সিমন দ্য বোভোয়ার- একজন অস্তিত্ববাদী নারীবাদী
সিমন দ্য বোভোয়ার, অস্তিত্ববাদী দর্শন কিংবা আধুনিক নারীবাদের জগতে এক অবিস্মরণীয় নাম। তিনি একজন ফরাসি লেখিকা, বুদ্ধিজীবী এবং মানবাধিকারকর্মী। তার জন্য ১৯০৮ সালের ৯ জানুয়ারি
প্যারিসে। ‘সেকেন্ড সেক্স’ তার বিখ্যাত গ্রন্থ। লেখালেখির জগতে তিনি বোভোয়ার নামেই সর্বাধিক পরিচিত।
প্রথমেই বোভোয়ার ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে আলোচনা করা যাক। বোভোয়ার বাবা ছিলেন সিভিল সার্ভিসের একজন লিগ্যাল অ্যাসিস্ট্যান্ট এবং মা একজন ক্যাথলিক ধর্মানুসারী। যদিও মায়ের ধর্ম ত্যাগ করে, চৌদ্দ বছর বয়স থেকেই বোভোয়ার একটি বিশেষ কারণে নাস্তিকতাবাদের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়েন। বোভোয়ারকে গভীরভাবে জানতে হলে যে দুটি বিষয় গুরুত্বের সাথে অনুধাবন করা উচিত তা হলো জ্যা পল সার্নের সাথে তার ঘনিষ্ঠতা এবং প্যারিস এর ১৯৫০-৬০ এর দশকের সময়গুলোতে বোভোয়ার লাইফ স্টাইল।
জ্যাঁ পল সার্জ, বোভোয়ার বাল্যকালের সহপাঠী। তিনি সেই সার্স, যাকে ছাড়া ‘দর্শন’ বিষয়টিকে কল্পনাও করা যায় না। ছোট থেকেই বোভোয়ার সাথে সার্নের ঘনিষ্ঠতা এতটাই গভীরে পৌছে যে, এক সময় দুজনের মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে এবং মৃত্যুর আগ অবধি দুজনের বন্ধুত্ব ও ঘনিষ্ঠতা অটুট থাকে। তাদের মধ্যকার ভালোবাসার সম্পর্ক ছিল চলিত প্রথা বহিভূর্ত, অর্থাৎ একে অপরকে ভালোবাসলেও দুজনেই সম্পূর্ণ সংস্কারমুক্ত ও স্বাধীন ছিলেন, যা একসময় অনেকের কাছে তাদের দুজনকে আইডলে পরিণত করে। তারা একসাথে বসে বই পড়তেন, আর্টিকেল লিখতেন, একসঙ্গে পলিটিক্যাল লিফলেট বিলি করতেন, আবার পুলিশি ঝামেলারও মুখোমুখি হতেন দুজন একসাথেই। দুজন কখনোই সম্পর্কেও ক্ষেত্রে খুব গভীর লতিজ্ঞা দ্বারা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ না থাকলেও, দর্শনচর্চা এবং অস্তিত্ববাদী চিন্তাধারা অনেকটা সামাজিক দায়বদ্ধতার জায়গা থেকে দুজনকে এক করেছে ঠিকই। সার্নের মতে, ‘মানুষ যে কাজই করুক না কেন, সেই কাজটির মাধ্যমে মানুষ মুলত তাই-ই হয়ে ওঠে। মানুষ যে কোন কাজ করার ক্ষেত্রেই স্বাধীন। কোন সামাজিক সীমাবদ্ধতা দ্বারা মানুষকে কখনই বাঁধা যায় না। তবে বিষয়টা আবার এমনও না যে মানুষ যা ইচ্ছে তাই-ই করতে পারবে, হ্যাঁ এটা ঠিক যে সে যা ইচ্ছা তাই করতে পারে তবে প্রতিটি কাজ এর মাধ্যমে সে গোটা মনুষ্যজাতিকে প্রতিনিধিত্ব করে এবং এটা একটা দায়বদ্ধতা’। সান্নে এই কথার সূত্র ধওে বোভোয়া নিজেকে প্রথমে কখনই নারীবাদী হিসেবে পরিচিত করেননি, তিনি নিজের প্রথম পরিচয় হিসেবে ‘মানুষ’ শব্দটিকে ব্যবহার করেছেন এবং অস্তিত্ববাদী হিসেবে নিজেকে দেখতে চেয়েছেন বারবার। অন্যদিকে, বোভোয়ার অস্তিত্ববাদী দর্শনকে গভীরভাবে বিশ্লেষণ করে আমাদের দেখাতে চেয়েছেন কিভাবে আমরা মানুষেরা প্রতিনিয়তই নিজেদেরকে ব্যাখ্যা করে চলেছি এবং যখন আমরা অস্তিত্ব সংকটে ভুগি তখন কিভাবে সেই সময়টাতে ভেঙে পড়ি এবং আবার নিজেদেরকে গড়ে তুলি।
