হিন্দু বর্ণবাদের অভিশাপ মোচনে জনহিতকর কর্মে রাজচন্দ্র-রাসমণি
এগারো বছরের রাসমণি একুশ বছরের রাজচন্দ্রের সংসারে এসে স্বীয় বুদ্ধিমত্তায়-বিচক্ষণতায় দ্রুতই সকলের মন জয় করে ফেলেন। ক্রমেই হয়ে ওঠেন সকলের রানিমা। অর্থ, বিত্ত-বৈভবে ঠাসা প্রীতিরাম নিম্নবর্ণের নমঃশূদ্র বিধায় কলকাতার উচ্চবর্ণের অভিজাতদের কাছে ব্রাত্যজন। উচ্চবর্ণের দাপটে ম্রিয়মাণ। সাহেবদের পাড়ায়ও বাড়ি কিনতে শুরু করেন। দক্ষিণ কলকাতার সেরা জমিগুলো ক্রয়ের পর রাজচন্দ্র কলকাতার সবচেয়ে অধিক জমির মালিক হন। হন কলকাতার প্রধান জমিদার।
১৮০৪ সালে রাজচন্দ্রের বিয়ের দু’বছর পর জন্ম হয় কন্যা পদ্মমণির। ১৮১১-তে দ্বিতীয় কন্যা কুমারী, ১৮১৬ সালে তৃতীয় কন্যা করুণাময়ী, ১৮২৩ সালেধ চতুর্থ কন্যা জগদম্বার জন্ম। এক পুত্র জন্মের পরই মারা যায়। তাই পুত্রভাগ্য ছিল না। চারকন্যার পিতা হিসেবেই অগত্যা সন্তুষ্ট থাকলেন। ১৮১৭ সালে রাজচন্দ্রের পিতা প্রীতিরামের মৃত্যু হয়। ওই বছরই মারা যান তার মা’ও। ১৮১৩ সালে ছয় বিঘা জমির ওপর প্রীতিরামের শুরু করা প্রাসাদের নির্মাণ কাজ সম্পন্ন করলেন রাজচন্দ্র। তিনশ’ কক্ষের এ-প্রাসাদে ছয়টি উঠোন, একটি সরোবর। সাতটি মহল, ঠাকুরদালান, নাটমন্দির, দেওয়ানখানা, কাছারিঘর, অতিথিশালা, গোশালা, অস্ত্রশালা, প্রহরী-দেওয়ানদের কক্ষ। পঁচিশ লক্ষ টাকা ব্যয়ে নির্মিত হলো জানবাজারের প্রাসাদের লাগোয়া এই প্রাসাদটি।
এত ব্যাপক অর্থ-বিত্তের মালিক হবার পরও নিম্নবর্গের নমঃশূদ্র বিধায় রাজচন্দ্রের সামাজিক মর্যাদা লাভ সম্ভব হয়নি। পায়নি স্বীকৃতি এবং সামাজিক প্রতিষ্ঠা। সমস্তই দখল করে নিয়েছিল উচ্চবর্ণের ঠাকুর, দত্ত, দেব, সিংহ, মল্লিক, আঢ্য, শেঠরা। নিম্নবর্ণের অনুপ্রবেশ ঘটাতে হবে ওই বনেদি উচ্চবর্ণদের পাশে। স্ত্রী রাসমণির পরামর্শে মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় তাদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে গঙ্গার এপারে ঘাট তৈরিতে নেমে পড়েন। কোম্পানির অনুমতি সংগ্রহ করে প্রথমে নদীর পাড় তৈরি করলেন। নির্মাণ করলেন ছত্রিশটি স্তম্ভ বিশিষ্ট ঘাট। স্তম্ভের উপর জুড়ে আচ্ছাদন। স্নানের জন্য নারী-পুরুষের পৃথক ব্যবস্থা। লর্ড বেন্টিঙ্ক-এর ঘোষণাপত্রে নাম দেওয়া হলো ‘বাবু রাজচন্দ্র দাসের ঘাট’। লোকমুখে আজও সেটি ‘বাবুঘাট’ নামে প্রচলিত।
রাজচন্দ্রের জনহিতকর এসকল সংবাদ দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। সংবাদপত্রে ছাপা হয় রাজচন্দ্রের কীর্তি। ইন্ডিয়া গেজেটে নথিভুক্ত হয় রাজচন্দ্রের জনকল্যাণমূলক রাজকার্য।
