ভানুমতী: নেপথ্যেই যার ভাঙা-গড়া
কুরু রাজবংশের রাজা ধৃতরাষ্ট্রের ঔরসে এবং সুবলন্যা গান্ধারীর গর্ভে শত পুত্রেরজন্ম হয়। এদের মধ্যে জ্যেষ্ঠ ও শ্রেষ্ঠ দুর্যোধন। মহাভারতের যুদ্ধে দুর্যোধনই ছিল কৌরবদের নেতা। বাল্যকাল থেকেই দুর্যোধন নিয়ামক, প্রভুত্বশালী, আদেশদাতা হিসেবে প্রসিদ্ধ। তার আত্মম্ভরিতার ফলস্বরূপ কোথাও হেরে যাওয়াকে মেনে নিতে পারতো না দুর্যোধন। দ্রৌপদীর স্বয়ংবরেও সে দৃশ্য পরিলক্ষিত হয়। কম্বোজের রাজা চন্দ্রবর্মা যখন তার কন্যা ভানুমতীর স্বয়ংবরের আয়োজন করে সেখানে শিশুপাল, কর্ণ, দুর্যোধনের সঙ্গে আরও রাজকুমার উপস্থিত হয়। ভানুমতী নিজ পছন্দ অনুযায়ী জীবন সঙ্গী নির্বাচন করার পক্ষে। ফলে দাসীর সঙ্গে স্বয়ংবরে উপস্থিত হয়ে সবার সম্মুখেই মালা হাতে দর্শন করে। কিন্তু দুর্যোধনের সম্মুখ ত্যাগ করতেই দুর্যোধন বল খাঁটিয়ে ভানুমতীর হাতে মালা পরে। দুর্যোধনের এই অনমনীয় আচরণে সভাস্থ সব রাজা যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। একপর্যায়ে দুর্যোধনের সম্মতিক্রমে কর্ণ সবাইকে পরাজিত করে ভানুমতীকে হস্তিনাপুর রাজ্যে আনে।
দুর্যোধনের বাহুবলের কাছে ভানুমতী নিজেকে সঁপে দেয়। দুর্যোধন যখন ভীষ্মের পূর্ব কাহিনী বর্ণনা করে। বিচিত্রবীর্যের জন্য অম্বা, অম্বালিকাকে স্বয়ংবর থেকে জিতে ফেরে। ভানুমতীও নিজেকে দুর্যোধনের চরণদাসীতে পরিণত করে। মহাভারতে দুর্যোধনের উপস্থিতি আদ্যোপান্ত। পাণ্ডবদের সঙ্গে যুদ্ধ থেকে সর্বত্রই দুর্যোধনের হম্বিতম্বি। কিন্তু যেই দুর্যোধন ভানুমতীকে স্বয়ংবর থেকে জোর করেই স্ত্রীরূপে স্বীকার করে তবুও কোথাও স্পষ্টরূপে দেখা মেলে না। দ্রৌপদী যেমন পঞ্চ পাণ্ডবদের সঙ্গী এবং পরামর্শদাতা বিপরীতদিকে ভানুমতীর প্রবেশ অন্ধকার। আলোর মুখ ভানুমতী চরিত্রটিতে স্পষ্ট নয়। ভানুমতীর গর্ভে দুর্যোধনের ঔরসে একটি পুত্র ও এক পুত্রীর জন্ম হয়। পুত্র লক্ষ্মণ এবং পুত্রী লক্ষ্মণা। মহাভারতের যুদ্ধে অভিমন্যুর হাতে বীরগতি প্রাপ্ত হয় লক্ষ্মণের। আর কন্যা লক্ষ্মণার বিয়ে হয় কৃষ্ণ পুত্র শাম্বের সঙ্গে। ঘটনা পরম্পরায় ভানুমতীকে কিছুটা দেখানো হলেও আড়াল- আবডালে। চরিত্রটিতে কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন ব্যাসদেব কেন বিস্তৃত করতে চাননি সেটাই প্রশ্ন! জীবনসঙ্গী হিসেবেও দুর্যোধন কখনও ভানুমতীকে সেভাবে মান-মর্যাদা দিয়ে পাশাপাশি অবস্থান করেনি। এক্ষেত্রেও পুরুষতন্ত্রের জয়জয়কার দেখা যায়। ব্যাসদেবের মুখ্য উদ্দেশ্যই ছিল মহাভারতের যুদ্ধ। ফলে চরিত্র নির্মাণে তিনি কার্পণ্য করেছেন। যেই চরিত্র যতটা প্রস্ফুটিত হওয়ার কথা তাকে সেভাবে তুলেই ধরেননি। তাই ভানুমতী যেন নেপথ্যেরই ভেঙেছে -গড়েছে।
সন্তানের মৃত্যুর পর মায়ের হাহাকার আকাশ বিদরী কিন্তু সেখানেও কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন নীরব, নিশ্চুপ। এমনকি দুর্যোধনের মৃত্যুর পর তার অবস্থান কেমন, কোথায় গেল ভানুমতী, তার কী হলো সেগুলোরও কোনই উত্তর পাওয়া যায় না। ভানুমতী থেকে গেছে নেপথ্যে। কিন্তু তার দুঃখ- না পাওয়া তো সাধারণের। সেখানেও লেখকের উদাসীনতা।
প্রচলিত আছে ভানুমতীর সঙ্গে কর্ণের মিত্র ভাব ছিল। এবং সেই মিত্রভাবের জন্য একসঙ্গে সতরঞ্জি খেলতেও দেখা গেছে। একদিন হঠাৎ সতরঞ্জি খেলার সময় দুর্যোধন এসে উপস্থিত হয় এবং ভানুমতী দ্রুত উঠে দাঁড়ায়। বিষয়টি কর্ণের অগোচর হওয়ায় সে ভানুমতীকে হাত ধরেই খেলায় বসাতে চেষ্টা করে। এসময় মতির মালায় টান পড়ে ছিড়ে যায়। কিন্তু ভানুমতী ও কর্ণের প্রতি প্রবল বিশ্বাসের ফলে দুর্যোধন বিষয়টা নিয়ে ভাবারও চেষ্টা করেনি। মহাভারতের কাহিনী নিয়ে বহুকথা প্রচলিত। কিন্তু এসব নিয়ে সঠিক তথ্যের যথেষ্ট ঘাটতি আছে। তবে যদি সেটাই হয় তবুও ভানুমতী চরিত্র নির্মাণে লেখকের উদাসীনতা, নিষ্ঠুরতার ছোঁয়া পাওয়া যায়। তার শোকবিহ্বল ছবিও লেখক তুলে ধরেননি।এত নিষ্ঠুর, নির্মম মৃত্যু দুর্যোধনের তারপর ভানুমতীর জীবন কীরূপ হলো তা জানার আগ্রহ পাঠকের থেকেই যায়। কিন্তু ভানুমতী চরিত্রের নেপথ্যে ভাঙা – গড়াই মুখ্য হয়েছে। কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন যুদ্ধকে ফোকাস করতে গিয়ে কাহিনীর সাধারণ আকর্ষণ, কষ্ট -দুঃখ, পাওয়া, না পাওয়ার হিসেব মেলাননি। ফলে কুন্তী, সুভদ্রা, উত্তরাদের উপস্থিতি যতটা এসেছে ঠিক ততটাও বিচরণ নেই ভানুমতীর!