ফসিল আবিষ্কারের অগ্রদূত ম্যারি এনিং: অবহেলাই ছিল যার সঙ্গী
ম্যারি এনিং এর জন্ম ১৭৯৯ সালে। ইংলিশ কাউন্টি ডোরসেটের দক্ষিণ-পশ্চিম প্রান্তে লাইম রেজিসে। বর্তমান জুরাসিক উপকূলের মধ্যেই লাইম রেজিস নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছে। এখনো তাতে প্রাগৈতিহাসিক যুগের কতশত আবিষ্কার লুকিয়ে আছে, আমাদের জানা নেই।
ম্যারির শৈশবে তৃতীয় জর্জ ইংল্যান্ডের রাজসিংহাসনে আসীন। নেপোলিয়নের সৈন্যবহরের সঙ্গে ব্রিটিশরা প্রাণপণ যুদ্ধে মত্ত। জেন অস্টেন এই সময়েই লিখেছেন ‘সেন্স অ্যান্ড সেন্সিবিলিটি’ নামে একটি অসাধারণ বই।
এমন উত্তাল সময়ে ম্যারির বেড়ে ওঠা। পুরো পরিবার ছিল প্রটেস্ট্যান্ট। তথাকথিত ইংল্যান্ডের চার্চের সঙ্গে তাদের পরিবারের সংযোগ ছিল অনেক কম। পরিবারের আর্থিক দৈন্যদশা কাটার কোনো লক্ষণ ছিল না। সেজন্যে ম্যারির জীবনটা ঠিক গৌরবোজ্জ্বল স্বপ্নের আকাঙ্ক্ষার বদলে রুটিরুজির চিন্তায় ছেয়ে ছিল একদম ছোটবেলা থেকেই।
আঠারো শতকে শিশু-মৃত্যুহার ছিল ভয়াবহ। ম্যারির নিজের দশ ভাই বোন ছিলেন। এই দশজনের মধ্যে শুধু বড় ভাই আর ম্যারি বাদে কেউ জীবিত ছিলেন না।
ম্যারির বাবা পেশায় মূলত একজন ক্যাবিনেট কারিগর ছিলেন। এছাড়া তিনি শখ করে ফসিল সংগ্রহ করতেন। ম্যারির বয়স যখন পাঁচ কী সাত, বাবা আরেকজন সহকারী খুঁজে পেলেন; যাকে ঠিক বেতন দিতে হতো না। এই সহকারীকে শুধু ঘুরতে নিয়ে গেলেই হলো। যেকোনো জর্জিয়ান মেয়ের জন্যে কাজটি খুব আকর্ষণীয় কিছু নয়। তবে ম্যারি যেন এই কাজে আনন্দ খুঁজে পেয়েছিলেন।
![](https://a.kha.icu/wp-content/uploads/2022/05/15-10-1024x576.jpg)
রিচার্ড মেয়ের আগ্রহ দেখে ফসিল সম্পর্কে শেখাতে শুরু করেন। সমুদ্রসৈকতে কুড়িয়ে পাওয়া ফসিল কিভাবে পরিষ্কার করতে হয়, তা দেখানোর সময় ম্যারির চোখেমুখের আনন্দ স্পষ্ট আকৃতি পেতে শুরু করেছিল যেন। অধিকাংশ সময়েই এ সব ফসিল তারা নিজস্ব দোকানে বিক্রি করতেন।
ওই সময়ের অন্যান্য আর নারীর মতো ম্যারিও খুব বেশিদূর লেখাপড়া শিখতে পারেননি। তবে যথেষ্ট অক্ষরজ্ঞান হয়েছিল তার। নিজের এই আগ্রহকে চাঙা করে তুলতেই তিনি ভূগোল ও এনাটমি বিষয়ে অনেক বই পড়েন।