কলকাতার জ্ঞানী-গুণীজনদের কাছে নিজের অবস্থান তুলে ধরতে ব্যাপক জনহিতকর কাজে হাত দিলেন রাজচন্দ্র। বিদ্যোৎসাহী মহলে নিজেকে যুক্ত করতে কলকাতার হিন্দু কলেজ প্রতিষ্ঠায় রাজচন্দ্র অকাতরে অর্থ সাহায্য করলেন। কলকাতা মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠায়ও অঢেল অর্থ দান করলেন।
এই সকল জনকল্যাণমূলক কাজে ক্রমেই রাজচন্দ্রের সুনাম সর্বত্রে ছড়িয়ে পড়ে। বিলাসিতা, বেলেল্লাপনার বিপরীতে সর্বসাধারণের জন্য কল্যাণকর কাজে নিজেকে যুক্ত করে তখনকার উচ্চবর্ণের কোম্পানি মুৎসুদ্দি-ব্যবসায়ী ও জমিদারদের থেকে নিজের পরিচ্ছন্ন স্বাতন্ত্র্য ইমেজ দাঁড় করান রাজচন্দ্র। এতে তথাকথিত উচ্চবর্ণের অভিজাত হিন্দুদের নিকট নমঃশূদ্র রাজচন্দ্রের অবস্থান সুদৃঢ় হয়ে ওঠে। রাজা রামমোহন রায়, প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর, রাজা কালীকৃষ্ণ ঠাকুর, রাজা রাধাকান্ত দেব, দেওয়ান গঙ্গাগবিন্দ সিংহ, প্রসন্নকুমার ঠাকুর, কালীপ্রসন্ন সিংহ, অক্রূর দত্ত প্রমুখের সমমর্যাদা লাভের পাশাপাশি তাদের কাতারে বসে গেল রাজচন্দ্রের নাম। ঊনবিংশ শতাব্দীর উচ্চবর্ণের রাজা, মহারাজা, জমিদারদের সঙ্গে একত্রে স্বীকৃতি পেল মাহিষ্য বংশোদ্ভূত নমঃশূদ্র রাজচন্দ্র। পেলেন সরকারি স্বীকৃতিও। তাকে ‘রায়’ উপাধিতে ভূষিত করে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। তাঁকে অনারারি ম্যাজিস্ট্রেট পদেও নিয়োগ দেয় কোম্পানি। রামমোহন রায়ের সতীদাহ প্রথা রোধে রাজচন্দ্রও যুক্ত হয়ে পড়েন। ১৮২৯ সালে কলকাতায় স্থাপিত হয় প্রথম ব্যাংক। সে ব্যাংকেরও পরিচালক হলেন রাজচন্দ্র। রাজচন্দ্রের বাড়িতে আমন্ত্রিত হয়েছেন বাংলার বড়লাটও।
রাজচন্দ্র ও রাসমণির সংসারে চার কন্যা। পদ্মমণি, কুমারী, করুণাময়ী ও জগদম্বা। এক পুত্র ভূমিষ্ঠ হবার পরই মারা যায়। মেয়েদের বিয়েও হয় সমবর্ণে। কেননা অসমবর্ণের বিয়ে তখন ভাবাই যেতো না। ধর্মীয় পাপাচার হিসেবে সেটা গণ্য হতো। বড় মেয়ের বিয়ে হয় মাহিষ্যকুলীন রামচন্দ্র দাসের সঙ্গে। দ্বিতীয় কন্যার বিয়ে হয় খুলনা জেলা নিবাসী প্যারীমোহনের সঙ্গে। তৃতীয় কন্যা করুণাময়ীর হয় মথুরামোহনের সাথে। স্বল্পায়ু করুণাময়ীর মৃত্যুর পর তৃতীয় জামাতা মথুরামোহনের নিকট চতুর্থ কন্যা জগদম্বার বিয়ে দিয়ে পুত্রবৎ জামাইকে বাড়িতে রেখে দেন।
৯ জুন ১৮৩৬ সালে ভ্রমণকালে গাড়িতে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে রাজচন্দ্র মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ ও প্যারালাইজড হয়ে মাত্র ৫৩ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন।
রাজচন্দ্রের মৃত্যুর পর পুত্র না থাকায় ব্যবসা-জমিদারির একক দায়িত্ব বর্তায় রানি রাসমণির ওপর। অত্যন্ত শক্ত হাতে, ধীর-স্থির, অধিক বুদ্ধিমত্তায় রাসমণি রাজকার্য সামাল দিয়ে স্বামীর অবর্তমানে জমিদারিতে নিজের দৃঢ় অবস্থান নিশ্চিত করেছিলেন। স্বামীর সিলমোহর পাল্টে নিজের নামে সিলমোহর তৈরি করে জমিদারিতে ক্রমেই পারঙ্গম হয়ে ওঠেন। জমিদারি কার্যে জামাতা মথুরামোহন সর্বদা তাঁকে সাহায্য করতেন।