বোভোয়ার এবং সার্ভের এই দুটি চিন্তাকে সংযুক্ত করলে দেখা যায়, দুজনেই একজন মানুষ কিভাবে কী হয়ে ওঠে সেটির প্রতিই গভীরভাবে মনোযোগী ছিলেন। এবং মজার বিষয় অস্তিত্ববাদ এর ধারণাটাও ঠিক একই রকম।
এবার প্যারিসের সময়গুলোতে (১৯৫০-৬০) মনোযোগী হওয়া যাক। সে সময় প্যারিসে বুদ্ধিজীবী শ্রেণীর গুরুত্ব
ছিল সবচেয়ে বেশি। আমেরিকাতে হলিউড তারকাদের যেভাবে জনসম্মুখে সম্মানিত করা হতো, প্যারিসের জনগণের কাছে বুদ্ধিজীবী শ্রেণীর গুরুত্বটাও ছিল একই রকম। সে সময়কার অধিকাংশ নারী এবং পুরুষেরা সবসময়ই চাইতেন বুদ্ধিজীবীদের প্রেমে মন্ড থাকতে এবং অনেক সময় এই প্রেম বিছানা অবধিও গড়াতো। সে সময়কার জনপ্রিয় বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে যাদের নাম না বললেই নয় তারা হলেন, সার্জ, কাম্য, বোভোয়ার, লেভিনাসসহ আরও অনেক মুক্তিকামী মানুষ যারা একে অপরের বন্ধু হয়ে উঠেছিল খুব সহজেই এবং যাদের লাইফ স্টাইল থেকেই তৎকালীন সময়ে ‘পার্টি লাইক এক্সিস্টেনশিয়ালিস্টস’ শব্দটার ব্যাপক প্রচলন শুরু হয়।
বোভোয়ার মুলত নিজেকে একজন অস্তিত্ববাদী হিসেবেই দেখতে চেয়েছেন এবং অন্যদেও থেকে নিজের ভাবনাকে
আলাদা ভাবার জায়গাটিও ব্যাখ্যা করেছেন অত্যন্ত সুক্ষ্মভাবেই। সেই সূত্র ধরেই এবার, বোভোয়ার অস্তিত্ববাদী নারীবাদ সম্পর্কে সংক্ষেপে জানা যাক-
মুলত বিংশ শতাব্দীর শুরুতে ‘অস্তিত্ববাদৎ ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে। আত্মবোধ, কর্ম, দায়িত্ব এবং আত্মমুক্তি এই চারটি বৈশিষ্ট্য নিয়েই মুলত অস্তিত্ববাদ তার যাত্রা শুরু করে। মানুষ যখন নিষ্ক্রিয়তার দর্শন থেকে নয়, কর্মের দর্শন থেকে নিজের অস্তিত্ব বা নিজের কর্মপন্থার সন্ধান করে এবং নিজের সিদ্ধান্ত মোতাবেক নিজেকে নির্মাণ করে তখন তাকে অজিতুবাদ বলে। মানুষ অক্তিত্বশীল হয় তার নির্বাচনের স্বাধীনতা ও কর্মের স্বাধীনতার মাধ্যমে।
নিজ এবং অপরের মধ্যে সংঘাত হলেই মুলত অস্তিত্ববাদের আবির্ভাব ঘটে। কেননা সংঘাত এবং দম্বের মাধ্যমে অবশ্যই একটি পক্ষ পরাজিত হবে এবং নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার প্রশ্নটি সামনে চলে আসবে। আমাদের সমাজের দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যায়, নারী ও পুরুষের মধ্যেকার দম্মটিও কিছুান একইরকম। নারীর উপর পুরুষের আধিপত্যই মূলত এই অস্তিত্ববাদের সাথে নারীবাদের একটি গুরুত্বপূর্ণ সম্পর্কের জন্ম দিয়েছে।
বোভোয়ার বলেছেন, ‘নারীদের পুরো ইতিহাস নির্মাণ করেছে পুরুষ। আমেরিকায় যেমন শুধু কৃষ্ণাঙ্গদের সমস্যা বলে কিছু নেই, বরং তা মূলত শ্বেতাঙ্গদের সমস্যা। এন্টি-সেমিটিজম যেমন শুধু ইহুদিদের সমস্যা না, আমাদের সমস্যা তেমনি নারী-সমস্যা সবসময় আসলে পুরুষের সমস্যা।
“নারীদের পুরো ইতিহাস নির্মাণ করেছে পুরুষ। আমেরিকায় যেমন শুধু কৃষ্ণাঙ্গদের সমস্যা বলে কিছু নেই, বরং তা মুলত শ্বেতাঙ্গদের সমস্যা: এন্টি-সেমিটিজম যেমন শুধু ইহুদিদের সমস্যা না, আমাদের সমস্যা তেমনি নারী-সমস্যা সবসময় আসলে পুরুষের সমস্যা।”
