ডরোথি হপকিন্স: ইনসুলিন আবিষ্কারের গল্প
বিজ্ঞানে অবদান রাখার জন্যে যে কতিপয় নারী নোবেল পুরষ্কার লাভ করেছেন তাদের মধ্যে ডরোথি হপকিন্স উল্লেখযোগ্য। ১৯৬৪ সালে রসায়নে নোবেল পুরষ্কার পাওয়ার পর সমগ্র বিশ্ব তার দিকে মনোযোগ ফেরায়। ব্যক্তিগত জীবনে সাফল্য যেমন তাকে ধরা দিয়েছিলো তেমনই নানা বাধাবিঘ্নও তাকে জর্জরিত করে রেখেছিলো। আর্থ্রাইটিসে আক্রান্ত হওয়ার পরেও নিজের গবেষণা চালিয়ে গিয়েছিলেন।
পাশ্চাত্য নাগরিক হলেও ডরোথির জীবনের বিশাল একটি সময় কেটেছে প্রাচ্যে। ১৯১০ সালের ১২ মে ডরোথি কায়রোতে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা জন উইন্টার ক্রোফুট মিশরীয় শিক্ষাব্যবস্থায় কাজ করছিলেন। তবে দ্রুতই কাজের জন্যে তাকে সুদানে স্থানান্তরিত হয়। আর সুদানে এসেই ডরোথির জীবনে কিছুটা পরিবর্তন আসতে শুরু করে। তবে বাবার সাথে তখনই সেখানে যাওয়া হয়নি। ১৯২৩ সালে সুদানে গিয়েই দেশটিকে ভালো লেগে গিয়েছিলো তার। তবে বাবা ১৯২৬ সালে অবসর নিয়ে ব্রিটেনে ফিরে আসেন। ফিরে অবসর সময়ে প্রত্নতত্ত্ব নিয়ে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। এ সময় জেরুজালেমে ব্রিটিশ স্কুল অব আর্কেওলজিতে ব্যস্ত সময় কাটান।
![](https://a.kha.icu/wp-content/uploads/2022/05/7-3-1024x576.jpg)
এ ব্যস্ত সময় একা কাটাননি অবশ্যই। স্ত্রী গ্রেস ম্যারি ক্রোফুট সাহায্য করতেন। তবে স্বামীর ছায়ার আড়ালে যেতে হয়নি। এই ক্ষেত্রে নিজ যোগ্যতায় একজন বিশেষজ্ঞ হয়ে ওঠেন। এছাড়াও গ্রেস একজন ভালো বোটানিস্ট ছিলেন। সুদানের ফুলের বিভিন্ন ইলাস্ট্রেশন এঁকেছেন সময় পেলেই।
ছোটবেলা থেকেই ডরোথি তাই বাবা মায়ের সাথে অনেক জায়গায় ঘুরে বেড়িয়েছেন। তবে সুদানই তাকে সবচেয়ে বেশি আনন্দ দিয়েছে। তবে রসায়নেই তার এত আগ্রহ এত কেন? মাত্র দশ বছর বয়সে ডরোথি তার বাবার বন্ধু ডক্টর এ এফ জোসেফের সাথে পরিচিত হন। জোসেফ তাকে রসায়ন এবং ক্রিস্টাল বিষয়ে আগ্রহী করে তোলেন।
ছোটবেলা থেকেই ডরোথি স্বাধীনচেতা হয়ে উঠছিলেন। এক্ষেত্রে মায়ের অবদানও ভোলা সম্ভব না। প্রতিটি কাজেই মায়ের অনুমতি ছিলো। ষোল বছর বয়সে জন্মদিনে স্যার উইলিয়াম হেনরি ব্র্যাগস এর “কন্সার্নিং দ্য ন্যাচার অব থিংস” বইটি উপহার হিসেবে দেন। এই বইটিও তাকে বেশ প্রভাবিত করেছিলো।
![](https://a.kha.icu/wp-content/uploads/2022/05/3-3-1024x576.jpg)
সময়ে সময়ে জোসেফ তাকে টুকিটাকি গবেষনার জন্যে ক্যামিকেল সরবরাহ করতেন৷ বিশেষত ইলমেনাইট এর গঠন পর্যবেক্ষণেই ব্যস্ত থাকতেন বেশি। নরফোকেই প্রাথমিক শিক্ষা শেষে তিনি ভাবলেন বিশ্ববিদ্যালয়ে রসায়ন নিয়ে লেখাপড়া করবেন। ভর্তি হলেন অক্সফোর্ড এবং সমারভিল কলেজে। সেখানে শিক্ষকদের অনুপ্রেরণায় রসায়নে অধ্যয়ন করতে থাকেন।
