ওভারিয়ান সিস্ট: কারণ এবং উপসর্গ
ওভারিয়ান সিস্ট (Ovarian Cyst) হলো ডিম্বাশয়ে পূর্ণ তরল থলির মতো গঠন যা প্রায়শই অনেক মহিলার জীবনে কোনো না কোনো পর্যায়ে দেখা দেয়। সাধারণত, এই সিস্টগুলো ক্ষতিকর হয় না এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে নিজে থেকেই চলে যায়। তবে কিছু ক্ষেত্রে ওভারিয়ান সিস্ট বড় আকার ধারণ করতে পারে এবং শারীরিক সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে। ওভারিয়ান সিস্ট সম্পর্কে সচেতনতা থাকা গুরুত্বপূর্ণ, কারণ সময়মতো চিকিৎসা না নিলে এটি জটিলতায় পরিণত হতে পারে।
ওভারিয়ান সিস্টের কারণসমূহ
ওভারিয়ান সিস্ট বিভিন্ন কারণে হতে পারে। এর মধ্যে সবচেয়ে সাধারণ দুটি কারণ হলো
ফলিকুলার সিস্ট
প্রতি মাসে একজন মহিলার ডিম্বাণু মুক্তির প্রক্রিয়া (ovulation) ঘটে। ডিম্বাণু মুক্তির আগে একটি ফোলিকল তৈরি হয়, যা ডিম্বাণুকে ধারণ করে। যদি এই ফোলিকলটি ভাঙতে ব্যর্থ হয়, তখন এটি ফুলে ওঠে এবং সিস্টে পরিণত হয়। একে ফলিকুলার সিস্ট বলা হয়। সাধারণত এটি ক্ষতিকর হয় না এবং কিছু দিন বা মাস পর নিজে থেকেই চলে যায়।
করপাস লুটিয়াম সিস্ট
ডিম্বাণু মুক্তির পর ফোলিকলটি সাধারণত করপাস লুটিয়ামে (Corpus Luteum) রূপান্তরিত হয় এবং প্রোজেস্টেরন হরমোন উৎপাদন করে, যা গর্ভাবস্থা শুরু করার জন্য জরুরি। কিন্তু যদি ফোলিকলটি তরল দিয়ে পূর্ণ হয়, তখন এটি সিস্টে পরিণত হয়। এ ধরনের সিস্ট সাধারণত খুব বেশি সমস্যা তৈরি করে না, তবে কিছু ক্ষেত্রে এটি আকারে বড় হতে পারে।
অন্যান্য কারণসমূহ
পলিসিস্টিক ওভারি সিনড্রোম (PCOS)
পলিসিস্টিক ওভারি সিনড্রোম হলো একটি দীর্ঘমেয়াদী হরমোনজনিত রোগ, যেখানে ডিম্বাশয়ে একাধিক সিস্ট তৈরি হয়। এটি প্রজনন ক্ষমতা হ্রাস, অনিয়মিত পিরিয়ড এবং স্থূলতার মতো সমস্যার জন্ম দিতে পারে।
এন্ডোমেট্রিওসিস
এন্ডোমেট্রিওসিস হলো একটি অবস্থা যেখানে জরায়ুর অভ্যন্তরের টিস্যুগুলো জরায়ুর বাইরে বৃদ্ধি পেতে থাকে। এই টিস্যুগুলো ডিম্বাশয়ের সঙ্গে লেগে ওভারিয়ান সিস্ট তৈরি করতে পারে, যা “এন্ডোমেট্রিওমা” নামে পরিচিত।
গর্ভাবস্থা
কিছু ক্ষেত্রে, গর্ভাবস্থার শুরুতে করপাস লুটিয়াম সিস্টের সৃষ্টি হতে পারে। এই সিস্টগুলো সাধারণত গর্ভাবস্থার দ্বিতীয় ত্রৈমাসিকের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে যায়, তবে এর উপস্থিতি জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে।
পেলভিক ইনফ্ল্যামেটরি ডিজিজ (PID)
পেলভিক ইনফ্ল্যামেটরি ডিজিজ হলো প্রজনন অঙ্গে সংক্রমণ যা ওভারিয়ান সিস্টের কারণ হতে পারে। এই সংক্রমণ ডিম্বাশয় এবং ফ্যালোপিয়ান টিউবে প্রভাব ফেলে এবং সিস্টের সৃষ্টি করে।
ওভারিয়ান সিস্টের উপসর্গ
ওভারিয়ান সিস্ট অনেক সময় উপসর্গ ছাড়াই উপস্থিত থাকতে পারে, বিশেষত যদি এটি ক্ষুদ্র আকারের হয়। তবে সিস্টের আকার বড় হলে এবং কোনো জটিলতা দেখা দিলে কিছু সাধারণ উপসর্গ দেখা দিতে পারে। এর মধ্যে রয়েছে:
