চলন্ত বাসে ধর্ষণ: প্রশাসনের উদাসীনতাকে দুষলেন তারা
ধর্ষণ দিন দিন মহামারী আকার ধারণ করছে। শিশু থেকে কিশোরী, তরুণী থেকে বৃদ্ধা, কেউ বাদ পড়ছে না। বাসস্থান থেকে কর্মস্থল, ফুটপাত থেকে গণপরিবহন-চলন্তবাস কোথাও নারীর নিরাপত্তা নেই। সম্প্রতি চলন্তবাসেও সংঘবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনা বেড়েই চলেছে। অপরাধ বিশেষজ্ঞ, সমাজসচেতন ও বিচার কার্যক্রমের সঙ্গে সংশ্লিষ্টজনরা বলছেন, এই ধরনের অপরাধের জন্য মানসিক বিকৃতি দায়ী। পুলিশি গাফিলতি ও প্রশাসনের উদাসীনতাকেও কেউ কেউ দায়ী করছেন। এছাড়া পারিবারিক শিক্ষা, দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় যথাযথ যৌনশিক্ষার অভাবকেও অনেকে দুষছেন। চলন্তবাসে ধর্ষণ ঠেকানোর জন্য প্রশাসনের সতর্কতা ও সামাজিক সচেতনতার ওপর তারা গুরুত্ব আরোপ করেছেন।
উল্লেখ্য, চলন্ত বাস-মাইক্রোবাসে ধর্ষণের ঘটনা নতুন নয়। কিন্তু সম্প্রতি ভয়াবহ আকারে বাড়ছে। সর্বশেষ চলতি বছরের ৬ আগস্ট, দিনগত রাত ৩টার পর গাজীপুর মাওনা ফ্লাইওভার পার হওয়ার পর স্বামীকে মারধর করে রাস্তায় ফেলে গৃহবধূকে বাসচালক, তার সহযোগীসহ পাঁচ জন মিলে ধর্ষণ করে। এর আগে, ২ আগস্ট দিনগত রাতে কুষ্টিয়ার দৌলতপুর থেকে ঈগল পরিবহনের একটি বাস ৩০-৩৫ জন যাত্রী নিয়ে ঢাকার উদ্দেশে ছেড়ে আসার পথে এক নারী ওই চলন্তবাসেই সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হন।
তারা এটা জানে, ধর্ষণের শিকার নারী সহজে এটা নিয়ে মামলা-মোকদ্দমা করবে না। কারণ করলেও এত কাঠ-খড় পুড়িয়ে বিচার পেতে পেতে এতদিন পার হয়ে যায়, যাতে সঠিক বিচারটা পাওয়া দুরূহ হয়ে পড়ে।
চলন্তবাসে ধর্ষণ সম্পর্কে জানতে চাইলে বরিশাল যুগ্ম জেলা ও দায়রা জজ ইসরাত জাহান বলেন, ‘চলন্তবাসে নারীকে সংঘবব্ধ ধর্ষণের জন্য প্রধানত দায়ী পুরুষতন্ত্রের বিকৃত মানসিকতা। তারা নারীকে সর্বত্র ভোগ্য পণ্যের মতো উপস্থাপন করে। অধিক জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও মানুষের মূল্যবোধ উন্নয়নের বিষয়ে সার্বিক উদাসীনতাও এর জন্য দায়ী। মানুষ অনেক বেশি বিকৃত ও অরুচিকর হয়ে পড়েছে। এর কারণ নৈতিক ও সামাজিক অবক্ষয়। মানুষের মধ্যে যথার্থ শিক্ষার অভাব রয়েছে। মানবিক বিষয়ের প্রতি মনোযোগী না হয়ে উগ্রবাদের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়ছে একইসঙ্গে পর্নগ্রাফির বিস্তারও বাড়ছে।’