ওদিকে উচ্চবর্ণের বিখ্যাত বিত্তশালী জমিদার প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর মাত্রাতিরিক্ত বিলাসে-বেলেল্লাপনায় দেনার দায়ে প্রায় ডুবে গেছেন। তিনি ছিলেন তাঁরই নিঃসন্তান জ্যাঠামশাইয়ের দত্তক পুত্র। সে সুবাদে প্রচুর ধন-সম্পত্তির অধিকারী হয়েছিলেন। আইন পড়েছেন। আইন ব্যবসাও শুরু করেছিলেন। কোম্পানি কর্তৃক চব্বিশ পরগনার নিমকমহলের কালেক্টরের দেওয়ান নিযুক্ত হয়েছিলেন। কোম্পানির সঙ্গে নানামুনাফা নির্ভর ব্যবসায় প্রচুর অর্থ রোজগারও করেছিলেন। খুলেছেন ব্যাংক ও বীমা কোম্পানি। তৈরি করেছেন চিনিকল। আসাম চা কোম্পানি, নীলের অনেকগুলো কারখানারও মালিক ছিলেন দ্বারকানাথ ঠাকুর। বঙ্গের বাইরে উড়িষ্যায়ও জমিদারি ছিল তাঁর। একদিকে অঢেল অর্থ উপার্জন করলেও অন্যদিকে দেশে-বিদেশে মাত্রাতিরিক্ত মদ-মাংসে, নতর্কী-পতিতাদের সংস্পর্শে টাকা উড়ে যেতে বিলম্ব ঘটে না। বেলগাছিয়ার বাগান বাড়িতে মদ ও নতর্কীর আসর বসতো প্রতিরাতে। সেখানে কোম্পানির সাহেব, মেম সাহেব, রাজা, মহারাজাদের আগমন ঘটতো। দ্বারকানাথের আমোদ-ফুর্তির সংবাদ সর্বত্রে রটে গিয়েছিল। অতিমাত্রায় বেলেল্লাপনায় দ্বারকানাথের অর্থের সংকট দেখা দেয়। জমিদার দ্বারকানাথ নগদ অর্থের প্রয়োজনে চাকরি করতে মনঃস্থির করেন। তাঁর চোখ পড়ে জানবাজারের রাজবাড়ির দিকে। রাজচন্দ্র গত হয়েছেন। তাঁর বিধবা পতœী রাসমণির নিশ্চয় দেওয়ান-ম্যানেজারের প্রয়োজন হবে। এই সুযোগে নগদ রোজগারের পথ খুলে যাবে। দেনার দায়ে জর্জরিত দ্বারকানাথের দেনা শোধের এরচেয়ে মোক্ষম সুযোগ আর কোথায়! তাই তিনি জানবাজারের জমিদার বাড়ির নমঃশূত্র জেলেনি রানি রাসমণির দ্বারস্থ হন। চাকরির আশায় প্রস্তাব দেন। রাসমণি অবাক-বিস্মিত। রাসমণি প্রিন্স দ্বারকানাথকে অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে বলেন, ‘এক অসম্ভব বেমানান প্রস্তাব দিয়েছিন আপনি। কলকাতার বিখ্যাত ঠাকুরবাড়ির নামজাদা জমিদার জানবাজারের ম্যানেজার হতে পারে না।’ দ্বারকানাথ ইতস্তত, অতঃপর বললেন, ‘কিছু মনে করবেন না। নিতান্ত নিরুপায়ে আপনার কাছে এ ধরনের প্রস্তাব নিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছি।’ দ্বারকানাথকে সাফ জানিয়ে দেন, “বাজারে আমাদের অনাদায়ী ঋণ অনেক। ঋণগ্রহীতাদের মধ্যে আপনিও একজন। ম্যানেজারের কাছ থেকে জানতে পেরেছি আপনি আমাদের জমিদারি থেকে দু’লক্ষ টাকা ধার নিয়েছিলেন। ফেরৎ দেবার ব্যবস্থা করলে আমাদের অত্যন্ত উপকার হয়।”
