তাহারেই পড়ে মনে!

‘কুহেলী উত্তরী তলে মাঘের সন্ন্যাসী-
গিয়াছে চলিয়া ধীরে পুষ্প-শূন্য দিগন্তের পথে
রিক্ত হস্তে।
তাহারেই পড়ে মনে, ভুলিতে পারি না কোন মতে।’
‘তাহারেই পড়ে মনে’- কথাটি শুনলেই যে মানুষটার কথা সবার মনে পড়ে, তিনি সবার প্রিয় কবি সুফিয়া কামাল। কবিতাটির মধ্য দিয়ে নিজের অনুভূতি কত সহজেই না তিনি প্রকাশ করেছে। বাংলাদেশের নারী জাগরণের অগ্রদূত কবি সুফিয়া কামালের ১১১তম জন্মদিন আজ।
সুফিয়া কামাল অত্যন্ত রক্ষণশীল পরিবারে বড় হয়েও দেশমাতৃকা, গণ-মানুষ, সমাজ ও সংস্কৃতির সংকট নিয়ে প্রতিনিয়ত ভাবতেন। তিনি আজীবন মানবতা ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের পক্ষে ছিলেন এখন মুক্তবুদ্ধির চর্চার পাশাপাশি সাম্প্রদায়িকতা ও অন্যায়,দুর্নীতি ও অমানবিকতার বিপক্ষে একজন সোচ্চার সমাজসেবী ও নারী নেত্রী ছিলেন। তিনি বিভিন্ন আন্দোলন সংগ্রামে সক্রিয় সাহসী ভূমিকা রেখেছেন।

১৯১১ সালের ২০ জুন বরিশালের শায়েস্তাবাদে একটি অভিজাত পরিবারে সুফিয়া কামাল জন্মগ্রহণ করেন। তার পরিবারে সেই সময় নারী শিক্ষাকে প্রয়োজনীয় মনে করা হতো না। সুফিয়া কামাল মৃত্যুর আগ পর্যন্ত রাজনীতিবিদ, সাহিত্যিক ও সমাজকর্মীদের অনুপ্রেরণা যুগিয়েছেন। সাহিত্যে তার সৃজনশীলতা ছিল অবিস্মরণীয়। বাংলার মানুষ তাকে ‘জননী সাহসিকতা’ উপাধিতে ভূষিত করে।
কবি সুফিয়া কামাল নারীবাদী নেত্রী হিসেবেও ব্যাপক পরিচিত। তিনি ১৯৫৬ সালে ‘কচিকাঁচার মেলা’ প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৬১ সালে ছায়ানটের সভাপতি, ১৯৬৯ সালে গণ-আন্দোলনের সময় মহিলা সংগ্রাম কমিটির সভাপতি, ১৯৭০ সালে মহিলা পরিষদ গঠন এবং ওই সময় অসহযোগ আন্দোলনে নারী সমাজের নেতৃত্ব দেন। রাজপথে-জনপদে হেঁটে নারীমুক্তির মশাল প্রজ্বালনের পাশাপাশি দেশমাতৃকার মুক্তির গানও গেয়েছেন নির্ভীক কণ্ঠে। একাত্তরের মার্চ মাসের অসহযোগ আন্দোলনে ঢাকায় নারী সমাবেশ ও মিছিলে নেতৃত্ব দিয়ে, ধানমন্ডির নিজ বাড়িতে অবস্থান করে মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য-সহযোগিতা করে, পাকিস্তানের পক্ষে স্বাক্ষর দান প্রস্তাবের বিরোধিতা করে তিনি তার মুক্তিসংগ্রামি–সত্তার প্রকাশ ঘটিয়েছেন। ১৯৭১ সালের ১৭ নভেম্বর তার জ্যেষ্ঠ জামাতা আবদুল কাহহার চৌধুরী শহীদ হন। তবু শোকে ভেঙে পড়েননি তিনি।

শিশুতোষ রচনাসহ দেশ, প্রকৃতি, গণতন্ত্র, সমাহ সংস্কার এবং নারী মুক্তিসহ বিভিন্ন বিষয়ে তার লেখা আজও প্রতিটি পাঠককে অনুপ্রাণিত করে। তার প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থগুলো হলো ‘সাঁঝের মায়া’, ‘মায়া কাজল’, ‘মন ও জীবন’, ‘শান্তি ও প্রার্থনা’, ‘উদাত্ত পৃথিবী’, ‘দিওয়ান’, ‘মোর জাদুদের সমাধি পরে’ প্রভৃতি। এছাড়া লিখেছেন, গল্পগ্রন্থ ‘কেয়ার কাটা’, ভ্রমণকাহিনী ‘সোভিয়েত দিনগুলি’, স্মৃতিকথা ‘একাত্তরের ডায়েরি’।
সাহিত্য ও অন্যান্য ক্ষেত্রে অবদানের জন্য কবি সুফিয়া কামাল প্রায় ৫০টি পুরস্কার লাভ করেন। বাংলা একাডেমী সাহিত্য পুরস্কার (১৯৬২), লেনিন পদক (১৯৭০, সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে), একুশে পদক (১৯৭৬), নাসিরউদ্দিন স্বর্ণপদক (১৯৯৫) ও স্বাধীনতা দিবস পদক। ১৯৬৬ সালে পাকিস্তান সরকার কবি সুফিয়া কামালকে ‘তমসা-ই-ইমতিয়াজ’ পুরস্কার দেওয়ার ঘোষণা দিলে তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন।
১৯৯৯ সালের ২০ নভেম্বর এই মহীয়সী নারী ঢাকায় মারা যান। নারী জাগরণে ভূমিকা রাখা কবি সুফিয়া কামালের জন্মদিনে তার প্রতি রইলো বিনম্র শ্রদ্ধা।
অনন্যা/জেএজে