এই ধরনের অপরাধ থেকে মুক্তি পাওয়ার পরামর্শ দিতে গিয়ে এই বিচারক বলেন, ‘জৈবিক চাহিদা মেটানোর জন্য পারিবারিক পরিবেশের ওপর গুরুত্ব আরোপ করতে হবে। সর্বোপরি মেয়েদের পরিবার ও সমাজে যথাযোগ্য সম্মান ও মর্যাদা দিতে হবে। তাদের শিক্ষা ও চাকরি নিশ্চিত করতে হবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘পরিবারে ছেলেকে মেয়ের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভাবার প্রবণতা দূর করতে হবে। ছেলে মেয়ে উভয়কেই আত্মরক্ষার কৌশল সরকারিভাবে প্রাথমিক বিদ্যালয় পর্যায় থেকে শুরু করে মাধ্যমিক পর্যন্ত শেখাতে হবে। এই সব সার্বিক বিষয়ে সরকারি বেসরকারি উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে।’
চলন্ত বাসে-রাস্তার ধারে-বাইরে ধর্ষণের জন্য বিকৃত মানসিকতাকে দায়ী করলেন আইনজীবী ও মানবাধিকারকর্মী দিলরুবা শারমিন। তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশে আইনের শাসনের অভাব। এটা বলার কারণ ধর্ষণ করার পর ভুক্তভোগীকে এতগুলো স্টেজ পার করতে হয় তার ধর্ষণের ঘটনা প্রমাণ করতে। যেটা করতে করতে অনেক দিন-মাস-ক্ষণ-বছর পার হয়ে যায়। এবং শেষ পর্যন্ত আমাদের দেশের ধর্ষণের শিকার নারী যে ধরনের রায় পায়, তা কাঙ্ক্ষিত হয়ে ওঠে না। আমাদের সমাজব্যবস্থায় ধর্ষণের শিকার নারী তার পরবর্তী জীবনের দুঃখজনক পরিণতির কথা বিবেচনা করে গোপন করে যায়। ফলে ধর্ষকরা আরও বেশি উৎসাহিত হয়। তারা এটা জানে, ধর্ষণের শিকার নারী সহজে এটা নিয়ে মামলা-মোকদ্দমা করবে না। কারণ করলেও এত কাঠ-খড় পুড়িয়ে বিচার পেতে পেতে এতদিন পার হয়ে যায়, যাতে সঠিক বিচারটা পাওয়া দুরূহ হয়ে পড়ে।’
যার জন্য, লোকালয়ে থাকাকালীন তারা নিজেদের কাম-রিপুকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারলেও একটু নীরব পরিবেশ পেলেই এই চাহিদাটা প্রবল আকার ধারণ করে। তখন তারা সুযোগ খুঁজতে থাকে, নিজের চাহিদা পরিপূরণ করার।
এই আইনজীবী আরও বলেন, ‘অনেক জটিল প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে যেতে হয় ধর্ষণ শিকার নারীকে। মেডিক্যাল টেস্ট, সাক্ষী, ধর্ষণের ঘটনাস্থল, দিন, তারিখ, সময় মিলিয়ে এমন একটা পর্যায় যায় যেটা প্রমাণ করতে করতে ধর্ষণের শিকার নারী তার সমস্ত উৎসাহ-আগ্রহ হারিয়ে ফেলে।’
চলন্ত বাসে ধর্ষণ প্রতিরোধ প্রসঙ্গে এই আইনজীবী বলেন, ‘শক্তিশালী আইন, আইনের শাসন, পুলিশের সহোযোগিতা না পাওয়া গেলে এ ধরনের মামলায় রাষ্ট্রীয় আইনজীবীদের সহোযোগিতা পাওয়া না গেলে বাস, ট্রেনে সংঘবদ্ধ ধর্ষণ কমিয়ে আনা সম্ভব হবে না।’ তিনি আরও বলেন, ‘বিকৃত মানসিকতা, শিক্ষার অভাব, যৌনবিষয় নিয়ে আলোচনা করতে বন্ধু-বান্ধব, সিনিয়র-জুনিয়র, বাবা-মা-ভাই-বোন কথা বলতে সাংঘাতিক লজ্জা পায়, এটাও একটা কারণ। আমাদের এই সংকোচ বোধ করাটাও ধর্ষণের অন্যতম কারণ। আর ধর্ষণ কেমন করে প্রতিহত করতে হয়, এগুলোও আমরা জানি না বলে। তাই আমাদের দেশে এ ঘটনাগুলো ঘটে।’