রাসমণির কথাগুলো দ্বারকানাথের গালে চপেটাঘাতের তুল্য ছিল। নিরুপায়ে শেষে ঋণের সুদাসলের সমস্ত অর্থের বিনিময়ে স্বরূপনগর পরগনাটি লিখে দেন রাসমণিকে। রংপুর ও দিনাজপুরের অন্তর্গত স্বরূপনগর। বার্ষিক খাজনা আদায় হয় ছত্রিশ হাজার টাকা। রাসমণি সম্মতি জানালে ক’দিনের মধ্যে দ্বারাকানাথ দলিলপত্র তৈরি করে রামমণির হাতে তুলে দেন। রাজচন্দ্র নেই এই সুযোগ হাতাতে অনেকেই তৎপর হয়ে ওঠে। নড়াইলের রামরতন রায় পাশের রাসমণির জগন্নাথপুর তালুকের গরিব প্রজাদের ওপর অত্যাচার করে তালুকটি দখলের ফন্দি এঁটেছিল। কিন্তু সংবাদ পাওয়া মাত্র রাসমণি জামাতা মথুরামোহনকে নির্দেশ দিলেন অবিলম্বে মহাবীর সর্দার ও তার বাহিনী নিয়ে রামরতন রায়কে শায়েস্তা করতে। মহাবীর সর্দার সেই অভিযানে নিহত হলেও রামরতন রায় প্রায় পালিয়ে জীবন রক্ষা করেছিল।
নীলকর সাহেবদের অত্যাচারের সীমা-পরিসীমা ছিল না। কৃষকেরা নীলকরদের অত্যাচারে জর্জরিত। মকিমপুর পরগনায় জোরপূর্বক কৃষকদের বাধ্য করা হয়েছে নীলচাষে। নীলকুঠিও তৈরি করেছে সেখানে। জোর করে নামমাত্র মূল্যে জমি ক্রয় করে চলেছে নীলকররা। জমি বিক্রিতে এবং নীলচাষে অনিচ্ছুক কৃষকদের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে বর্বরোচিত অত্যাচার চালায় নীলকর সাহেবরা। নারীদেরও রেহাই দেয়নি। তাদের সম্ভ্রমহানি ঘটাতেও কালক্ষেপণ করেনি তারা। অসহায় কৃষকেরা কার কাছে সুবিচারের জন্য যাবে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সরকার। আদালত, জজ, ম্যাজিস্ট্রেট সবই তাদের হাতের মুঠোয়। স্থানীয় সুবিধাভোগীদের দেওয়ান, গোমস্তা, ম্যানেজার, নায়েব ইত্যাদি পদে চাকরি দিয়ে নীলকরেরা চরম স্বেচ্ছাচারিতায় মেতে উঠেছিল। রাসমণি এ সংবাদ পাওয়া মাত্র বাছাই করা পঞ্চাশজন লাঠিয়াল প্রেরণ করলেন মকিমপুরে। নির্দেশ দিলেন মকিমপুরের নায়েককে, এই লাঠিয়ালদের নিয়ে যেভাবেই হোক যেন উচ্ছেদ করা হয় নীলকরদের। মকিমপুরের নীলকুঠির প্রধান ডোনাল্ড সাহেব। তিনিও লাঠিয়াল নিয়োগ করে রাসমণির লেঠেলদের বিরুদ্ধে। দু’পক্ষের মারামারিতে মার খেলো ডোনাল্ড সাহেব ও তার লাঠিয়ালরা। আদালতে মামলা হলেও বিচারক মামলা খারিজ করে দেন। অবশেষে মকিমপুর ছেড়ে যেতে বাধ্য হয় নীলকরেরা।
রাসমণি বর্ণে কৈবর্ত। গঙ্গা নদীতে জেলেরা মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করে আসছে যুগ-যুগান্তর ধরে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি করের বোঝা চাপালো মাছ আহরণকারী জেলেদের ওপর। নিরুপায়ে অসহায় জেলেরা শোভাবাজারের রাজা রাধাকান্ত দেবের শরণাপন্ন হয়। কিন্তু রাধাকান্ত দেব জেলেদের সাফ জানিয়ে দিলেন, সরকার বাহাদুরের বিরুদ্ধে তিনি যেতে পারবেন না। জেলেরা ছুটে গেল জানবাজারে রাসমণির কাছে। স্বগোত্রীয়দের এই দুঃসময়ে তিনি নিশ্চুপ থাকতে পারলেন না। জেলেদের