Skip to content

৮ই সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দ | রবিবার | ২৪শে ভাদ্র, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

মুনার অপেক্ষা

মুনা অপেক্ষা করছে সকাল থেকে। শুধু কি আজ সকাল থেকে! বলতে গেলে গত তিন বছর ধরে, আর একটু গভীরভাবে বললে, অনন্ত অপেক্ষা করছে মুনা। আজ বাংলাদেশ থেকে তার কাজিন সুহাস আসবে। সে এমএস করতে ব্রাউন ইউনিভার্সিটিতে চান্স পেয়েছে। এটি আমেরিকার প্রভিডেন্স শহরের মোটামুটি একটা নামকরা ইউনিভার্সিটি। এখানে সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো রেসিডেন্সিটি। না, খুব নিকটবর্তী ভবিষ্যতে তার আসার কোনো সুযোগ কিংবা সম্ভাবনা ছিল না। যদিও প্ল্যান ছিল দীর্ঘদিনের। তবে এত দ্রুত যে সব কিছু হয়ে যাবে সেটা ওরা কেউই জানতো না। আজ তো নয়ই। তারপরও আসছে। কী করে যেন সব অসম্ভব মুহূর্তেই সম্ভব হয়ে গেলো। সারাক্ষণই কেন যেন একটি অন্তহীন চিকন, সুক্ষ্ম অপেক্ষা, চিনচিনে ব্যথা ওকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রাখতো সব সময়। আশা ছিল খুব। নিশ্চয়ই হবে একদিন।

বিশেষ করে ও যখন ক্লাসের ফাঁকে ফাঁকে এই কফিশপে একা একা কফি খেতে আসতো বিষয়টা তখনই ওর বেশি মনে পড়তো, পীড়া দিতো। বাইরে বর্ষার আকাশ। অথচ ঝকঝকে তকতকে পরিচ্ছন্ন উজ্জ্বলতায় ঠাসা। খুব অল্প সময় আগে ঝুম বৃষ্টিতে আকাশটা ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে আছে। আবার হঠাৎই রোদের ঝলকানিতে হেসে উঠছে চারপাশ। মুনাও পড়েছে এই ইউনিভার্সিটিতে। মুনার বাবা, মা এ শহরে থাকেন না। মুনা ম্যানেজমেন্টের মেধাবী ছাত্রী ছিল। প্রতিটা সেমিস্টারেই তার রেজাল্ট এরিলেন্ট। সম্প্রতি তার ফাইনাল পরীক্ষায় ডিপার্টমেন্টে ফার্স্ট হওয়ার গৌরব অর্জন করেছে সে। সহপাঠীরা তাকে সমীহ করে, কেউ কেউ কারণ-অকারণ তার পেছন পেছন ঘুরঘুর করে। শিক্ষকরা আদরের পাশাপাশি তাকে একটুখানি সম্মানও করে। তার প্রেজেন্টেশানে তারা অভিভূত হয়ে যেতেন। তারা জানেন, ওয়ার্ল্ডের বিভিন্ন কান্ট্রি থেকে নানান ক্যাটাগরির স্টুডেন্ট এখানে স্টাডি করতে আসে। তবে, বেশিরভাগ সময়েই বাঙালি কোনো স্টুডেন্টের এমন এবিলেন্ট পারফরমেন্সে তারা অভ্যস্ত। তাদের সবার মধ্যে মুনা এগিয়ে।