এই আইনজীবী আরও বলেন, ‘আর প্রতিকারের কথা বললে বলতে হবে ধর্ষণ এই অপরাধের কোনো ক্ষমা নেই। তবে আমি আমি ফাঁসির বিপক্ষে। ফাঁসি কোনো সমাধান নয়। আমি মনে করি বেঁচে থেকে তার পাপের প্রায়শ্চিত্ত করা কঠিন। তাকে ফাঁসি দিলে তখনই মিটে গেলো। এটা একটা দিক। আর একটা দিক ফাঁসি মানবিক দিক না। ধর্ষণের মতোই অমানবিক। কিন্তু আমি চাই ধর্ষণের শিকার নারী বিচার পাক। প্রতিকার পাওয়ার জন্য সরকারি আইন সহোযোগিতাগুলোকে অ্যাক্টিভ হতে হবে। সরকারের যত সুযোগ-সুবিধা, তা প্রচারের আওতায় আনতে হবে। সরকারি আইনজীবী, পিপি, জিপি, এপিপি, এজিপি বা ডিএজি এদেরও ধর্ষণের শিকার নারীর পাশে দাঁড়াতে হবে। ডাক্তার, পুলিশকেও ভু্ক্তভোগীর প্রতি সংবেদনশীল পরিবেশ গঠন করতে হবে। পুলিশ যে ধরনের আচরণ করে, তাতে ভুক্তভোগীরা সাহস পায় না থানায় মামলা করতে।’
দিলরুবা শরমিন বলেন, ‘মেডিক্যাল টেস্টের ব্যাপারে সচেতন হতে হবে। ডাক্তার, পুলিশ, আইনজীবী অত্যন্ত মানবিকভাবে ধর্ষিতার পাশে দাঁড়াতে হবে। ফলে বিচারকের পক্ষে একটা সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ রায় দেওয়া সহজ হবে। মেয়েদের সচেতন করতে হবে, পরিবারকে সচেতন করতে হবে, নারীবান্ধব-কন্যাবান্ধব সমাজব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে।’
পরিবারের সদস্যদের মধ্যে সুসম্পর্ক ও সুদৃঢ় বন্ধন তৈরি করতে হবে। একে অন্যের প্রয়োজনে পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি ও সম্প্রীতি গড়ে তুলতে হবে।
ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকের কর্মকর্তা ফাহমিদা আলী বলেন, ‘ইন্টারনেট ও তার অপব্যবহার করার সুযোগ, মাদক, বা নেশাজাতীয় দ্রব্যের সহজলভ্যতা, দীর্ঘ দিন ধরে পারিবারিক সম্পর্ক ও জীবন থেকে দূরে থাকার কারণে কিশোর থেকে শুরু করে মোটামুটি সব বয়সের পুরুষদের মস্তিষ্ক ও মনস্তত্ত্বে একটা ব্যাপক চাপ সৃষ্টি হয়। এই চাপটা সমানভাবে তাদের জৈবিক চাহিদার ওপরেও প্রভাব বিস্তার করে। যার জন্য, লোকালয়ে থাকাকালীন তারা নিজেদের কাম-রিপুকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারলেও একটু নীরব পরিবেশ পেলেই এই চাহিদাটা প্রবল আকার ধারণ করে। তখন তারা সুযোগ খুঁজতে থাকে, নিজের চাহিদা পরিপূরণ করার। যেটা স্বাভাবিকভাবে পাওয়ার কথা, সেটা তখন একটা বিকৃতিতে রূপ নেয়। আর তারই বহিঃপ্রকাশ ঘটায় চলন্ত বাসে কোনো না কোনো নারীর শরীরের ওপর হামলে পড়ে।’
ফাহমিদা আলী আরও বলেন, ‘নারীর শারীরিক কাঠামো ও তাদের চলার ছন্দ পুরুষকে আকৃষ্ট করে সহজেই। অপেক্ষাকৃত নীরব পরিবেশ মানুষের নিয়ন্ত্রণহীনতাকে ত্বরান্বিত করে খুব সহজেই। তাই তখন তারা যৌন বিকৃতিতে আক্রান্ত হয়ে ধর্ষণের মতো জঘন্য অপরাধে লিপ্ত হয়। এছাড়া কর্মজীবী নারীর, কাজের জায়গা থেকে দেরি করে বাসায় ফেরাও একটা কারণ। হয়তো তারা কর্মক্ষেত্র থেকে বেরিয়ে গণপরিবহনের জন্য অপেক্ষারত অবস্থায়। তখনই কেউ না কেউ পৌঁছে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে তাকে নিজেদের পরিবহনে তুলে নেয়। আর সুযোগ নিজেদের চরিতার্থ পূরণে লিপ্ত হয়।’
প্রতিরোধের পরামর্শ দিয়ে ফাহমিদা আলী বলেন, ‘মানুষকে সুশিক্ষার পাশাপাশি স্বশিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলতে হবে। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার পাশাপাশি নৈতিকতা, মূল্যবোধ ও ও মানবিক শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলতে হবে। সহশিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনাকে আরও অনেক বেশি ত্বরান্বিত করতে হবে। মানুষের জন্য সমানভাবে সামাজিক, মানসিক ও যৌনশিক্ষা ব্যবস্থা চালু করতে হবে। পারিবারিক মূল্যবোধ বজায় রাখা এবং নৈতিক অবক্ষয় থেকে তাদের রক্ষা করার ব্যবস্থা নিতে হবে। পরিবারের সদস্যদের মধ্যে সুসম্পর্ক ও সুদৃঢ় বন্ধন তৈরি করতে হবে। একে অন্যের প্রয়োজনে পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি ও সম্প্রীতি গড়ে তুলতে হবে।’
থানা-পুলিশ, আইনজীবী, ডাক্তারদের মানবিক আচরণ করতে হবে ভুক্তভোগী নারীর প্রতি। সর্বোপরি আইনের কঠোর প্রয়োগ ও সচেতনতাই পারে এ ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা কমিয়ে আনতে।
নারায়ণগঞ্জ ল’ কলেজের ফাইনাল ইয়ারের ছাত্রী খাদিজা তুল জান্নাত বলেন, ‘ধর্ষণ একটি ঘৃণ্যতম অপরাধ, যা একজন মানুষকে শারীরিক ও মানসিকভাবে ধ্বংস করে দেয়। আজকাল চলন্ত বাসে ধর্ষণ-সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হচ্ছেন নারীরা। মেয়েদের নিরাপত্তা কোথায় তাহলে? গণপরিবহনে উঠলেই দেখা যায় মহিলা সিটে পুরুষ বসে আছে। অনেক সময় তারা নির্দিষ্ট জায়গাটি ছেড়ে দিতেও নারাজ। চলন্ত বাসে পাশাপাশি পুরুষ ও নারী দাঁড়ালে নানারকমভাবে তাকে হেনস্তা করাও হয়। কিন্তু বাংলাদেশে আইনি জটিলতার পাশাপাশি বিকৃত মানসিকতা, সচেতনতার অভাবে এ ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা বারবার ঘটছে।’
এই শিক্ষার্থী আরও বলেন, ‘এখন তো আবার নতুন এক আতঙ্ক শুরু হয়েছে। চলন্ত বাসে নারী যাত্রীদের নিরাপত্তাহীনতায় ভোগাচ্ছে। ধর্ষণ-সংঘবদ্ধ ধর্ষণের মতো জঘন্য অপরাধ ঘটছে। আইনের সুষ্ঠু প্রয়োগের পাশাপাশি মেয়েদের সচেতন হতে হবে। শিক্ষা ব্যবস্থার পরিবর্তন করতে হবে। থানা-পুলিশ, আইনজীবী, ডাক্তারদের মানবিক আচরণ করতে হবে ভুক্তভোগী নারীর প্রতি। সর্বোপরি আইনের কঠোর প্রয়োগ ও সচেতনতাই পারে এ ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা কমিয়ে আনতে।
অনন্যা/এআই