অভয় দিয়ে বললেন তিনি দ্রুত ব্যবস্থা করবেন যাতে জেলেদের কর দিতে না হয়। রাসমণি দেওয়ানকে নির্দেশ দিলেন অবিলম্বে সরকারের কাছ থেকে গঙ্গার ইজারা নিতে। দেওয়ান যেন অর্থের পরোয়া না করে, সে নির্দেশও দিয়েছিলেন রাসমণি। দশহাজার টাকার বিনিময়ে সরকারের কাছ থেকে গঙ্গা নদীর মেটিয়াবুরুজ থেকে ঘুসুড়ি পর্যন্ত ইজারা নেওয়া হয়। ইজারার বদৌলতে জেলেদের অবাধে মাছ ধরার আদেশ দেন রাসমণি। জেলেরা মহানন্দে গঙ্গায় মাছ আহরণে নেমে পড়ে।
সরকারকে শিক্ষা দেবার অভিপ্রায়ে রাসমণি ইজারা নেওয়া গঙ্গা নদীর মেটিয়াবুরুজ হতে ঘুসুড়ি পর্যন্ত লোহার শিকল দিয়ে ঘিরে দেবার নির্দেশ দেয়। কোম্পানির সকল ব্যবসা জলপথেই। নদীতে শেকল দেবার কারণে কোম্পানির জাহাজ চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। কোম্পানি সরকার রাসমণিকে লোহার শিকল তুলে নেবার নির্দেশ দেয়। সেই নির্দেশ উপেক্ষা করেন রাসমণি এবং বলেন ইজারা নেওয়া অঞ্চলের পূর্ণ অধিকার তার। জাহাজ চলাচলে জেলেদের মাছ ধরায় ব্যাঘাত ঘটে তাই ওই শেকল খোলা যাবে না।
সরকার সমঝোতার প্রস্তাব দিলেন। পাশাপাশি ইজারার অর্থ ফেরৎ দিয়ে ইজারা বাতিলেরও অনুরোধ করেন। রাসমণি শর্ত জুড়ে দিলেন, দরিদ্র জেলেদের কাছ থেকে কোনোদিন কর নিতে পারবে না, এই শর্ত মানলেই খুলে দেওয়া হবে গঙ্গার শৃঙ্খল-বন্ধনী। শর্ত মেনে দশ হাজার টাকা ফেরৎ দিয়ে কর-বিহীন মৎস্য শিকারের স্থায়ীব্যবস্থা চালু করতে বাধ্য হয় কোম্পানি সরকার।
রাসমণির ওপর কোম্পানি সরকার ক্রমেই ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। প্রতিশোধ নিতে দুর্গাপূজার মিছিলের ঢাক, ঢোল, কাঁসর, ঘণ্টাসহ বাদ্যবাজনার অভিযোগ তোলে, সাহেবদের ঘুমের ব্যাঘাতে। সাহেবরা ঘর থেকে বের হয়ে সমবেতভাবে শব্দ বন্ধে কড়া ভাষায় হুমকি প্রদান করে। কিন্তু কে শোনে কার কথা। সাহেবরা শেষে পুলিশের কাছে অভিযোগ দায়ের করে। বিষয়টি ধর্মীয় আবেগের বিষয় ভেবে পুলিশ বিষয়টি আমলে নেয়নি। সরকারও চায়নি ধর্মীয় আবেগকে আঘাত করে কোনো অনভিপ্রেত অঘটনের জন্ম দিতে।
বিজয়া দশমীতে আবারো প্রবল বাদ্য-বাজনায় বিসর্জনের মিছিল জানবাজার থেকে বাবুঘাট পর্যন্ত যাত্রা করে। বাজি-পটকার তীব্র শব্দে টালমাটাল অবস্থা। প্রশাসন এবার নড়ে ওঠে, রাসমণিকে শব্দদূষণ ও শান্তিভঙ্গের অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত করে পঞ্চাশ টাকা জরিমানা আদায় করে।