অবশ্য রসায়নের পাশাপাশি প্রত্নতত্ত্ব নিয়েও লেখাপড়া চালিয়ে যাচ্ছিলেন। সেকেন্ড ইয়ারে ক্রিস্টালোগ্রাফির উপর একটি বিশেষ কোর্সে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। এ সময় অনেক মানুষের সাথেই তার পরিচয় ঘটে এবং শিক্ষাজীবনে কখনো সমস্যায় পড়তে হয়নি। ক্যামব্রিজে পড়তে যাওয়ার সময় আন্টি ডরোথি উডই তার ব্যায়ভার গ্রহণ করেছিলেন।
বিশ শতকে এক্সরে এবং ক্যামিকেল সায়েন্সের আমূল বদলের অন্যতম সারথি হয়ে ওঠার গল্পটা শুরু হবে আরো পরে। অবশ্য সময়টার কথাও বিবেচনা করতে হবে। বিশ্বের সকল পরাশক্তিই যুদ্ধ আর বিধ্বংসে যোগ দিতে শুরু করেছে। আধুনিক জীববিজ্ঞান এসময়ই রূপ পেতে শুরু করে। পদার্থবিজ্ঞান, গণিত, রসায়ন, এক্সরে ক্রিস্টালোগ্রাফি এসময় একীভূত হয়ে নতুন নতুন প্রযুক্তির উদ্ভাবন শুরু করেছিলো। অথচ মানুষের জীবনের প্রভূত উন্নয়ন কিংবা হিতসাধনের ইচ্ছে যেন লোপাট হয়ে গেছে।
![](https://a.kha.icu/wp-content/uploads/2022/05/6-4-1024x576.jpg)
১৯৪২ সালে অক্সফোর্ডে হপকিন্সকে ক্যামব্রিজে তারই এক কলিগ একটি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেন। চ্যালেঞ্জটি বেশ কঠিনই। তখন এন্টিবায়োটিক বানানো শুরু হয়েছে। কাজটি অবশ্য পরিচালিত হচ্ছিলো বেশ গোপনে। যুদ্ধাবস্থার জন্যেই মূলত আমেরিকান এবং ব্রিটিশ বিজ্ঞানীরা এই গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছিলেন। পেনিসিলিনের বাহ্যিক ও রাসায়নিক গঠন আবিষ্কারেরই চেষ্টা করছিলেন তারা।
এই চ্যালেঞ্জকে অবশ্য বাজে ভাবার কারণ নেই। হপকিন্সের মেধার প্রতি শ্রদ্ধা ও বিশ্বাস রেখেই এমন চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেয়া। আর্নস্ট চেইন ১৯৪৫ সালেই ফিজিওলজিতে নোবেল পেয়েছিলেন ১৯৪৫ সালে। ক্যামব্রিজ আর অক্সফোর্ডে ১৯২৮ সালে গ্রাজুয়েশন এবং পিএইচডির পর থেকেই ডরোথি গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছিলেন।
চেইন তখন এডওয়ার্ড ফ্লোরির পরিচালিত এক গবেষণাকর্মে তত্বাবধান করছিলেন। তাদের লক্ষ্য ছিলো প্যানিসিলিনকে একটি রাসায়নিক পদার্থে রুপান্তরের চেষ্টা করছিলেন। তারা মূলত ব্যাকটেরিয়াল গ্রোথ নিয়ে চিন্তিত ছিলেন। ১৯৪০ সাল থেকেই তারা কঠোর পরিশ্রম চালিয়ে যাচ্ছেন। সমস্যা ছিলো একটিই। ইন্ডাস্ট্রিয়াল পর্যায়ে এই ড্রাগকে নিঃসরণ করা কঠিন। তাই চেইন বুঝতে পেরেছিলেন বাহ্যিক এবং রাসায়নিক গঠন একবার বের করতে পারলেই কেল্লা ফতে। এতে বোঝা যাবে একে এন্টিবায়োটিক হিসেবে ব্যবহার করা সম্ভব কিনা।