পেটের নিম্ন অংশে ব্যথা
ওভারিয়ান সিস্টের প্রধান উপসর্গ হলো পেটের নিচের অংশে অথবা পেলভিক অঞ্চলে ব্যথা। এই ব্যথা হালকা থেকে তীব্র হতে পারে এবং মাঝে মাঝে মৃদু ব্যথা বা চাপ অনুভূত হতে পারে। যদি সিস্ট বড় হয় বা ফেটে যায়, তবে ব্যথা অনেক তীব্র হতে পারে।
পিরিয়ডের অনিয়মিত অবস্থা
ওভারিয়ান সিস্টের কারণে হরমোনের ভারসাম্যহীনতা তৈরি হতে পারে, যা পিরিয়ডের সময় অনিয়মিততা সৃষ্টি করতে পারে। অনিয়মিত পিরিয়ড, হালকা অথবা ভারী রক্তপাত হতে পারে।
ফুলে থাকা বা বমি বমি ভাব
সিস্টের আকার বড় হলে পেট ফুলে যাওয়ার অনুভূতি, বমি বমি ভাব, এমনকি বমি হতে পারে। এগুলো সাধারণত সিস্টের কারণে পেটের অভ্যন্তরে চাপ সৃষ্টি হওয়ার ফলাফল।
মূত্রত্যাগের সমস্যা
বড় আকারের সিস্ট মূত্রাশয়ের উপর চাপ সৃষ্টি করতে পারে, ফলে মূত্রত্যাগে সমস্যা বা ঘন ঘন মূত্রত্যাগের অনুভূতি দেখা দিতে পারে। এছাড়াও মূত্রত্যাগের সময় ব্যথা হতে পারে।
যৌনমিলনের সময় ব্যথা
ওভারিয়ান সিস্ট থাকলে যৌনমিলনের সময় ব্যথা হতে পারে, বিশেষ করে যদি সিস্ট পেলভিক অঞ্চলের কাছে অবস্থিত হয়। অনেক মহিলার ক্ষেত্রে এটি একটি অস্বস্তিকর উপসর্গ হয়ে দাঁড়ায়।
মলত্যাগের সময় ব্যথা
যদি সিস্ট বড় আকারের হয়, তা মলাশয়ের উপর চাপ সৃষ্টি করতে পারে এবং মলত্যাগের সময় ব্যথা হতে পারে।
অস্বাভাবিক হরমোনজনিত লক্ষণ
কিছু সিস্ট থেকে হরমোন উৎপন্ন হতে পারে, যা শরীরে অস্বাভাবিক পরিবর্তন আনতে পারে। এই পরিবর্তনগুলোর মধ্যে ব্রণ, মুখে বা শরীরে অতিরিক্ত লোম গজানো ইত্যাদি রয়েছে।
ওভারিয়ান সিস্টের জটিলতা
যদিও বেশিরভাগ ওভারিয়ান সিস্ট ক্ষতিকর নয়, তবে কিছু ক্ষেত্রে জটিলতা দেখা দিতে পারে। বড় আকারের সিস্ট বা ফেটে যাওয়া সিস্ট পেটের অভ্যন্তরে রক্তপাতের কারণ হতে পারে। তাছাড়া, সিস্টের ঘূর্ণন (ovarian torsion) হলে ডিম্বাশয়ে রক্ত প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হতে পারে, যা একটি মেডিকেল জরুরী অবস্থা।
চিকিৎসা এবং প্রতিকার
ওভারিয়ান সিস্টের চিকিৎসা নির্ভর করে সিস্টের আকার, অবস্থান, এবং উপসর্গের উপর। ছোট এবং ক্ষতিকর সিস্টের ক্ষেত্রে সাধারণত চিকিৎসা প্রয়োজন হয় না। তবে যদি সিস্ট বড় আকারের হয়, ব্যথা বা অন্যান্য উপসর্গ তৈরি করে, তাহলে আল্ট্রাসাউন্ড, হরমোন থেরাপি, বা প্রয়োজনে সার্জারি করা হতে পারে।
নিজেকে সুরক্ষিত রাখার উপায়
নিয়মিত গাইনোকোলজিস্টের পরামর্শ নেওয়া। হরমোনের ভারসাম্য বজায় রাখা।কোনো ব্যথা বা উপসর্গ দেখা দিলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া।
ওভারিয়ান সিস্ট অনেক সময় সাধারণ হলেও, কোনো ধরনের অস্বাভাবিক লক্ষণ দেখা দিলে তা উপেক্ষা করা উচিত নয়। সময়মতো চিকিৎসা নিলে জটিলতা থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভব।