বর্তমান বিশ্বে স্তন ক্যান্সারের ভয়াবহতা ও প্রতিরোধ
বর্তমান বিশ্বে স্তন ক্যান্সার একটি উল্লেখযোগ্য জনস্বাস্থ্য সমস্যা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। নারীদের মধ্যে এটি সবচেয়ে সাধারণ ক্যান্সার এবং এর কারণে প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ মানুষকে জীবনযুদ্ধে অবতীর্ণ হতে হয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) মতে, প্রতি আটজন নারীর মধ্যে একজন তার জীবদ্দশায় স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে থাকে। কেবলমাত্র নারী নয়, পুরুষদের মধ্যেও স্তন ক্যান্সার দেখা যায়, যদিও তা অপেক্ষাকৃত বিরল। তবু এর ভয়াবহতা ক্রমশ বাড়ছে, এবং সঠিক সময়ে রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসা না পেলে এটি মৃত্যুর কারণ হতে পারে।
স্তন ক্যান্সারের প্রভাব:
স্তন ক্যান্সার বৈশ্বিকভাবে একটি বড় স্বাস্থ্য সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। গ্লোবোক্যানের তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সালে প্রায় ২.৩ মিলিয়ন নতুন স্তন ক্যান্সারের ঘটনা নথিভুক্ত হয়েছে এবং প্রায় ৬৮৫,০০০ মানুষ এই রোগে মারা গেছে। এর মানে হলো স্তন ক্যান্সার কেবল মহিলাদের জীবনকেই নয়, গোটা সমাজকে প্রভাবিত করছে। উন্নত দেশগুলিতে স্তন ক্যান্সারের নির্ণয় এবং চিকিৎসার সুযোগ উন্নত হওয়ায় মৃত্যুর হার কিছুটা কম হলেও, নিম্ন আয়ের এবং উন্নয়নশীল দেশগুলোতে মৃত্যুর হার আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে চলেছে। কারণ সেখানে সচেতনতার অভাব, চিকিৎসার সঠিক সুযোগের অভাব এবং সময়মতো রোগ নির্ণয়ের অভাব বিদ্যমান।
স্তন ক্যান্সারের কারণ এবং ঝুঁকি
স্তন ক্যান্সারের নির্দিষ্ট কারণ এখনও পুরোপুরি স্পষ্ট নয়। তবে কিছু ঝুঁকি উপাদান স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকি বৃদ্ধি করে। এদের মধ্যে বয়স, পারিবারিক ইতিহাস, হরমোনাল ফ্যাক্টর, অতিরিক্ত ওজন, এবং অস্বাস্থ্যকর জীবনযাপন উল্লেখযোগ্য। বয়স বৃদ্ধির সাথে স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকিও বৃদ্ধি পায়, এবং যাদের পরিবারের কারও স্তন ক্যান্সার হয়েছে তাদের ক্ষেত্রে ঝুঁকি আরও বেশি। পাশাপাশি, জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে হরমোনাল পরিবর্তন যেমন মাসিকের আগে বা পরে ইস্ট্রোজেনের মাত্রা বৃদ্ধিও স্তন ক্যান্সারের কারণ হতে পারে।
অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস এবং শারীরিক কার্যকলাপের অভাবও স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়। মদ্যপান, ধূমপান, এবং মানসিক চাপ স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকি আরও বাড়ায়। উন্নত দেশগুলোতে জীবনযাত্রার ধরন, বিশেষ করে ফাস্ট ফুডের ওপর নির্ভরশীলতা এবং স্থূলতার মাত্রা স্তন ক্যান্সারের হার বৃদ্ধির অন্যতম কারণ।
উন্নয়নশীল দেশে স্তন ক্যান্সারের অবস্থা