মুনা আমেরিকায় এসেছে আজ থেকে চব্বিশ বছর আগে। তার মায়ের ভিসা পাওয়ার সুবাদে। তখন তার বড় বোন রুনার বয়স চার বছর। আর সে তখন মায়ের গর্ভের অন্ধকার কুঠুরীতে। তার বাবা মায়ের এদেশে সেটল হওয়ার পরই মুনার জন্ম। মুনার জন্মের পর পরই দেশ থেকে তার খালামনি তড়িৎ মুনার নাম সিলেক্ট করে পাঠায়। খালামনির পাঠানো ‘মৌমিতা ইসলাম মুনা’ নাম ধারণ করেই হাসপাতাল থেকে রিলিজ পায় সে। নিউয়র্কের বহুতল বিশিষ্ট অ্যাপার্টমেন্টে বাবা মায়ের সঙ্গে এদেশের আলো- হাওয়া মেখে মুনা বড় হতে থাকে। অসম্ভব সুন্দরী মুনা দেখতে অনেকটা দেবী আফ্রেদিতির মতো। বান্ধবীদের কেউ কেউ তাকে ভেনাস বলে ডাকে, কেউ ডাকে আফ্রোদিতি। পাঁচ ফুট পাঁচ ইঞ্চি লম্বা মুনার পিঠভর্তি কোঁকড়ানো চুলের মাধবকুণ্ড জলপ্রপাত। ছলাৎ ছলাৎ কম্পন তোলে যখন তখন তা ঝড় ওঠায় বন্ধুমহলে। তার চোখদুটি না নীল, না আকাশি, না কালো-সব মিলিয়ে গাঢ় পীতবর্ণের চোখের মুনাকে ইউনিভার্সিটিতে প্রেম ও সৌন্দর্যের দেবী ভেনাস নামে ওর সুখ্যাতি রয়েছে। আদর করে কেউ কেউ গোলাপ কিংবা পাখি বলেও ডেকে থাকে।

জনশ্রুতি আছে, সুন্দরীরা অহংকারী আর একটু কম বুদ্ধির হয়। কিন্তু মুনার ব্যাপারে সেটা একেবারেই বেমানান। তাই তো আদর করে, মজা করে, আহাদ করে নানা জনে নানান নামে ডাকলেও মুনা একটুও রাগ করে না। হাসিমুখী, মানবিক, দরদি এবং বন্ধুত্বের প্রতি আন্তরিক ও শ্রদ্ধাশীল মুনা এসব অসামান্য গুণের জন্য সবার চোখের মণি। কেউ, কেউ এবং অনেকেই যে সুন্দরী মুনার সরলতার সুযোগ বুঝে প্রেম নিবেদন করেনি, তাকে একান্ত করে কাছে চায়নি, তা কিন্তু নয়। বরং এদেশীয় বন্ধু টাফিক, লরেন্স, টনি একে অন্যের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে, অসম প্রতিযোগিতায় তারা মুনার কাছে আসতে চায়। ভালোবাসে। একই রকম ভালোবাসে বাংলাদেশি সহপাঠী মেধাবী ফারুক। ফারুক তো পারলে ক্যাম্পাসের প্রতিটি ইঞ্চি মুনার পায়ে পায়ে ঘোরে। নিঃশ্বাসে নিঃশ্বাস নিতে চায়। কিন্তু কেন যেন সাবধানী মুনা ইচ্ছেকৃতভাবেই কারও দিকে ভ্রূক্ষেপ করে না। সসম্মানে এড়িয়ে চলে, নিজেকে বাঁচিয়ে চলে। আবার কারও সঙ্গে খারাপ ব্যবহারও করে না। দেখা হলেই একগাল হাসির বিনিময়ে ফিক করে এক স্লাইস হাসি উপহার দিয়ে খুব সচেতনভাবে সবার থেকে দূরে দূরে থাকে। মুনার শান্ত ব্যবহারের মাধ্যমেই তার অভিপ্রায় সবাইকে জানিয়ে দিতে চায়, কিন্তু মুনা বুঝতে পারে না, তারা কি তা বুঝতে পারে, নাকি বুঝেও না বোঝার ভান করে। এত কিছু ছাড়াও কতদিন পর পরই বাবা-মায়ের পছন্দ করা ছেলেদের সঙ্গে বিয়ের প্রস্তাবও এড়িয়ে গেছে সন্তর্পণে।

-আর একটু ওয়েট মম, ওয়েট পাপা। নিজেকে একটুখানি গুছিয়ে নেই। পড়াশোনাটা শেষ করি। নিজের ক্যারিয়ার নিয়ে একটু ভাবতে দাও। এখনই বিয়ে নিয়ে ভাবছি না।

মুনা জানে, এভাবে সরাসরি না বললে তাদের থামানো মুশকিল হয়ে যাবে। অন্তত, এবার দেশে ঘুরে আসা পর্যন্ত তাদের থামাতে হবে, তাকে ওয়েট করতেই হবে।

এ দেশে জন্ম, এদেশে বেড়ে ওঠা তবুও ওর মায়ের মতো, বাবার মতো ওর মন পড়ে থাকে বাংলাদেশের ছায়াঘেরা সবুজ পল্লীতে। এদেশের আলো হাওয়ায় বেড়ে ওঠা হলেও প্রতি দু’বছর পর পর বাবা মায়ের সঙ্গে বাংলাদেশে তাদের নিজের বাড়িতে থেকে আসে নিয়ম করে। যখন এদেশের সামার ভ্যাকেশনে তারা পরিবারসহ দেশে থাকা দাদা-দাদি, নানা-নানি, খালা, ফুপু, চাচা, মামা, কাজিনদেও সঙ্গে আনন্দঘন পরিবেশে তাদের অবকাশ কাটিয়ে ফিরে আসে। সেই সুবাদে ছোট্ট মুনার হৃদয়ে বাংলাদেশের প্রভাব খুব ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। কিন্তু গতবারের জড়ানোটা একেবারে অন্য রকম। ওর কাজিন সুহাসের প্রতি অন্য এক ভালোলাগা-ভালোবাসায় সারাক্ষণ আড্ডা হয়ে আছে মন। মুনা আমেরিকাতে বসবাস করলেও পোশাক পরিচ্ছেদ পরে বাংলাদেশি। যখনই তারা বাংলাদেশে যায়, তখনই তার মা ওখান থেকে দু’বছরের মতো তাদের সবার জন্য আরামদায়ক সুতির পোশাক নিয়ে আসেন। বাবার লুঙ্গি, ট্রাউজার, মায়ের সালোয়ার কামিজসহ গুদের দু’বোনের জন্য ঘরে পরার মতো নরম কাপড়, বিছানার চাদর কিনে নেন। সারা বছরের কুমড়ো বড়া, নানান রকম মসলা-পাতি, ধনে, হলুদ, মরিচের গুঁড়া, খাঁটি সরিষার তেল-সব মিলিয়ে বাংলাদেশি আবহ থাকে তাদের ফ্লাটে। হোয়াটসঅ্যাপ, মেসেঞ্জার, ফেসবুকে সারাক্ষণই বাংলাদেশের আত্মীয় স্বজনের সঙ্গে এক মধুর সম্পর্কের কারণে দেশের আত্মীয় স্বজনও থাকে চোখের সামনে। সেই অর্থে দুটি দেশই মুনার একান্ত নিজের, নেটিভ ভিলেজ। কিন্তু সবার থেকে সুহাস ভাইয়া আলাদা। যখন সে শেষবারের মতো দেশে গিয়েছিল তখন সুহাস তাকে সারাক্ষন চোখে চোখে রাখতো, টেককেয়ার করতো। নিজের হাতে মুনার মাছের কাঁটা বেছে দিতো। যদিও মুনা কোনো ধরনের ছোট মাছ খায় না, তবে দেশের বড় নওলা মাছ, রুই, ইলিশ মাছের কাঁটা বেছে খাওয়া খুব কঠিন কিছু নয়, তবু সুহাস খুব যত্ন
করে মাছের কাঁটা, চিকেনের হাড় ছাড়িয়ে মুনাকে গালে তুলে খাইয়ে দিতো। সেবার ভীষণ গরম ছিল দেশে। চল্লিশ-বিয়াল্লিশ তাপমাত্রায় মুনার জন্য ফ্রিজে আলাদা যত্নে মিনারেল ওয়াটার সংরক্ষণ করা, সারাক্ষণ এসি থেকে যেন মুনাকে বের হতে না হয় সেজন্য আলাদাভাবে খেয়াল করতো সুহাস। সে এক অন্য রকম অনুভূতি। যা কিছুতেই বলে বোঝানো যায় না, শুধু উপলব্ধির বিষয়। এতকিছু ছাড়িয়ে সুহাস মুনার কাছে তার এদেশীয় ভালোবাসার কথা ব্যক্ত করেছিল। সে চায়, ইন্টারমিডিয়েট পাস করে এদেশে পড়তে আসবে। ট্রিপল ই তে পড়ার ইচ্ছে সুহাসের প্রথম থেকেই।

