সন্তানকে ব্যস্ত রাখুন নান্দনিক কাজে
একটি সত্য ঘটনা দিয়েই শুরু করি। তাতে বিষয়টির গুরুত্ব ভালভাবে বোধগম্য হবে। আমার খালামণি একটি মেয়ে সন্তানের মা। তাদের দাম্পত্য জীবনের অনেক বছর পর একটিমাত্র সন্তান তারা লাভ করেন। সেও বহু ত্যাগ সাধনা আর পরিশ্রমের পর! তিনি স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরে বেশ ভাল পদে চাকুরি করতেন। সেই সুবাদে স্বামী স্ত্রী দুজনেরই ব্যস্ততার কারণে সন্তানকে খুব একটা সময় দিতে পারতেন না। আমাদের বাসা তাদের কাছাকাছি হওয়ায় আমার বোনটি আমাদের কাছেই থাকতো। বিকেলে অফিস শেষ করে ওকে ওর বাবা বাসায় নিয়ে যেত। ভেবে দেখুন, সময় এখানে খুব গুরুত্বপূর্ণ। দেখতে দেখতে সেই বাবুটি এখন ক্লাস থ্রীতে পড়ে। কিন্তু এখন আমি কি বলতে যাচ্ছি এ ব্যাপারে কারও কোনো ধারণা আছে? হয়তো নেই, মেয়েটি তার দ্বিতীয় সাময়িক পরীক্ষায় গণিতে ১০০ তে মাত্র ২৩ পেয়েছিল! স্বাভাবিক ভাবেই বাসায় তাকে যথেষ্ট হেনস্তা হতে হয়েছে! স্কুলের প্রথম হওয়া মেয়েটার সাথে নিয়মিত তুলনা তো রয়েছেই! সাথে মারধর তো কিছু আছেই! কিন্তু বিশ্বাস করবেন, এর কোনোটাই ঘটেনি! কেন? কারণ, এতোকিছুর ভয়ে সে গণিত খাতাই বাসায় আনেনি, বাবা মা কে দেখায়নি! বাসায় মিথ্যে বলে খাতা নিজেই জমা দিয়েছে। তাহলে খাতা জমা দেওয়ার সময় গার্ডিয়ানের স্বাক্ষর সে কোথায় পেল? ঠিক এই মুহুর্তে ভেবে দেখুন পাঠক, এতোগুলা ভুলের দায় কে নিবে? এখানে কার দোষ? আপনি কোনটাকে অপরাধ হিসেবে দেখবেন?
আসলে সত্যি কথা বলতে, আমাদের সমাজে এই পেরেন্টিং বিষয়টি খুবই অস্বচ্ছ, অপ্রয়োজনীয় এবং গুরুত্বহীন! আপনারা বাচ্চার জন্ম দিয়েছেন মানেই সেই বাচ্চার উপর আপনাদের সমস্ত অধিকার লিখিত, সেটি হোক সঙ্গত কিংবা অসঙ্গত! এখানে এই বিষয়টি ভেবে দেখার কেউ নেই যে, সে বাচ্চাটি একটি মানুষ এবং জন্ম নেওয়া মাত্রই সে আপনার সম অধিকার নিয়েই জন্মেছে। বাবা মা হিসেবে আপনি তার একটি সুন্দর ভবিষ্যৎ চাইবেন এটাই সত্য, কিন্তু ভেবে দেখুন সেই ভবিষ্যতের বলি আপনি নিজেই হননি তো? আপনার সন্তান আপনাকেই এড়িয়ে যাচ্ছে না তো? আপনাকে সে শ্রদ্বা নয়, ভয় করে না তো? এখানে ভয় শব্দটি কল্পনাতীত গুরুত্বপূর্ণ। কেন? কারণ, এই ভয়ের কারণেই বাচ্চা মেয়েটি তার বাবা মা কে মিথ্যে বলেছে, প্রথম অন্যায়। দ্বিতীয়ত, সে বাবা মার স্বাক্ষর নকল করে শিক্ষককে মিথ্যে বলেছে। এখন, আপনিই বলুন, কে এই অন্যায়গুলোর জন্যে দায়ী? হ্যা পাঠক, বাবা-মা, আপনার ব্যবহার, আপনার সাথে আপনার সন্তানের সম্পর্কই নির্ধারণ করে দিবে, সে কোন পথে হাঁটবে এবং কেমন মানসিকতা গ্রহণ করবে! একটি চিরন্তন সত্য কথা বলি আপনাদের, বাচ্চারা কখনই আপনি যা বলবেন তা করবেনা, ওরা তাই করবে যা আপনি করেন। এটাই প্রকৃতির বেঁধে দেওয়া নিয়ম।
এবারে চলুন, আসা যাক, মূল আলোচ্য বিষয়ে, আপনার প্রিয় সন্তানটিকে কি করে আপনার প্রতি শ্রদ্ধাশীল, বিশ্বস্ত এবং আগ্রহী করে তুলবেন। এ ব্যাপারে আমার একান্ত মতামত আপনাদের সাথে শেয়ার করতে চাই, আর তা হল, খুজু্ঁন, দেখুন, অবলোকন করুন, আপনার সন্তান কিসে আগ্রহী! তার কি ভালো লাগে! কোথায় তার মেধা! কি করতে সে ভালোবাসে! একটা ব্যাপার কি জানেন? বিশ্বাসে ভালোবাসা মেলায়! যখন আপনি কারও মূল্যায়ন করবেন, তখন সেই মানুষটিও আপনার মূল্যায়ন করবে! হোক সে আপনার সন্তান বা আপনার বাবা-মা!
দীর্ঘদিন থেকে আমরা সবাই লকডাউন পরস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। এটাই সময়, আপনার শিশুটিকে সময় দিন। এমন হতে পারে, আপনার শিশুটি ছবি আঁকতে ভালোবাসে। হয়তো সেখানেই তার ভবিষ্যত লুকিয়ে আছে! সেটা সময় সাপেক্ষে দীর্ঘ হতে পারে! কিন্তু তলিয়ে যেতে দেবেন না! তাকে উৎসাহ দিন, নতুন রং কিনে দিন, তার মনটাও রঙিন হোক! হতে পারে আপনার ছেলেটি নাচতে পছন্দ করে, সুযোগ পেলেই শিবলীর ক্লাসিক কিংবা মাইকেলের মুনওয়াক নকল করে সে আপন মনেই! তাকে দমিয়ে দেবেনা না! জেনে রাখুন, আপনার সমস্ত চাওয়া পাওয়া নির্দেশ আদেশের ভিড়ে ওখানেই সে নিঃশ্বাস ফেলতে পারে! ওটাই তার স্বস্তি! কিংবা যদি আপনার মেয়েটি খেলতে ভালোবাসে, ব্যাডমিন্টন কিংবা ক্রিকেট, পরিস্থিতি আবার স্বাভাবিক খেলতে দিন! হয়তো সমাজে এসবের মূল্যায়ন কম! তাই বলে কি আপনিও সমাজের তালে তাল দেবেন? সন্তান তো আপনারই! তার সুখের জন্যেই তো এতোকিছু! তবে তার ভালোলাগাকে কেন এতো আপত্তিকর মনে হবে? সেটাও আপন করে নিন না! তাকে শেখান, তাকে বুঝতে দিন, আপনি তার জন্যে সমাজকে একপাশে রাখতে পারেন, প্রতিদান আপনি নিজেই দেখতে পাবেন! অযথা তাকে ডাক্তার কিংবা ইঞ্জিনিয়ার বানানোর চেষ্টা করে তার জীবনটা বিষিয়ে তুলবেন না! কারণ, তার ব্যর্থতার ভার স্বয়ং আপনিই নিতে চাইবেন না, সমাজের তো প্রশ্নই ওঠে না! ঐ শিশুটি তখন তিলে তিলে হতাশাগ্রস্ত হয়ে ঝুকে পড়বে এমন কোনোদিকে যা আপনি পিতামাতা হিসেবে কোনোদিনই চাইবেন না! নিশ্চই বুঝতে পারছেন, আমি কিসের কথা বলছি!
