সাবেকিয়ানায় ঈদের গৃহসজ্জা

ঈদ—একটি অনুভূতির নাম। মাসব্যাপী সংযম ও আত্মশুদ্ধির পর আসে খুশির এই উৎসব। নতুন জামা, মিষ্টি খাবার, আত্মীয়-বন্ধুর পদচারণা, আর সেই সঙ্গে ঘরজুড়ে যেন থাকে তাজা ফুলের ঘ্রাণ, পরিচ্ছন্নতা ও সৌন্দর্যের স্পর্শ। আধুনিক জীবনের চাপে আমরা প্রায়শই ভুলে যাই আমাদের শেকড়, ভুলে যাই সেই মাটির ঘরের কোমল ছায়া, কাঁসার থালা, নকশিকাঁথা বিছানো খাট, বা বাঁশের চালার নিঃশব্দ মাধুর্য। ঈদের এই সাজ-পোশাকে তাই যদি থাকে একটু সাবেকি ছোঁয়া, তবে ঘরের আনন্দ যেন আরও আপন হয়ে ওঠে।

ঈদ মানেই শুরু পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতায়
ঈদের ঘর সাজানো শুরু হয় ধুয়ে-মুছে ঝকঝকে করে তোলার কাজ দিয়ে। ঘরের প্রতিটি কোণ, জানালার কার্নিশ, দরজার ওপরের মেঝে—সবকিছুকে যেন নতুন প্রাণ দেওয়া। বিশেষ করে কাঠের আসবাবগুলোকে পরিষ্কার করে তেল বা পলিশ করলে পুরনো জিনিসও যেন আবার জ্বলে ওঠে নতুন আলোয়। ধুয়ে ফেলা হয় কুশন, পর্দা, বিছানার চাদর—আর এর মধ্য দিয়েই ঘরের আভ্যন্তরীণ রূপান্তরের সূচনা।
সাবেকি সাজের মূল কথা—উপকরণে শেকড়ের টান
একটি সাবেকি ঘর সাজাতে প্রথমেই ভাবতে হবে উপকরণের কথা। কাঠ, বাঁশ, মাটি, কাঁসা বা পিতল—এইসব উপাদান যেন একেকটি গল্প বলে আমাদের ইতিহাসের।
খাটে যদি থাকে খোদাই কাজ, বা কাঠের হ্যান্ডক্র্যাফটেড টেবিল, তবে ঘরের মধ্যেই চলে আসে এক ধরনের শিল্পভাবনা।
বাঁশের তৈরি আলমারি বা ঝুলন্ত তাক ঘরের দেওয়ালে ঝুলিয়ে দিলে সাজের মাঝে আসে শৈল্পিকতা।
কাঁসার বড় থালা, পিতলের গ্লাস, আর মাটির কলসি শুধু প্রদর্শনের জন্য রাখলেও ঘরে এক ধরণের নস্টালজিয়া ভর করে।
পর্দা, কুশনে নকশিকাঁথার ছোঁয়া
ঘরের রঙ বদলাতে চাইলেই দেয়াল পাল্টাতে হয় না—শুধু পর্দা ও কুশনে কিছু কারু কাজ থাকলেই হয়। লাল-মেরুন, সোনালী-মটকা, নীল-হলুদ কিংবা মাটি রঙের হাতের কাজ করা কাপড় ঘরের পরিবেশকেই বদলে দেয়। নকশিকাঁথার নকশায় পুরনো দিনের গল্প, ফুল-লতা, মাছ-চাঁদ—এসব ফুটে উঠলে ঈদের সাজ হয়ে ওঠে ঘরোয়া আর ঐতিহ্যময়।
আলোয় আলোয় তুলে ধরা যায়
একটি ঘরের মুড তৈরি হয় আলো দিয়ে। ঈদের রাতে যদি ঘরে থাকে হালকা হলুদ আলো, ঝুলন্ত লণ্ঠনের মতো লাইট, ছোট ছোট ক্যান্ডেল হোল্ডার, তবে একেবারে অন্য রকম এক পরিবেশ তৈরি হয়। প্লাস্টিকের আধুনিক ঝাড়বাতির বদলে পুরনো দিনের ধাঁচে পিতলের বাতি বা কাপড় মোড়ানো ল্যাম্পশেডও দিতে পারে উষ্ণ এক শৈলী।
মাটির সৌন্দর্যে প্রাণ
একটা মাটির হাঁড়ি, লালচে রঙের মাটির প্রদীপ, ছোট্ট মাটির পুতুল—এসব খুব সাধারণ জিনিস হলেও সাবেকি ঘরের সাজে এগুলোর প্রভাব অসাধারণ। বসার ঘরের মাঝখানে রাখা যেতে পারে কাঁসার বাটিতে শোভা পায় এমন শুকনা ফুল বা পানির ওপর ভাসানো পাঁপড়ি। কাগজে মোড়ানো হাতে আঁকা চিত্র বা পুরনো হস্তশিল্পের পণ্য দেয়ালে টাঙিয়ে রাখলেও ঘরের রুচি ফুটে ওঠে।
ঘ্রাণে থাকুক প্রাকৃতিক মমতা
ঈদের সকালে ঘরজুড়ে সুগন্ধ থাকলে মনে হয় স্বর্গীয় শান্তি। আগরবাতি, ধূপ, কিংবা প্রাকৃতিক পদ্ধতিতে তৈরি করা ঘ্রাণ—যেমন লবঙ্গ, দারচিনি, লেবু পাতার মিশ্রণে বানানো ঘরোয়া রুম ফ্রেশনার—এইসব ব্যবহার করে ঘরের বাতাসে আনা যায় এক রকম পবিত্রতা ও প্রশান্তি।
ডাইনিং-এ ঐতিহ্য
ঈদের দিন খাবার ঘরও তো সাজে ভালবাসা দিয়ে। টেবিলের মাঝখানে রাখা কাঁসার বড় থালা, মাটির সানকি বা হাতের আঁকা পাত্র—এসবেই বোঝা যায় অতিথি আপ্যায়নের আন্তরিকতা। ফ্রিজে রাখা শিরনি আর কাচ্চির গন্ধ ঘরে ছড়িয়ে পড়লে তা শুধু জিভে নয়, মনে-মনেও দোলা দেয়।
ঈদের সাজ হোক চোখের আনন্দ আর মনের শান্তির সমন্বয়। আধুনিকতার দাপটে যখন চারপাশে প্লাস্টিক, গ্লাস আর মেটালের ভিড়, তখন একটি কোণ যদি সাবেকি ছোঁয়ায় সেজে ওঠে, তবে তা শুধু আলাদা হয় না—তা হয়ে ওঠে স্মৃতির ঘর। সেই ঘরে মা-খালাদের গল্প, নানুর হাতের আঁচল, বা দাদার ধ্যানস্থ চেহারা—সব যেন নতুন করে ফিরে আসে।
ঈদে শুধু মানুষ নয়, ঘরও যেন নতুন করে আনন্দ পায়। আর সেই আনন্দ যদি আসে আমাদের মাটির কাছাকাছি থেকে, তবে তা নিঃসন্দেহে হয় অনেক গভীর ও স্থায়ী।