সাত্রের অস্তিত্ববাদী দর্শন-এর আদলে গদ্য রচনা করতে যেয়ে বোভোয়া যখন উপলব্ধি করেন যে, গদ্য লেখার আগে নারীবাদের অবস্থানটা ঠিকঠাকভাবে ব্যাখ্যা করাটা জরুরি তখন, ১৯৪৬ থেকে ১৯৪৯ সাল পর্যন্ত প্রচুর পড়াশোনা ও গবেষণা করে তিনি লিখলেন এখন অবধি সবচেয়ে বিতর্কিত, বিখ্যাত এবং জনপ্রিয় বই, ‘দ্য সেকেন্ড সেক্স’। এ বইতে তিনি লেখেন, “I am awfuly greedy: I want everything from life. I want to be a woman and to be a man, to have many friends and to have loneliness, to work much and write good books, to travel and enjoy myself, to be selfish and to be unselfish You see, it is difficult to get all which I want. And then when I do not succeed I get mad with anger”
তিনি বলেন, ‘একজন পুরুষ নিজেকে নারীর সাথে যুক্ত করে- তাকে উপভোগ করার জন্য নয়, বরং নিজেকে উপভোগ করার জন্য।”
এই বইটিতে তিনি মূলত নারীবাদ সম্পর্কে তার ব্যক্তিগত অবস্থান যেমন স্পষ্ট করেছেন তেমনি বইটিতে তিনি লিঙ্গ বৈষম্যের ঐতিহাসিক ও মনস্তাত্ত্বিক ভিত্তিগুলো ব্যাখ্যা করেন।
সিমন দ্য বোভোয়ারকে যারা নারীবাদী হিসেবেই বেশি জানেন, তাদের অনেকেরেই ধারণা বোভোয়া হয়তো খুব নির্দয় এবং নারী পুরুষের ভালোবাসার প্রতি তার এক ধরনের অবহেলা রয়েছে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে বোভোয়ার নোকান নারী চরিত্রই ভালোবাসাহীন নয়, নারীবাদী দর্শনের কারণেই পাঠককে কিছু ক্ষেত্রে এমন দ্বিধায় পড়তে হয়। বোভোয়ার এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘ভালোবাসা একটা বড় প্রিভিলেজ। প্রকৃত ভালোবাসা, যেটা খুবই দুর্লভ, পুরুষ-নারীর জীবনকে খুব উর্বর করে তুলতে পারে যদি তারা ওই ভালোবাসাটা উপভোগ করতে পারে।”
সে যাই হোক, ১৯৫৪ সালে বোভোয়া প্রকাশ করেন তার আত্মজীবনী মুলক গ্রন্থ, ‘দি মান্ডারিন’। বইটিতে তিনি তার জীবনের নানান উত্থানপতন এবং সার্জের সাথে তার সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা করেন যা তাকে এনে দেয় ব্যাপক জনপ্রিয়তা। ১৯৭৯ সালে প্রগতিশীল নারীদের জীবন নিয়ে লেখেন, ‘দ্য থিংস অব দি স্পিরিট কাম ফার্স্ট’। তার লেখা উপন্যাস ‘লা সেং ডেস অট্রিস’ অবলম্বনে ১৯৮২ সালে ক্লাউদে চারবলের পরিচালনায় নির্মিত হয় পুরস্কারপ্রাপ্ত চলচ্চিত্র ‘হেলেন’। এই উপন্যাসটির পটভূমি ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আসন্ন অনাগত ভবিষ্যতের কথা। ১৯৮১ সালে এত্রের জীবনের শেষ বছরগুলোর স্মৃতি নিয়ে প্রকাশ করেন ‘এ ফেয়ারওয়েল টু সার্জ’। ১৯৮৬ সালের ১৪ এপ্রিল নারীবাদী এই নারী নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মারা যান। মৃত্যুর পর সিমোন দ্য বোভোয়ারকে কবর দেওয়া হয় প্যারিসের সিমেটর ডু মোন্টপ্যারানেসে তাঁর আজীবন বন্ধু জ্যাঁ পল সার্জের সমাধির ঠিক পাশেই।
আর এভাবেই সমাপ্তি ঘটে এক বর্ণাঢ্য কর্মময় জীবনের অধিকারী এক নারীর, যিনি আজীবন অস্তিত্ববাদী হিসেবে লিখে গেছেন ন্যায়ের পক্ষে, অধিকারের পক্ষে এবং দার্শনিক ও সাহিত্যিক হিসেবে যিনি জীবন আজও বেঁচে আছেন বিশ্ববাসীর হৃদয়ে।