মাদকাসক্তির এবং আত্মহত্যার প্রবণতা বৃদ্ধি পাওয়ার জন্যে এই মানসিক হতাশা গুলোই ৯০ শতাংশ দায়ী! ঘটনাগুলোর ক্ষেত্রে বেশিরভাগই এমন হয় যে, সে কাউকে বিশ্বাস করতে ভয় পায়, চরম আত্ম অসন্তুষ্টি এবং হীনম্মন্যতায় ভোগে যা সে কাউকে বলতে পারে না! ধীরে ধীরে সেই ক্ষোভগুলো জমা হতে থাকে এবং বিস্ফোরণের মাত্রা ও ধরণ হয় ভয়াবহ! এমন ঘটনা খুব কম নয়! একটু চোখ কান খোলা রাখলেই সচেতন হওয়া সম্ভব।
এবারে আসুন আলোচনা করা যাক, শুরুটা কিভাবে এবং কোথা থেকে করবেন? এক্ষেত্রে আরেকটি ঘটনা বলি, আমার একটি স্টুডেন্ট আছে যাকে আমি ড্রইং শেখাই, বাসায় গিয়ে। তো সে প্রথম প্রথম খুব লাজুক হলেও এখন আমাকে তার সব কথা এসে বলে। একদিন আমি তাকে জিজ্ঞেস করি, তোমার ছবি আঁকতে কেমন লাগে? সে বলে, মিস ভালো লাগে। তখন আমি বলি, তাহলে তোমার ছবি আকাঁর প্রতিটা আচঁড়ে আমি এতো অবহেলা খুঁজে পাই কেন? সে অবাক এবং নিরুত্তর হয়ে একবার আমার দিকে তাকায়, একবার নিচের দিকে তাকিয়ে মাথা হেট করে বসে থাকে। তখন আমি জিজ্ঞেস করি, আমাকে বলো তো তোমার কি করতে ভালো লাগে? আমি কাউকে বলবো না! তখন সে চারপাশে তাকিয়ে আমাকে বলে, মিস আমার শুধু ক্রিকেট খেলতে ভালো লাগে! আমি ক্লাস ফাঁকি দিয়ে মাঠে খেলতে যাই! শুনে আমি অবাক! কারণ কি জানেন? ব্যাপারটা বেশ মজার এবং একইসাথে দুঃখজনক! আমার স্টুডেন্টের মা আমাকে প্রথমদিন বলেছিলেন, উনার ছবি আকঁতে ভালো লাগতো কিন্তু উনি উনার পরিবার থেকে সমর্থন না পাওয়ায় শিখতে পারেননি! তাই তিনি চান, তার ছেলেটা যেন একটু ছবি আঁকা শিখতে পারে! অথচ ছেলে ভালোবাসে ক্রিকেট! এমনকি ছেলেটা তার মাকে অনুরোধ করেছিল যেন বিপিএলের ফাইনাল ম্যাচটা দেখাতে উনি ওকে মিরপুর স্টেডিয়ামে নিয়ে যায়! কিন্তু উনি মানা করে দেন! প্রিয় পাঠক, কিছু কি বুঝতে পারছেন? আমরা ভুলটাই করি শুরুতে, নিজের আকাঙ্খা বা ব্যর্থতাগুলো সন্তানের মাধ্যমে পূরণ করতে চাই! কিন্তু সন্তান যে জন্মই নিয়েছে অন্য সাধ বুকে নিয়ে সেটি অগোচরে চাপা পড়ে যায়! সেজন্যে কি করা উচিত? আপনার শিশুটিকে নিয়ে খেলা দেখতে যান, চিত্রকলা প্রদর্শনী কিংবা গানের আসরে নিয়ে যান। দেখুন, কোথায় সে সবচেয়ে উল্লসিত হয়! দেখুন সে ক্লাসের খাতার পেছনে দু চারটে কবিতা লেখে বা ছবি আঁকে কি না! দেখুন ওর প্রিয় বন্ধু বা শিক্ষক কে সে নিজের ব্যাপারে কিছু বলছে কিনা! আপনি শুধু পাশে থাকুন, সাহস দিন, শুরুটা সে নিজেই করবে!
সন্তানের ভালোবাসার প্রকাশ একটি চরম আনন্দের অনুভূতি! যদি আমাকে জিজ্ঞেস করেন, তাহলে আমি বলবো, অল্টার ব্রিজ ব্যান্ডের ভোকালিস্ট মাইলস কেনেডি, তাঁর মায়ের মৃত্যুর পর একটি গান লিখেছিলেন। যেটি তুমুল জনপ্রিয় একটি বিখ্যাত গান। গানটির জনপ্রিয়তার কারণ এর লিরিক্স! গানটি হল, In Loving Memory। গানটি শুনে দেখবেন পাঠক, ভালোবাসার প্রকাশ কতটা মধুর, চমৎকার এবং অসাধারণ হতে পারে তা নিজেই উপলব্ধি করতে পারবেন! কতটা ভালোবাসা আপনার সন্তান আপনার জন্যে তার ছোট্ট বুকে লালন করে সেটি আপনি অনুধাবন করতে পারবেন। আর এই ভালোবাসার বিনিময়ে হলেও আপনার উচিত তাকে তার ভালোলাগার পথে হাঁটতে দেয়া। সে তো আপনার অস্তিত্বেরই এক নতুন সংস্করণ!