কৃপী : মহভারতের নেপথ্য চরিত্র
কৃপী মহর্ষি শরদ্বানের কন্যা ও কৃপাচার্যের বোন। কৃপ শরস্তম্ভে স্খলিত শরদ্বানের রেতঃ থেকে জন্মগ্রহণ করেন কৃপী। হস্তিনাপুরের রাজা শান্তনু কৃপা করে প্রতিপালন করে বিধায় নাম রাখা হয় কৃপী। পরবর্তী সময়ে বিয়ে হয় দ্রোণাচার্যের সঙ্গে। দ্রোণাচার্য মহাভারতের একটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র।
তিনি কৌরব এবং পাণ্ডবদের অস্ত্রশিক্ষার গুরু ছিলেন। মহর্ষি শরদ্বানের কন্যা কৃপীকে-দ্রোণ পিতৃআজ্ঞায় বিয়ে করে। পরবর্তীকালে গুরু দ্রোণের ঔরসে এবং কৃপীর গর্ভে এক পুত্র সন্তানের জন্ম হয়। জন্মমাত্র উচ্চৈঃশ্রবার মতো হ্রেষা রব করায় এই পুত্রের নাম রাখা হয় অশ্বত্থামা।
আপাতদৃষ্টিতে মহাভারতে কৃপীর কোনই সক্রিয় ভূমিকা পরিলক্ষিত নাহলেও কৃপী বড় অংশ দখল করে আছে। দ্রোণাচার্য এবং কৃপীর ইচ্ছে ছিল সন্তানকে নিজেদের দুঃখের সংসারে কষ্টে বড় করে তুলবেন না। একদিন না একদিন কোন রাজ্যের রাজারূপে সন্তানকে দেখতে চায় গুরু দ্রোণ। এমনকি কৃপীও সন্তানের আকাঙ্ক্ষা – অর্ধমের পথে হাঁটা থেকে অশ্বত্থামাকে নিবৃত্ত করেনি।
কৃপীর সান্নিধ্যেই অশ্বত্থামার বেড়ে ওঠা৷ মায়ের স্নেহ- ভালোবাসায় বেড়ে উঠলেও কৃপীর শাসনের বেড়ি তার পায়ে পড়েনি। দ্রোণাচার্য যেমন সন্তানের অধর্মকে দেখেছে কিন্তু রক্ষার দায় গ্রহণ করেনি। বরং অতিরিক্ত পিতৃস্নেহে সন্তানকে ভালোবেসে গেছে। আবার কৃপীও অতিরিক্ত মাতৃস্নেহের বশে সন্তানকে সঠিক শিক্ষায় লালন- পালন করতে পারেনি। অশ্বত্থামার বখে যাওয়া, অধর্মের পথে সাড়া দেওয়া এবং নিজ থেকে অধর্মের চর্চা সবই শাসনহীন এবং অতিরিক্ত ভালোবাসার ফল। যেখানে মহাভারতের অন্যতম শিক্ষাগুরু দ্রোণাচার্যের সন্তান। তবুও কৃপীর অপারঙ্গমতাই যেন অশ্বত্থামার পরিণতির একমাত্র কারণ। নেপথ্যে থেকে সন্তানের জন্য কৃপীর নিষ্ক্রিয় অবদান তাকে বিপথে ঠেলে দিয়েছে।
ফলে কৃপী সন্তান পালনের ক্ষেত্রে ইতিবাচক ছিল কতটা তা বিবেচনার বিষয়। এমনকি কৃপীর বিস্তৃতি বা সন্তান পালনের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত মাতৃস্নেহের পরিণাম কতটা সেটাও বোধগম্য হয়।
অস্ত্রত্যাগ না করলে দ্রোণ ইন্দ্রাদি দেবগণেরও অজেয়। ফলে কৃষ্ণের পরামর্শ মতো দ্রোণকে অস্ত্রত্যাগ করার জন্য তার পুত্র অশ্বত্থামার মৃত্যু সংবাদ দেওয়ার পরিকল্পনা করা হয়। যুধিষ্ঠির ভিন্ন অন্য কারো কথা দ্রোণ বিশ্বাস করে না বিধায় যুধিষ্ঠিরের অনিচ্ছা সত্ত্বেও তাকে রাজী করে পাণ্ডবগণ। ভীম মালবরাজ ইন্দ্রবর্মার অশ্বত্থামা নামে এক হাতীকে গদাঘাতে বধ করা হয়। ফলে যুধিষ্ঠির দ্রোণকে অশ্বত্থামার নিহত হওয়ার সংবাদ পৌঁছে দেয় দ্রোণের কাছে। সন্তানের মৃত্যু সংবাদ ভেবে দ্রোণ স্তম্ভিত হয়ে পড়েন। এবং দ্রোণের সঙ্গে অশ্বত্থামার চরিত্র গড়ে ওঠার নানারকম পরিবেশ সৃষ্টি হলেও গর্ভজাত সন্তানের জন্য দুঃখ -দুর্দশার মধ্যে কৃপীর শোচনীয় অবস্থার বর্ণনা আসেনি। এমনকি গুরু দ্রোণাচার্যের শিরশ্ছেদ ঘটলেও পরবর্তী ঘটনার অবতারণা করেননি লেখক কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন ব্যাসদেব।
কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন ব্যাসদেব মহাভারতের নারী চরিত্র নির্মাণে খুব একটা সচেতন নন। তবে যে চরিত্র বা যেগুলো চরিত্র বিশেষভাবে মহাভারতের যুদ্ধের দিকে কাহিনীকে এগিয়ে দিয়েছে সেসব চরিত্র নির্মাণে লেখকের আগ্রহ প্রকাশ পেয়েছে। কিন্তু যারা শুধু একটি সামাজিক পরিচিতি পাবার জন্যই কাহিনীতে স্থান পেয়েছে তাদের চরিত্র নির্মাণে লেখকের উদাসীনতা লক্ষণীয়। কৃপী চরিত্র নির্মাণের ক্ষেত্রে লেখকের সচেতন হওয়া খুবই জরুরি ছিল। কারণ লেখা তো সমাজের দর্পণ। ফলে কৃপী সন্তান পালনের ক্ষেত্রে ইতিবাচক ছিল কতটা তা বিবেচনার বিষয়। এমনকি কৃপীর বিস্তৃতি বা সন্তান পালনের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত মাতৃস্নেহের পরিণাম কতটা সেটাও বোধগম্য হয়। নারীর চরিত্রের বৈশিষ্ট্য মনে হয় আড়ালে আবড়ালে থাকা সর্বদা। প্রকাশ পেয়েছে যেটুকু তার চেয়ে অনেকবেশি সক্রিয় নেপথ্যে।
অনন্যা/এসএএস