প্রবাসী নারীকর্মীর মৃত্যু খতিয়ে দেখতে হবে
প্রত্যেক বছরই অসংখ্য নারী শ্রমিক ভাগ্যন্নোয়নে দেশের বাইরে পাড়ি জমায়। তবে শেষমেশ অনেকের ভাগ্যে জোটে নানাবিধ বিড়ম্বনা। আবার কেউ কেউ হত্যা-আত্মহত্যার শিকার হচ্ছে। গত পাঁচ বছরে ৪ লাখ ৩০ হাজার ৪৫৩ জন বাংলাদেশি নারী শ্রমিক বিদেশে গেছে। ২০১৭ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন দেশে মারা গেছে ৭০৯ জন নারী। তবে ২০২১ সালের অক্টোবর পর্যন্ত দেশে আসা ৬৯১ নারী শ্রমিকের মৃত্যুর কারণ বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, মৃত্যুসনদ অনুযায়ী বিভিন্ন রোগ ও প্রাকৃতিকভাবে ৬৯ শতাংশ শ্রমিকের স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে। দুর্ঘটনা ও আত্মহত্যায় ৩১ শতাংশ নারী শ্রমিকের অস্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে।
প্রতি বছরই বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশে নারীরা কাজ করতে যান। আর উন্নত জীবনের খোঁজে গিয়ে তাদের অনেকেই মৃত্যুবরণ করেন অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে। এসব মৃত্যুর পেছনে যেমন স্বাভাবিকতা রয়েছে তারচেয়ে বেশি রয়েছে দুর্ঘটনা বা আত্মহত্যা। তবে সৌদি আরবের ক্ষেত্রে ২৪ শতাংশের মৃত্যুর কারণ আত্মহত্যা। অভিবাসী নারীর হত্যা-আত্মহত্যা যাই ঘটুক না কেন, এ বিষয়ে সঠিকতা নিরূপণের কোনো তৎপরতা নেই। বা যতটুকু উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, সে ব্যাপারে ভুক্তভোগী পরিবারের যথেষ্ট আস্থা নেই। এর কারণ হিসেবে গবেষণায় উঠে এসেছে, ৪৮ শতাংশ পরিবার এসব অভিবাসী নারী শ্রমিকের স্বাভাবিক মৃত্যু বিশ্বাস করেন না। তাদের অভিযোগ, দেশে মরদেহ পৌঁছার পর নতুন করে ময়নাতদন্ত না হওয়ায় মৃত্যুর সঠিক কারণ নিয়ে তাদের সন্দেহ রয়েছে।
ডেথ সার্টিফিকেটের তথ্য অনুযায়ী, বিদেশে মারা যাওয়া ৬৯ শতাংশ বাংলাদেশি নারী শ্রমিকের স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে। ৪৮ শতাংশ পরিবারের সদস্যরা বলেছেন, তারা ডেথ সার্টিফিকেটে নির্ধারিত মৃত্যুর যেসব কারণ উল্লেখ করা হয়েছে তা বিশ্বাস করেন না। কারণ হিসেবে তারা বলেছেন, মৃতরা পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ হওয়ার আগ পর্যন্ত অধিক কর্মঘণ্টা, শারীরিক, মানসিক ও যৌন নির্যাতনের অভিযোগ জানিয়েছেন। এসব কারণে অনেকে আত্মহত্যার পথও বেছে নিতে পারেন বলেও কেউ কেউ মনে করেন।
প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় এবং সর্বোপরি সরকারি হস্তক্ষেপে সঠিকভাবে প্রবাসী নারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।