সেই থেকে মুনার মনের মধ্যে সারাক্ষণ সুহাসের ভাবনা ছড়িয়ে থাকতো সাদা মেঘের মতো নরম উষ্ণতায়। ওদিকে সুহাসও ইন্টারমিডিয়েট পাস করার পরই খুব চেষ্টা করেছিল। অনলাইন দুনিয়ায় বিভিন্ন তথ্য ঘেঁটেঘুটে ব্যস্ত সময় পার করেছিল। কিন্তু কোনোভাবেই বাইরের কোনো ইউনিভার্সিটিতে স্কলারশিপসহ কোনো সিভি ড্রপ করতে পারেনি। দুই-একটি অখ্যাত ইউনিভার্সিটিতে এন্টে করলেও স্কলারশিপ অ্যালাউ ছিল না। শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্তে আসতে এবং বাংলােেদশে ভর্তি হতে এক বছর পিছিয়ে যায় সুহাস। যে বাংলাদেশের একটি ঐতিহ্যবাহী ইডানভার্সিটিতে পড়েছে ঠিকই, কিন্তু পড়ার সঙ্গে সঙ্গে স্পোকেন ইংলিশ, আইইএল টেস্টসহ নানাভাবে নিজেকে প্রস্তুত করেছে। এর স্বপ্নই শুধু ইউরোপ কিংবা আমেরিকার কোনো ভার্সিটি থেকে ডিগ্রি নিয়ে দেশে ফিরে আসা। সেই মোতাবেক সে কাজ করে যাচ্ছে। সুহাস জানে- মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়। যার স্বপ্ন যত বড়, তার জীবন তত বড়। তাই তো সে হাল ছাড়েনি। সে চেয়েছে ডলারশিপ নিয়েই বিদেশের মাটিতে পাড়ি দেবে। হঠাৎ ধেয়ে আসা পেন্ডামিকের কারণে সারা বিশ্বের সাথে সব ধরনের যোগাযোগও বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। যে কারণে দেখতে দেখতে স্কুল কলেজ, ইউনিভার্সিটি, পড়াশোনাসহ সাধারণ যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেলো। সুহাস তবুও হাল ছাড়ে না। ও নর্থ-সাউথ ইউনিভার্সিটিতে পড়ে, সোটা দেশের প্রথম শ্রেণীর একটি প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি। এখানে পেন্ডামিকের কারণে সিম্পল একটি ক্লাসও হ্যামপার হয়নি। সুহাস মন দিয়ে অনলাইন ক্লাস করে, এগজাম দেয়। অতএব খুবই ভালো রেজাল্ট নিয়ে সাফল্যের সাথে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়াটা শেষ করে। বাবা প্রতিদিনই চাপ দেয়-চাকরির জন্য বিভিন্ন কোম্পানিতে সিভি ড্রপ করো।
মা তাগাদা দেয়-পড়া তো শেষ বাবা। এবার চাকরির চেষ্টা
করো। ঘরে বসে থাকলে হবে না।
-এই তো করছি মা। চেষ্টা করছি সব রকম।

ডাউনলোড করুন অনন্যা অ্যাপ