এই অপমানের প্রতিশোধ নিতে রাসমণি বিলম্ব করেনি। জানবাজার থেকে বাবুঘাট পর্যন্ত রাস্তাটি ইজারা নেওয়া এবং রাস্তাটি নির্মাণও করেছিলেন রাজচন্দ্র। ইজারার দলিল আদালতে দাখিল করে আদালতকে বিষয়টি অবগত করলেন। পাশাপাশি জানালেন আমার ইজারাকৃত রাস্তায় আমার লোকজন নাচবে, গাইবে, বাদ্য-বাজনা বাজাবে। সরকার জরিমানা করে বাধা প্রদান করেছে। সুতরাং এই রাস্তায় চলাচল করবে স্থানীয় সর্বসাধারণ। সাহেবদের জন্য এ রাস্তায় চলাচল নিষিদ্ধ। ঘড় ঊহঃৎু ইড়ধফ লাগিয়ে দেওয়া হলো। সাহেবদের চলাচল বন্ধ হয়ে গেল। রাস্তার দুই পাশে গরানকাঠের গুঁড়িসহ বিভিন্ন ভাবে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করে সাহেবদেরকে রাস্তায় আসার পথ বন্ধ করে দেওয়া হয়।
সরকার দিশেহারা। অবশেষে রাসমণিকে রাস্তার প্রতিবন্ধক তুলে সাহেবদের চলাচলের সুযোগ করে দেবার আর্জি জানানো হলে, রাসমণি দৃঢ়তার সঙ্গে জবাব দেন, ‘আমার রাস্তার ব্যাপারে কোনো হুকুমদারি চলবে না।’ তবে একশর্তে রাস্তা খুলে দেওয়া যেতে পারে। ফেরৎ দিতে হবে জরিমানার পঞ্চাশ টাকা এবং দুর্গাপূজায় ঢাক, ঢোল, কাঁসর, বাদ্য-বাজনা বাজিয়ে ওই পথ দিয়েই শোভাযাত্রা যাবে, তাতে বাধা দেওয়া যাবে না। সরকার তাৎক্ষণিক রাসমণির সমস্ত শর্ত মেনে স্বস্তির শ্বাস ফেলে।
হতদরিদ্র পরিবারের রাসমণি জানবাজারের জমিদার বাড়িতে এসে হয়ে ওঠেন রানি, রানিমা। রাসমণির পরামর্শেই জনহিতকর কাজে হাত দিয়েছিলেন রাজচন্দ্র। রাসমণিও স্বামীর মৃত্যুর পর সেই কাজের পাশাপাশি হিন্দু সমাজে নিজের মর্যাদা বৃদ্ধির তাগিদে ধর্মচর্চায় নিজেকে অধিক মনোনিবেশ করেন। কলকাতার কাছেই দক্ষিণেশ্বরে নির্মাণ করেন ভবতারিণী মন্দির। নমঃশূদ্র রাসমণির মন্দির নির্মাণ করা নিয়ে কম কা- ঘটেনি। রাজকুমার এবং তার অনুজ গদাধর (রামকৃষ্ণ পরমাংস দেব) মন্দির নির্মাণ ও তত্ত্বাবধায়ক রূপে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। ভবতারিণী মন্দিরে প্রথম পূজা দিতে কলকাতার একজন ব্রাহ্মণও আসতে রাজি হয়নি। জেলেনি-রাসমণির করা মন্দিরে পূজা করে জাত হারাতে হবে, এই ভয়ে। ব্রাহ্মণ্যবাদী তৎপরতা তখন ছিল তুঙ্গে। রাজচন্দ্র কিংবা রাসমণি নমঃশূদ্র, এত বিত্ত-বৈভবের পরও সামাজিক স্বীকৃতি বঞ্চিত ছিলেন ওই জাত-বৈষম্যে। ভবতারিণী মন্দিরটিকে দেবোত্তর ট্রাস্টে দান করতে চেয়েছিলেন রাসমণি। কিন্তু উত্তরাধিকারী বড় মেয়ে পদ্মমণি বাধ সাধলেন। দানপত্রে স্বাক্ষর দিলেন না। ছোট মেয়ে জগদম্বা কিন্তু দানপত্রে স্বাক্ষর দিয়েছিলেন। রাসমণিও মৃত্যুর পূর্বদিনে ১৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৩১ সালে দানপত্রে স্বাক্ষর করেন। রাসমণির মৃত্যুর পরে জমিদার রাজচন্দ্রের সম্পত্তি নিয়ে উত্তরাধিকারীদের মধ্যে প্রবল কলহের সৃষ্টি হয়। মামলা-মোকদ্দমায় জড়িয়ে পড়ে পরিবারটি। উত্তরাধিকারীরা পরস্পরের শত্রুতে পরিণত হয়ে খ–বিখ- হয়ে যায়।
যে গদাধর (রামকৃষ্ণ পরমাংস দেব) দক্ষিণেশ্বরের মন্দির নির্মাণে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছিলেন পরবর্তীতে তার প্রতিক্রিয়া কি ছিল?