উন্নয়নশীল দেশগুলোতে স্তন ক্যান্সার একটি গুরুতর স্বাস্থ্য সমস্যা। নিম্ন আয়ের দেশগুলোতে চিকিৎসার অপ্রতুলতা, সামাজিক মানসিকতা এবং সচেতনতার অভাবের কারণে প্রাথমিক পর্যায়ে রোগ নির্ণয় করা যায় না। এ কারণে ক্যান্সার ধরা পড়তে দেরি হয় এবং মৃত্যুর হার বেড়ে যায়। অনেক দেশেই নারীরা স্তন ক্যান্সার নিয়ে খোলাখুলি আলোচনা করতে দ্বিধা বোধ করেন, ফলে প্রাথমিক অবস্থায় চিকিৎসা পাওয়া সম্ভব হয় না। এমনকি চিকিৎসা ব্যবস্থা থাকলেও, অর্থনৈতিক অক্ষমতা, চিকিৎসা ব্যয়ভার এবং সামাজিক লজ্জা অনেক নারীর জন্য বাধা হয়ে দাঁড়ায়।
সচেতনতা এবং প্রাথমিক রোগ নির্ণয়
স্তন ক্যান্সারের মতো রোগ প্রতিরোধ এবং এর দ্রুত নির্ণয় করতে পারলে রোগীকে চিকিৎসা করানো সহজ এবং জীবনরক্ষার সম্ভাবনা বেশি থাকে। এ কারণে স্তন ক্যান্সার নিয়ে সচেতনতা বাড়ানো অত্যন্ত জরুরি। নিজে স্তন পরীক্ষা (Breast Self-Examination – BSE) এবং চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী নিয়মিত স্ক্রিনিং করানো খুবই গুরুত্বপূর্ণ। উন্নত দেশগুলোতে নারীদের মধ্যে এই সচেতনতা বাড়াতে নানা ধরনের প্রচারাভিযান পরিচালিত হচ্ছে, যা উল্লেখযোগ্য ফলাফল দিয়েছে।
ম্যামোগ্রাফি এবং আল্ট্রাসনোগ্রাফির মাধ্যমে স্তন ক্যান্সার প্রাথমিক অবস্থায় শনাক্ত করা সম্ভব, যা রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসা ক্ষেত্রে বিশাল পরিবর্তন আনতে পারে। এক্ষেত্রে, দ্রুত নির্ণয় এবং তাত্ক্ষণিক চিকিৎসা শুরু করা রোগীর সুস্থতার সম্ভাবনা বাড়ায়।
নিজেকে পরীক্ষা করার গুরুত্ব
প্রতি মাসে নিয়মিতভাবে নারীদের নিজেদের স্তন পরীক্ষা করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটি প্রাথমিক পর্যায়ে কোনো অস্বাভাবিকতা শনাক্ত করতে সহায়তা করে। ৪০ বছরের বেশি বয়সী নারীদের নিয়মিত ম্যামোগ্রাম করানো উচিত, কারণ এই বয়সের পর স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকি উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পায়। এছাড়া সঠিক খাদ্যাভ্যাস, নিয়মিত ব্যায়াম এবং স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকি হ্রাস করতে সাহায্য করে।
আধুনিক চিকিৎসা পদ্ধতি এবং চ্যালেঞ্জ
বর্তমানে স্তন ক্যান্সারের চিকিৎসায় আধুনিক বিজ্ঞান অনেক দূর এগিয়েছে। অস্ত্রোপচার, কেমোথেরাপি, রেডিওথেরাপি, এবং ইমিউনোথেরাপির মতো বিভিন্ন চিকিৎসা পদ্ধতি সফলভাবে প্রয়োগ করা হচ্ছে। তবে চিকিৎসা ব্যয় অনেক ক্ষেত্রেই অত্যধিক বেশি হওয়ায় সব শ্রেণির মানুষ এই চিকিৎসার সুযোগ নিতে পারেন না। বিশেষত, উন্নয়নশীল দেশগুলোতে চিকিৎসার ব্যয় অনেকেই বহন করতে পারেন না। এছাড়া, অনেক ক্ষেত্রে রোগীদের মানসিক চাপ এবং সামাজিক অবহেলা সহ্য করতে হয়, যা তাদের চিকিৎসার প্রক্রিয়াকে আরও জটিল করে তোলে।
বিশ্বজুড়ে স্তন ক্যান্সারের ভয়াবহতা একটি বাস্তবতা যা উন্নত এবং উন্নয়নশীল দেশ উভয়কেই প্রভাবিত করছে। সঠিক সময়ে সচেতনতা বৃদ্ধি, প্রাথমিক নির্ণয় এবং চিকিৎসার সুযোগ বাড়ানোর মাধ্যমে এই রোগের ভয়াবহতা কমানো সম্ভব। স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান, সরকার এবং সমাজের প্রতিটি স্তর থেকে যৌথ প্রচেষ্টার মাধ্যমেই কেবল স্তন ক্যান্সারের বিরুদ্ধে সফলভাবে লড়াই করা যাবে। রোগ নির্ণয়ের উন্নত প্রযুক্তি এবং সাশ্রয়ী চিকিৎসা ব্যবস্থা যদি সহজলভ্য হয়, তবে এই রোগের প্রভাব কমানো এবং অসংখ্য জীবন রক্ষা করা সম্ভব।