মহাকাব্যের নারীগণ: শূদ্রা, চির আড়ালে, চির অন্ধকারে
মহাভারতের সবচেয়ে আড়ালে আর অবহেলায় থাকা চরিত্রের নাম শূদ্রা। যেই নারী নাহলে মহাভারতের কাহিনী হয়তো অন্যরকমভাবে লেখা হতো। কিন্তু তিনি এতটাই আলোর বাইরের চরিত্র যে, তার নাম কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন পাঠকের সামনে সঠিকভাবে উপস্থাপনই করেননি। অথচ এই নারীই হলেন, হস্তিনাপুর রাজসভার সবচেয়ে জ্ঞানী ও মন্ত্রী বিদুরের মা।
বিচিত্রবীর্যের স্ত্রী অম্বিকার রূপবতী দাসী। বিচিত্রবীর্য নিঃসন্তান অবস্থায় দেহত্যাগ করলে সত্যবতী ভীষ্মকে অম্বিকা ও অম্বালিকার গর্ভে বংশধর পুত্র উৎপাদন করতে বলেন। কিন্তু ভীষ্ম চিরকুমার থাকার প্রতিজ্ঞা স্মরণ করে নিবৃত্ত হন। তখন সত্যবতী ব্যাসকে স্মরণ করেন। আর ব্যাস স্মরণ-মাত্র উপস্থিত হয়ে সব ব্যাপার শুনে পুত্র উৎপাদনে সমর্থ হন।
কিন্তু সঙ্গমকালে অম্বিকা ব্যাসের কৃষ্ণবর্ণ, দীর্ঘচক্ষু, পিঙ্গল জটা ও শ্মশ্রু দেখে ভীত হয়ে চোখ মুদ্রিত করে। সেই ত্রুটির কারণে অম্বিকা ধৃতরাষ্ট্রের জন্ম দেয়। অম্বিকার এই ত্রুটির কারণে ধৃতরাষ্ট্র অন্ধ হয়ে জন্মগ্রহণ করে। আর সত্যবতীও তাই অম্বিকাকে পুনরায় ব্যাসের নিকট গমনের নির্দেশ দেন। কিন্তু ব্যাসের মূর্তি স্মরণ করে অম্বিকা আর ব্যাসের শরণাপন্ন হয় না। কূটকৌশলে অম্বিকা তার সুন্দরী অপ্সরার মতো দাসী শূদ্রাকে পাঠিয়ে দেয়। অন্ধকার থাকায় সুন্দরী এই দাসীর গর্ভেই ব্যাস জন্ম দেন ইতিহাসের সবচেয়ে বুদ্ধিমান, ধর্মাত্মা বিদুরের। দাসীর গর্ভে ও কৃষ্ণ দ্বৈপায়নের ঔরসে বিদুরের জন্ম।
বিদুরের মাতা শূদ্রা যদি বিদুরের জন্ম না দিতেন, তবে নিশ্চয় মহাভারতের কাহিনী ভিন্ন রূপ নিতো। কিন্তু শূদ্রা দাসী হিসেবে সন্তানের জন্ম দেওয়ায় তাকে মহাভারতে আর দেখা যায় না। বিদুরের জন্মগ্রহণের পর তার নামকরণ উৎসবে সত্যবতী আপত্তি জানান। সেখানেও বিদুরকে সঠিকভাবে সত্যবতী বা হস্তিনাপুরবাসী গ্রহণ করেনি। কিন্তু মহাভারত যারা পাঠ করেছেন, তারা বিদুরের বুদ্ধিমত্তা ও ধর্মজ্ঞান সম্পর্কে অবগত আছেন।
দাসীর গর্ভে যত জ্ঞানী, ধর্মাত্মারই জন্ম হোক না কেন সে দাসী পুত্র। এদিকে বিদুরের মাতা শূদ্রাকে কিছু সামান্য উপঢৌকন দিয়ে সত্যবতী তাকে দমিয়ে দিয়েছে। কিন্তু কাহিনীর আর কোথায়ও শূদ্রার উপস্থিতি লক্ষ করা যায়নি। দাসী হিসেবেও আর তার কোনো উপস্থিতিও দেখা যায়নি। যেই নারী বিদুরের মতো সুপুত্রের জন্মদাত্রী তাকে কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন কোথাও এতটুকু সাক্ষাৎ ঘটানোর প্রয়োজনবোধ করেননি। তবে কি কাহিনীর স্বার্থেই শূদ্রার আর্বিভাব ঘটেছিল! একজন নারী একটি পুত্র জন্ম দেবেন, হুট করে উধাও হয়ে যাবেন! অম্বিকা, অম্বালিকার সদর্পে বিচরণ ঘটলেও সেখানে তার কোনো উপস্থিত থাকবে না?
শূদ্রাকে আর কোথাও তুলে ধরেননি কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন। তবে কি লেখকের চরম অমানবিকতা ও উদাসীনতা লক্ষণীয় নয়! কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন শূদ্রার কোনো অস্তিত্ব না দেখানোর কারণ কি শুধু উদাসীনতা? না কি তৎকালীন সমাজবাস্তবতাও, তাই দাবি করে? নারীরা যে শুধু ভোগের সামগ্রী, তা শূদ্রার মতো দাসীকে ব্যবহার করে আরও একবার প্রমাণ করলেন দ্বৈপায়ন। যাকে শুধু প্রয়োজনে পাশে রাখা যায়, এমনকি ইচ্ছে মতো ব্যবহারও করা যায়। তবে প্রশ্ন হলো, কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন যে বিদুরের জন্ম দেন, সেই বিদুর এত প্রচণ্ড বুদ্ধিমান ও ধর্মজ্ঞানী। তিনিও কখনো নিজের মা প্রসঙ্গে কোনো স্মৃতিচারণ বা কোনোরকম প্রসঙ্গও তোলেননি। তবে সেখানেও লেখকেরই কিছু চরিত্র উপস্থাপনে অতি আবেগের ফল প্রকাশিত হয়েছে।
ছোটখাটো,পার্শ্বচরিত্র বা যারা ছিল, তাদের নিয়ে কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন ভাবনাহীন ছিলেন। তবে যে বিদুর পুরো মহাভারতের কাহিনী সঞ্চালনে গতি এনেছেন, সেই বিদুরের মাতা শূদ্রাকে এতটা অন্ধকারে রাখা লেখকের স্বচ্ছতা এবং লেখনকৌশলের প্রতি পাঠককে সন্দিহান করে তোলে। তবে কি শুধু যুদ্ধই মূল! মানবজীবন দেখানো নয়? যদি মানবতা গুরুত্ব পেতো, তাহলে হয়তো শূদ্রা আলোয় উজ্জ্বল চরিত্র হয়ে উঠতে পারতো। দাসী হয়ে কিভাবে বিদুরের মতো সন্তানের জননী-রূপে নিজেকে মেলে ধরেছিলেন, সে আলোচনা প্রসঙ্গক্রমে উঠে আসতো। কিন্তু কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন শূদ্রাকে সন্তান জন্মদানেরই পরই যেন হত্যা করেছেন। মহাজ্ঞানী-মহামতি বিদুরের মা শূদ্রা চরিত্রটিকে এভাবে আড়ালে রাখার জন্য কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন আজ ও আগামীর পাঠকের কাছে প্রশ্নবিদ্ধ হয়েই থাকবেন।
অনন্যা/ জেএজে