গবেষণার তথ্যমতে, ২০১৯ সালে ১৩০ জন অভিবাসী নারী শ্রমিকের মৃতদেহ দেশে ফেরে। যার মধ্যে আত্মহত্যা করেছিলেন ২৪ জন। এখানে উল্লেখ করার মতো বিষয় হলো, অস্বাভাবিক মৃত্যু শুধু শ্রমিক হিসেবে যেসব দেশে নারীরা যাচ্ছেন সেসব দেশেই বেশি। এশিয়া ও উন্নত পশ্চিমা দেশগুলোয় অস্বাভাবিক মৃত্যুর কোনো ঘটনা নেই। ১০০টি পরিবারের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য বলছে, যাদের লাশ দেশে এসেছে তাদের ৭৯ শতাংশই গৃহকর্মী হিসেবে বিদেশে কাজ করতে গিয়েছিলেন। ১০ শতাংশের বিদেশে যাওয়ার আগেই কোনো না কোনো ক্রনিক অসুখ যেমন ডায়াবেটিস, ব্লাড প্রেসার ইত্যাদি ছিল।
বিএমইটি ও ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডের তথ্য মতে, ২০১৭ সালে এসেছে ১১৫ জন অভিবাসী নারী শ্রমিকের মরদেহ, ২০১৮ সালে ১৩৫, ২০১৯ সালে ১৩০, ২০২০ সালে ৬৯, ২০২১ সালে ১৩০ এবং ২০২২ সালে ১৩০ জন। সব মিলিয়ে গত ছয় বছরে মোট ৭০৯ জনের মরদেহ দেশে এসেছে।
এর মধ্যে ২০১৭ সাল থেকে ২০২১ সালের অক্টোবর পর্যন্ত শ্রমিক হিসেবে যাওয়া দেশগুলোয় মারা গেছেন ৫৫৪ জন, নন-লেবার হিসেবে যাওয়া এশীয় দেশগুলোয় ৫৪ জন এবং পশ্চিমা উন্নত দেশগুলোয় মারা গেছেন ৮৩ জন অভিবাসী।
সৌদি আরব, জর্ডান, ওমান, বাহরাইন, কুয়েত, লেবাননসহ শ্রমিক হিসেবে যাওয়া দেশগুলোয় মৃত নারীদের ডেথ সার্টিফিকেটে উল্লেখ করা স্বাভাবিক মৃত্যুর গড় বয়স দেখা গেছে ৩৭ বছর। কিন্তু নন-লেবার হিসেবে যাওয়া এশিয়ান ও পশ্চিমা দেশগুলোয় স্বাভাবিক মৃত্যু হিসেবে উল্লেখ করা নারীদের গড় বয়স যথাক্রমে ৪৬ ও ৪৯ বছর। তবে এই দীর্ঘ তালিকা নারীর মৃত্যু নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়!
উন্নয়নশীল দেশ এবং একইসঙ্গে জনসংখ্যার তুলনায় কাজের যথেষ্ট সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত না করতে পারায় এসব নারীরা পরিবার-পরিজন ছেড়ে কিছুটা ভালোমতো জীবনযাপনের আশায় বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছে। তবে অভিবাসী নারীদের এমন মৃত্যু নিয়ে নেই কোন সঠিক তৎপরতা! দেশের গণ্ডি ছেড়ে একটু বাঁচার আশায় যখন মৃত্যুর ফাঁদ তখন কেনোই বা তাদের এই যাত্রা! তাহলে দেশের এাব হতভাগ্য জনগণ কোথায়ই বা যাবেন!
যেহেতু সবার জন্য দেশে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা সম্ভব নয় ফলে প্রবাসে যাওয়া অস্বাভাবিক নয়। তবে সবচেয়ে অস্বাভাবিক হলো তাদের অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যু। তাই প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় এবং সর্বোপরি সরকারি হস্তক্ষেপে সঠিকভাবে প্রবাসী নারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। অভিবাসী নারীরা অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যুর শিকার হলে তার তথ্য উদঘাটন করে সঠিক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। মনে রাখতে হবে, একটি মৃত্যু দেশের জন্য হয়তো শুধু সংখ্যার তালিকা বাড়াবে কিন্তু একটি পরিবারের মূল খুঁটিটাই ভেঙে দিতে পারে। ফলে প্রবাসী নারীদের এ ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যুর কারণ অনুসন্ধান করে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে কর্তৃপক্ষের এদিকে নজর দিতে হবে।