তেমনি ঐ গণপরিবহনই যেন ধর্ষকদের পীঠস্থান হয়ে উঠেছে৷ ২০২১ সালের মে মাসের শেষের দিকে আশুলিয়া সিএন্ডবি বাইপাস সড়কে একটি বাসে গণধর্ষণের শিকার হয় এক তরুণী। তিনি 'নিউ গ্রাম বাংলা পরিবহন' নামে একটি বাসে উঠেন টঙ্গী যাওয়ার উদ্দেশ্যে। পথে আশুলিয়া গরুর হাট এলাকার আগেই ওই বাসের অন্য যাত্রীদের নামিয়ে বাস আবার নবীনগরের দিকে নিয়ে যায় চালক। এরপর বাস চলন্ত অবস্থায় বাসের দরজা জানালা বন্ধ করে তাকে ধর্ষণ করে চালক ও হেলপারসহ অন্যান্যরা।
গত ১৯ ডিসেম্বর রাতে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে উপজেলার মদনপুর বাসস্ট্যান্ডের কাছে উচ্চ স্বরে গান বাজিয়ে চলন্ত বাসে এক গৃহবধূকে গণধর্ষণের অভিযোগ ওঠে। এর আগে ২০২১ সালের ২১ নভেম্বর রাজধানীর একটি বাসে অর্ধেক (হাফ) ভাড়া দেওয়ায় প্রকাশ্যে এক শিক্ষার্থীকে ধর্ষণের হুমকি দেওয়ার অভিযোগ ওঠে।
গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যের ভিত্তিতে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি জানায়, ২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত ১১ মাসে গণপরিবহনে ৬৮টি নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে ২৩টি ধর্ষণ, ১১টি দলবদ্ধ ধর্ষণ এবং ৩৪টি যৌন হয়রানির ঘটনা ঘটেছে।
বলাই বাহুল্য এসব তথ্যের মধ্যে বড় একটি অংশই উঠে আসেনি। পরিস্থিতির শিকার নারীরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মুখ বুজে সহ্য করে নেন এসব হয়রানি। গেলো কয়েকবছর ধরে সড়ক দুর্ঘটনা যেমন বেড়েছে তেমন বেড়েই চলছে নারীর প্রতি হয়রানি। তবে নিরাপদ সড়ক নিয়ে প্রতিবাদ কিংবা আন্দোলন যতটা গুরুত্ব পাচ্ছে। গণপরিবহনে নারীর প্রতি ঘটে যাওয়া এসব অপ্রীতিকর ঘটনাগুলো এতোটা গুরুত্ব পাচ্ছে না। তাই দিনের পর দিন নারীদের জন্য যেন এক আতঙ্কের নাম হয়ে দাঁড়িয়েছে গণপরিবহন।