![](https://a.kha.icu/wp-content/uploads/2022/05/5-4-1024x576.jpg)
১৯৪২ সালে এই গবেষণা দলের একটি অংশ যুক্তরাষ্ট্রে স্থানান্তরিত হয়। এখানে আমেরিকান বিজ্ঞানীদের সাহায্যে এই গবেষণা করা সম্ভব হয়। তবে পুরোপুরি সফল হয়নি। সেই সময়ে বায়োক্যামিস্ট্রি একদম নতুন একটি অধ্যয়নক্ষেত্র। গবেষকরা মলিকিউল কিংবা কার্বোহাইট্রেডের মতো ক্ষুদ্র অণুর কথা জানে। কিন্তু তাদের গঠন খুঁজে বের করাটা যেন রহস্যের আরেক নাম।
ডরোথি এই বায়োক্যামিকেলের গঠন আবিষ্কারের নতুন পদ্ধতি উদ্ভাবন করছিলেন। প্রথমে তিনি মলিকিউলগুলোকে ক্রিস্টালাইজ করার একটি পদ্ধতি বের করেন। তারপর সেখানে এক্স-রে প্রেরণ করেন। মলিকিউলের ভেতরের নিউক্লিয়াইয়ের ভেতর এক্স-রে বিভিন্ন প্যাটার্নে ছড়িয়ে পড়ে। সেই চিত্রই ফটোগ্রাফিক প্লেটে ধরা সম্ভব হয়।
এভাবেই ডরোথি ক্যামিকেল স্ট্রাকচার আবিষ্কারের কাজে ব্যস্ত হয়ে ওঠেন। ১৯৪৫ সালে মে মাসেই জন বার্নালের সাথে দেখা হয়। সেবার তিনি বার্নালকে তার গবেষণার কথা জানান। তার দৃঢ় বিশ্বাস এই কাজ সফল হলে নোবেল পেয়ে যাবেন। তবে তিনি রয়্যাল সোসাইটিতে নির্বাচিত হলেই বেশি খুশি। কারণ এই সংগঠনে নির্বাচিত হওয়া নোবেল প্রাইজ পাওয়ার চেয়েও কঠিন।
![](https://a.kha.icu/wp-content/uploads/2022/05/4-3-1024x576.jpg)
পরবর্তীতে তিনি দুটোতেই নিজের নাম লিখিয়েছিলেন। আস্তে আস্তে তিনি ভিটামিন বি-১২ এর গঠন আবিষ্কার করেন। পরবর্তীতে তিনি অবদান রাখেন ইনসুলিন তৈরির পদ্ধতি উদ্ভাবন করে। এভাবেই তিনি মানববিজ্ঞানে এক নতুন দিক উন্মোচন করেন।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হতেই ডরোথি আবার অক্সফোর্ডে ফিরে গবেষণা শুরু করেন। তার অধীনে থেকেই লেখাপড়া একসময় মারগারেট রবার্টস হয়ে ওঠেন মারগারেট থেচার। সে আরেক দিনের গল্প।
ডরোথির আবিষ্কার সমগ্র বিশ্বেই আলোড়ন সৃষ্টি করে। বর্তমান সময়ে এন্টিবায়োটিক এবং ইনসুলিন এক অতীব প্রয়োজনীয় জিনিস। আর তার আবিষ্কারের পেছনে তার পরিশ্রমকে ভোলা যাবেনা। বিশেষত ২৪ বছর বয়সেই রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিসে আক্রান্ত হওয়ার পর বহু কষ্টে নিজেকে এগিয়ে নিতে হয়েছিলো। তবুও পরিশ্রম করে গেছেন। তার বর্ণবহুল জীবন থেমে যায় ১৯৯৪ সালে। তখন তার একটি কথাই যেন সব কিছুর সাক্ষ্য হয়ে ছিলো – “ক্যামিস্ট্রি আর ক্রিস্টালের বেড়াজালেই আমার সারাজীবন আটকে ছিলো।”
সেই বেড়াজালই দিয়েছে ইনসুলিন এবং মলিকিউলের রাসায়নিক গঠন আবিষ্কারের পথ।
অনন্যা/এআই