১৮১০ সালে নানা শারীরিক আঘাত ও কলেরায় আক্রান্ত হয়ে বাবা মারা যান। বড় ভাই জোফেস এ সময় আপহোলস্টারারিতে শিক্ষানবিশের কাজ জুটিয়ে নেন। আর মা মলি মেয়েকে কোনোরকম বাধায় আটকে রাখতে চাননি। খুব ছোটবেলা থেকেই মেয়েকে তেমন কিছুই দিতে পারেননি। এখন দায়িত্বের বোঝা চাপিয়ে দেওয়া মানে মেয়ের একমাত্র আনন্দের জায়গাটিও নষ্ট করে ফেলা। বরং এই শখকেই তিনি পুঁজি করতে পরামর্শ দেন। ম্যারির আবিষ্কার করা ফসিল বিক্রি করে নিজেদের দেনাগুলো তো চুকিয়ে ফেলা যাবে।
লাইম রেজিসে বিপুল সংখ্যক এমোনাইটস খুঁজে পাওয়া যেতো। এই ফসিলকে অনেকে এমোনের শিং বলে অভিহিত করেন। এছাড়া বেলেমনাইটস (বা শয়তানের আঙুল) এরও অভাব ছিল না। নেপোলিয়ানের সময় যুদ্ধাবস্থায় মানুষ ঘুরতে গেলে বেশিদূর যেতো না। এজন্যে লাইম রেজিসের মতো স্থানেও অনেক পর্যটকের দেখা মিলতো।
এই সময়েই ফসিল খোঁজার মতো কাজ যেন প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পরিগ্রহ করতে শুরু করেছিল। ফ্যাশনসচেতন জর্জিয়ানরা ক্যাবিনেটে সাজিয়ে রাখার জন্যে ফসিলকে একটু প্রাধান্য দিতে শুরু করেছিলেন।
![](https://a.kha.icu/wp-content/uploads/2022/05/16-10-1024x576.jpg)
১৮১১ সালে ম্যারির বয়স মাত্র ১২। বড়ভাই জোসেফ অদ্ভুতাকৃতির ফসিল হয়ে যাওয়া এক খুলির সন্ধান পায়। ম্যারি এই খুলি দেখে আগ্রহী হয়ে ওঠে এবং প্রচণ্ড পরিশ্রমের পর মাটি খুঁড়ে ৫.২ মিটার লম্বা কঙ্কালই উদ্ধার করেন। কাজটি করতেও তার মাসখানেক সময় লেগে যায়। কঙ্কালের আকৃতিটুকু দেখেই ম্যারি নিশ্চিত ছিলেন এটি কোনো স্বাভাবিক প্রাণী নয়।
স্থানীয় অনেক বিজ্ঞানী ধারণা করলেন, এটি একটি কুমিরের দেহাবসান। ওই সময় অপরিচিত প্রাণী দেখলে মানুষ ধরে নিতো দূর অপরিচিত কোনো অঞ্চল থেকে নতুন কোনো প্রাণী হয়তো তাদের অঞ্চলে চলে এসেছিল। জর্জ কুভিয়ের তখন সদ্য প্যালেওটোলজি প্রতিষ্ঠা করেছেন। থিওরি অব এক্সটিংশন সদ্য নতুন একটি বিষয়। এমনকি চার্লস ডারউইন আরো ৪৮ বছর পর অরিজিন অব স্পিসিজ রচনা করবেন।
এই অদ্ভুতদর্শন প্রাণীর কঙ্কাল নিয়ে বেশ কয়েক বছর নানা তর্ক-বিতর্ক চললো। অবশেষে একে ইচথায়োসর (ফিশ লিজার্ড) নাম দেওয়া হলো। যদিও এখন আমরা জানি, এটি না মাছ, না গিরগিটি। বরং এক ধরনের সামুদ্রিক সরীসৃপ। প্রায় ২০১-১৯৪ মিলিয়ন বছর আগে এই প্রাণী পৃথিবীর বুকে বিচরণ করতো।
সবে তো ম্যারির কাজ শুরু। ১৮২৩ সালে ম্যারি সর্বপ্রথম প্লেসিওসরাস (সরীসৃপের কাছাকাছি) এর কঙ্কাল আবিষ্কার করেন। ফসিলটি এতটাই অদ্ভুত ছিল যে দূর দূরান্তে খবর পৌঁছে গিয়েছিল। এমনকি ফসিলটি নকল বলেও অনেকে ধারণা করেছিলেন।
