একলা বা দোকলা থাকার সিদ্ধান্ত একান্তই নারীর
খুব সাজগোজ করে এক ছোটবোনের বিয়েতে গেলেন। একসময় পরিচয়কালে এক মুরুব্বি আপনাকে জিজ্ঞেস করে বসলেন, তুমি একা এসেছো? হাজবেন্ড নেই সঙ্গে? আপনি যে অবিবাহিত এটা শোনার পরে তার অবাক হওয়া প্রশ্ন, বিয়ের পাত্রী তো তোমার ছোট, তার বিয়ে হচ্ছে অথচ তুমি বিয়ে করেনি। আপনার মনটাই দমে গেলো, বিয়ের আনন্দটাই মাটি হয়ে গেলো।
একটা নির্দিষ্ট বয়সের পর যেই মেয়ে বা নারীটি একা, সে সঙ্গী ছাড়া বা অবিবাহিত থাকবে- তাকে অসংখ্য কথা বিশেষত কটুকথা শুনতে হবে। প্রশ্ন তৈরি হয় অনেক কি এমন সমস্যা যে ২৫ বা ৩০ বছরের বেশি বয়সে একটি মেয়ে এমন একা জীবন কাটাচ্ছে, তাহলে নিশ্চয়ই কোনো কঠিন সমস্যা রয়েছে, জীবনে হয়ত বড় কোনো দুর্ঘটনা ঘটেছে, তা না হলে কেন একা থাকার সিদ্ধান্ত?
একটা সময় নারীরা ছিল ঘরমুখী। কিন্তু এখন তার স্বভাব ও ধারণার পরিবর্তন ঘটেছে। তারা শিক্ষা গ্রহণ করছে। কেবল প্রাথমিক শিক্ষাই নয়, তারা উচ্চতর ডিগ্রিও লাভ করছে। চাকরিও করছে উচ্চপদে। ফলে তাদের রুটি, মন-মেজাজেরও পরিবর্তন ঘটছে। শিক্ষার সঙ্গে সঙ্গে তাদের জ্ঞানচক্ষুও খুলে যাচ্ছে। তারা নিজেকে চিনছে, সমাজ চিনছে। চিনছে পারিপার্শ্বও। এমনকি তারা নারীর শক্রমিত্রও এখন সহজে শনাক্ত করতে পারছে। ফলে জীবন-যাপনের বড় পরিবর্তনগুলো মধ্যে যৌথজীবন ও একাকী জীবনের ধারণায়ও এসেছে পরিবর্তন। এখন নারীরা কারও গলগ্রহ হয়ে পড়ে থাকে না, থাকতেও চায় না। অনেক ক্ষেত্রে তাদের আত্মজাগরণ-আত্মশক্তির উন্মেষ ঘটছে। ফলে তারা যৌথ জীবনের চেয়ে একাকী জীবনকে শ্রেয় মনে করছে। থাকছে একা।
আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, নারীর জীবনচেতনার সঙ্গে সমাজ-চিন্তারও পরিবর্তন ঘটছে। আগে নারীরা বাবা-ভাই- স্বামীর ওপর বেশি নির্ভরশীল ছিল। কিন্তু এখন শিক্ষাকে কেন্দ্র করে নারীর জানের পরিধি বেড়েছে। ফলে তারা অনায়াসে শুন্যে-মন্দ বুঝতে সক্ষম হচ্ছে। এ কারণে তারা আত্মনির্ভরশীল হয়ে উঠছে। নারীর এই আত্মনির্ভরশীলতাকে কেন্দ্র করে নিজের কাজের জন্য অন্যের দ্বারস্থ হওয়ার প্রয়োজন হচ্ছে না। ফলে তারা নিজের জীবনকে নিজের মতো করে গুছিয়ে নিচ্ছে। এই গুছিয়ে নেওয়ার পক্ষে নারীরা নিজেদের কল্যাণকে বেশি প্রাধান্য দিচ্ছেন। ফলে তারা অনেক সময় প্রায় ঝামেলাহীন জীবনযাপনে অভ্যন্ত হয়ে উঠছে। সঙ্গীকে কেন্দ্র করে নারীকে সব সময় নিজেকে সমর্পণ করতে হয়। এই সমর্পণের সুযোগে নারীর ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয় অনেক বিধিনিষেধ। এ কারণে বর্তমান শিক্ষিত নারীরা বাইরের থেকে চাপিয়ে দেওয়া বিষয়ে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতে পারছে না।