রামকৃষ্ণের পেছনের কাহিনিটি এরকমের। রানি রাসমণি ষাট বিঘা সম্পত্তি সহ গঙ্গা নদীর তীরে দক্ষিণেশ্বরে কালীমন্দির প্রতিষ্ঠার সমুদয় অর্থ প্রদান করেছিলেন। মন্দির নির্মাণ সমাপ্তির পর মন্দিরে প্রারম্ভিক পূজা অনুষ্ঠানের জন্য কলকাতা থেকে ব্রাহ্মণদের আমন্ত্রণ জানানো হলে ব্রাহ্মণরা একজোটে রাসমণির আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করেছিল। তাদের অভিযোগ, জেলেনির অর্থে নির্মিত মন্দিরে পূজায় অংশ নিলে তাদের জাত-ধর্ম কোনোটিই রক্ষা পাবে না। তাদের পক্ষে নিম্নবর্ণের জেলে সম্প্রদায়ের রানি রাসমণির অর্থে নির্মিত মন্দিরের পূজায় অংশ নেওয়া সম্ভব নয়। বহু চেষ্টা করেও ব্রাহ্মণদের রাজি করানো যায় নি। এমতাবস্থায় গদাধরের অগ্রজ রামকুমার চট্টোপাধ্যায়কে বহু কষ্টে রাজি করিয়ে দক্ষিণেশ্বরের কালীমন্দিরের উদ্বোধনী পূজা অনুষ্ঠান সম্পন্ন করা হয়েছিল। রানি রাসমণির অনুরোধে গদাধর চট্টোপাধ্যায় (রামকৃষ্ণ পরমাংস দেব) ওই মন্দিরের স্থায়ী পূজারীরূপে যুক্ত হয়েছিলেন। পরবর্তীসময় রামকৃষ্ণের শিষ্য বিবেকানন্দ গঙ্গার এপারের কালী মন্দিরটির অপর পাড়ে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন বেলুর মঠ। গঙ্গা নদীর দু’পাড়ের এই মঠ ও মন্দির আজও রয়েছে।
রামকৃষ্ণ সম্পর্কে প্রচলিত আছে তিনি বলেছেন, সব ধর্মের আরাধনাতেই ঈশ্বরপ্রাপ্তি লাভ সম্ভব। এক্ষেত্রে তাঁর কথায় অসাম্প্রদায়িকতার প্রমাণ মেলে। অথচ এই রামকৃষ্ণই শেষ পর্যন্ত দক্ষিণেশ্বরের কালীমন্দিরের দেবীমূর্তির নিকট হাত জোড় করে বলেছেন, ‘মা কালী, তুই জেলেনির অন্নপাপের পাপাচারে নিযুক্ত করলি। ভাগবানের নিকট কিসের প্রায়শ্চিত্তে আমার পাপ মোচন হবে জানি না। জেলেনির অন্ন গ্রহণের অপরাধে আমাকে নিশ্চয় চরম শাস্তি ও প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে। মা কালী, তুই আমায় রক্ষা করিস মা।’
মযহারুল ইসলাম বাবলা
নির্বাহী সম্পাদক, নতুন দিগন্ত