জর্জ কুভিয়ার এবার এই আবিষ্কার নিয়ে প্রথমেই অবিশ্বাসী হয়ে উঠলেন। লন্ডন জিওলজিক্যাল সোসাইটিতে তিনি একটি বিশেষ আলোচনা সভার আয়োজন করেন যদিও সেখানে ম্যারিকে ডাকা হয়নি। দীর্ঘ তর্ক বিতর্ক শেষে নিজের ভুল স্বীকার করতে বাধ্য হন তিনি।
ম্যারি ততদিনে ফসিলের জগতে নাম কুড়িয়ে ফেলেছেন। তবুও বৈজ্ঞানিক মহল তার কৃতিত্বকে স্বীকৃতি দিতে দোনোমোনা করছিলেন। ম্যারির সযত্নে আবিষ্কার করা ফসিলগুলো অনেক পুরুষ বৈজ্ঞানিক নিজের ব্যাপারে ব্যবহার করলেও ম্যারির নাম উল্লেখ করতেন না। এমনকি ইচথায়োসরের আবিষ্কারের পরেও তাকে অবহেলাই করা হয়।
লন্ডন জিওলজিক্যাল সোসাইটিও ব্যতিক্রম ছিল না। ১৯০৪ সালের আগ পর্যন্ত তারা নারীদের কৃতিত্ব স্বীকার করতে নারাজ ছিল। ম্যারি অবশ্য তাতে দমে যাননি। ১৯২৮ সালের মে মাসে ম্যারি আবার এক অদ্ভুত হাড়ের দলা আবিষ্কার করেন। এবার একটি লম্বা লেজ আর একটা পাখার কঙ্কাল। লন্ডন থেকে প্যারিসের বিজ্ঞানীরা চমকে উঠলেন। সরীসৃপ প্রজাতির মধ্যে সবচেয়ে অদ্ভুত বলে রায় দেন অনেকে।
![](https://a.kha.icu/wp-content/uploads/2022/05/15-11-1024x576.jpg)
এই প্রাণীটির নাম রাখা হয় ডিমোরফোডোন। পরে অবশ্য নাম বদলে টেরোড্যাক্টাইল দেওয়া হয়। জার্মানির বাইরে সর্বপ্রথম টেরোসরের অস্থি ছিল এটিই। ম্যারি একের পর এক ফসিল আবিষ্কার করছেন। এর অনেকগুলোই তিনি বিক্রি করতেন। আর তার এই প্রচেষ্টায় ভূগোল ও প্যালেওটোনলজিতে মানুষে আগ্রহ যেন বেড়েই চলেছিল। মানুষ ফসিল খুঁজে পেলেই তা সংগ্রহ করতে শুরু করে। এমনকি জাদুঘরগুলোও ফসিলের চাহিদা মেটাতে পারছিল না।
ম্যারির আবিষ্কারগুলোই হ্যানরি দ্য লে বেঁচেকে ‘ডুরিয়া এন্টিকোরের’ মতো চিত্রকর্ম আঁকার অনুপ্রেরণা দেয়। হ্যানরি এই ছবির প্রিন্ট বিক্রি করে ম্যারির জন্যে আর্থিক সহায়তার ব্যবস্থা করেছিলেন। এত সাফল্যের পরেও ম্যারি দৈন্যদশা কাটেনি।
সারাজীবন শুধু বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানেই কাটিয়েছেন। পুরোটাই ছিল তার জন্যে আনন্দের। কিন্তু আর্থিক দুরবস্থা তার কাটেনি। মাত্র ৪৭ বছর বয়সে অর্থাৎ ১৮৪৭ সালে ম্যারি স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। আজ ন্যাশনাল মিউজিয়ামে গেলে ম্যারির অনেক চমকপ্রদ আবিষ্কার নিজ চোখে দেখার সুযোগ মিলবে। দুই শতক আগের আবিষ্কার, এখনো মানুষকে রোমাঞ্চিত করে। কিন্তু ম্যারির প্রতি যে অনাদর, সে বিষয়ে এখনো তেমন কথা শুনতে পাওয়া যায় না।
অনন্যা/ এআই