যাই হোক না কেন, একটা মেয়ে একা থাকবে নাকি স্বামী সন্তান নিয়ে সুখে থাকবে সেটা নিতান্তই ব্যক্তিগত। সুযোগের অভাব কিংবা সমস্য- যেকোনো কারণেই বর্তমান সময়ে অনেক নারীই একা থাকছে, বিশেষ করে যারা সাবলম্বী। বিয়ে না করে বা বিচ্ছেদ করে যেভাবেই হোক একা থাকা সমাজের কাছে একটু যেন কেমনই।
একা নারীদের কর্মক্ষেত্রে অনেক বিব্রতকর পরিস্থিতির মুখে পড়তে হয়। অনেক বিবাহিত বা অবিবাহিত পুরুষ সহকর্মীই কখনো কখনো নেতিবাচক ব্যবহার শুরু করে। অহেতুক মজা করার ছলে উল্টোপাল্টা কথা বলা, খোচাখুঁচি করে অনেক সময়েই। আপনার তো বিয়েই হয়নি, একা থাকতে কষ্ট হয় বোধহয় এমন কথা প্রায়ই হাসির ছলে বলে বসে তারা। নারী সহকর্মীরাও কথা প্রসঙ্গে খোচা মারতে ছাড় দেয়না। ‘ম্যাডাম, অমুকেরও তো গতমাসে বিয়ে হয়ে গেলো। আপনার থেকেও তো জুনিয়র, তাহলে আপনি কেন শুধু শুধুই বসে আছেন’। এমন কথা শুনতে কারোই ভালো লাগার কথা নয়।
আত্মীয়, প্রতিবেশী এবং বন্ধুবান্ধবেরা মেয়ে বা মেয়ের বাবা-মাকে বলতেই থাকবে আসলে মেয়েটির সমস্যা কি। আড়ালে হয়ত বলাবলি করবে, মেয়েটার সমস্যা কি। সম্পর্কও যদি থেকে থাকে তো বিয়ে করে নিতে সমস্যা কি। নাকি সমস্যা অন্য জায়গায়?
একা থাকা মানে একাকিত্ব বা নিঃসঙ্গতা নয়। বরং নারীর নিজেকে প্রাধান্য দেওয়াই এর মূল। আগে নারীরা নিজের ভেবেও দেখতো না। এই কদিন আগেই কিছুটা পরিবর্তন এসেছে। তবে তখন কেবল রূপচর্চা আর সমানাধিকার নিয়ে তারা কথা বলতে শুরু করেছিল। কিন্তু তারা এখন আনচর্চা- জীবনচর্চাকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। জ্ঞানের জগৎ নারীকে নিজের শক্তি সম্পর্কে সচেতন করে তুলেছে। নারী এখন আর কারো মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে চায় না। তার একার ঘরেই প্রদীপ শিখার মতো জ্বলছে জ্ঞানের আলো। এখন প্রশ্ন উঠছে, শুধু কি শিক্ষিত নারীই একা থাকাতে বেশি পছন্দ করছে? না। শিক্ষিত, অশিক্ষিত বা অর্ধশিক্ষিত নারীও জীবনকে অন্য দৃষ্টিতে দেখছে। শুধু শিক্ষিত হয়ে নিজের জীবনের ভার নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছে, এমন নয়; গ্রামের অনেক মেয়ে বিভিন্নভাবে জীবিকা নির্বাহ করে নিজেকে আত্মনির্ভরশীল করেও তুলছেন। বাবা বা স্বামীর বোঝা হয়ে এখন তারা খাকতে নারাজ।
একটা মেয়ে একা, অবিবাহিত, সম্পর্কে ব্যর্থ বা ডিভোর্সি, তাকে আশপাশ থেকে বিভিন্ন কথা শুনতেই হয়। তোমার সম্পর্ক আছে তো বিয়ে করছো না কেন, সম্পর্ক নেই তো বাবামায়ের পছন্দে বিয়ে করছো না কেন, সম্পর্ক নষ্ট হয়েছে তো নতুন করে জীবন শুরু করো, বিবাহবিচ্ছেদ হয়েছে তো আবার নতুন করে সংসার করে এমন হাজারো পরামর্শ হাসিমুখেই মেনে নিতে হয়। প্রতিবাদ করা যায় না। উল্টো কিছু বলতে গেলে অভদ্রের খাতায় নাম উঠে যায়। প্রশ্ন আসতে থাকে যে এত বয়সে কোনো সমস্যা না থাকলে কোনো মেয়ে কি এমন একা জীবন বেছে নেয় নাকি?
সমস্যা বলতে সেটা চারিত্রিক কোনো সমস্যা হতে পারে।যেমন জীবনকে যেভাবে খুশি সেভাবে চালাচ্ছে, পূর্ণ স্বাধীনতা পাচ্ছে, অন্যদের সঙ্গে হেসেখেলে জীবন কাটাচ্ছে- এজন্যই বোধহয় বিয়ের নাম মুখে নিচ্ছে না। এছাড়া অনেক গুজবও রটিয়ে দেওয়া হয় তার নামের সঙ্গে। নারীর একা থাকার পেছনে ভারমুক্ত জীবনযাপন যেমন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে, তেমনই জবাবদিহিতার কাঠগড়ায় দাঁড়ানোর দায় থেকেও মুক্ত থাকার বিষয়টি বেশ গুরুত্ব পাচ্ছে। আজকের নারীরা এতটাই স্বাধীনচেতা যে, তারা অন্যের কাছে মাথা নত করাকে আত্মহননের শামিল মনে করছে। জবাবদিহিতা করাকেও তাদের কাছে অনেকটা। বিরক্তিকর মনে হচ্ছে। তাই যে কোনো ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা বা অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হওয়ার আগেই তারা সে পথই মাড়াতে চায় না আর।
একা বা দোকা থাকা সম্পূর্ণ নিজস্ব ব্যাপার হওয়া উচিৎ। পরিবার এবং আশপাশ বলবে প্রতিটা মানুষেরই একজন সঙ্গী লাগে। যে সুখে-দুঃখে পাশে থাকবে। পরিবার থেকে বলবে অমুক তো তোমার মতো একা থাকছে না, সবার তো নিরাপত্তা আছে, আশ্রয় আছে। তোমার সংসার প্রয়োজন, সন্তান ধারণের বয়স পার হয়ে যাচ্ছে সেটা বুঝেও তুমি একা থাকছো কেন?
এমনকি একা মেয়ে সাবলেটে থাকলেও সেটা খারাপ
চোখে দেখা হয়। একা মেয়ে চাকরি করলেও সেটা খারাপ, ঘরে বসে থাকলেও সেটা কেমন যেন খারাপ দেখায়। রাত করে বাড়িতে ফেরা খারাপ। কোনো আচার অনুষ্ঠানে গেলে কেমন বাঁকা চোখে তাকাবেই। এই এতো কথা, এতো প্রশ্নের মাঝখানে একা থাকা কঠিন। সমাজকে প্রতিদিন, প্রতিনিয়ত মোকাবেলা করাটা কঠিনতর।
কিন্তু একা মানেই খারাপ কিছু নয়। অনেকেই একা থাকতে পছন্দ করেন। কিন্তু জীবন প্রকৃতির নিয়মে। চলে। একটা বয়সে গিয়ে তো একা থাকার চিন্তাটা বাদ দিতে হয়। কিন্তু এখন তো দিন পাল্টেছে। মেয়েরা আগের চেয়ে চিন্তায় স্বাধীন হয়েছে, পড়ালেখায় এগিয়েছে, সাবলম্বী হয়েছে। এজন্য বেড়েছে একা থাকার প্রবণতা, বিবাহবিচ্ছেদের মতো ঘটনা। একা থাকাটাকে অন্যভাবে বা ব্যক্তিগত সমস্যাকে কারণ হিসেবে নিয়ে খারাপের কাতারে ফেলা সমীচীন নয়।