Skip to content

২রা মে, ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দ | বৃহস্পতিবার | ১৯শে বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

এনহেদুয়ানা : পৃথিবীর প্রথম নারী কবি

আজ থেকে প্রায় চার হাজার বছর আগের কথা। মেসোপোটেমিয়া অঞ্চলে (বর্তমানে ইরাকের টাইগ্রিস বা দজলা ও ইউফ্রেটিস বা ফোরাত নদী দুটির মধ্যবর্তী অঞ্চলে গড়ে ওঠা নগরী) এক তরুনী মাটির ট্যালিতে কিউমিফর্ম লিপিতে একমনে রচনা করে যাচ্ছেন দেবী বন্দনা। মেয়েটি আর কেউ নন, তাঁকে বলা হয়ে থাকে বিশ্বের প্রথম মহিলা কবি, সার্গনকন্যা এনহেদুয়ানা। বলা হয়ে থাকে, তিনি আক্কাদীয় সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা মহামতি সার্গন দ্য গ্রেটের কন্যা। প্রত্নতাত্ত্বিক নথি থেকে প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, এনহেদুয়ানা একইসাথে ছিলেন প্রাচীন সুমেরীয় মন্দিরের একজন মহাযাজিকা এবং বিশ্বের প্রথম পরিচিত লেখিকা। সুমেরীয় শব্দ ‘এন’ মানে হলো মহাযাজক বা যাজিকা, ‘হেদু’ শব্দের অর্থ হলো অলংকার, আর আনা দিয়ে বোঝায় স্বর্গলোককে। অর্থাৎ তার নামের অর্থ দাঁড়ায় ‘অলংকার পরিহিতা স্বর্গের রমণী’।

খ্রি.পূ. ২২৮৬ অব্দের দিকে প্রাচীন মেসোপটেমিয়ার উর্বর ভূমিতে এনহেদুয়ানার জন্ম। এনহেদুয়ান্না শব্দের অর্থ অন্তরীক্ষ দেবী। তিনি আক্কাদের সম্রাট সারগন ও তাঁর স্ত্রী রানি তাশলুলতুমের মেয়ে। অন্য এক মতে, এনহেদুয়ান্না সম্রাট সারগনের (যাঁকে পৃথিবীর সম্রাট বলে অভিবাদন জানানো হতো) মেয়ে নন, তবে রক্তের সম্পর্কিত আত্মীয়া। অন্য তথ্য মতে, তার বাল্যকাল সম্পর্কে তেমন কিছু জানা যায় না। শুধু বলা হয়ে থাকে, তিনি সম্রাট সার্গন দ্য গ্রেটের সন্তান। তবে, তাতেও আপত্তি জানিয়েছেন অনেক ইতিহাসবিদ। তাদের ভাষায়, সার্গন এনহেদুয়ানার জন্মদাতা পিতা নন। সাম্রাজ্য পরিচালনায় সম্রাট এনহেদুয়ানাকে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ পদ বসিয়েছিলেন বলে তাকে সার্গনকন্যা হিসেবে অভিহিত করা হয়।

যশ-প্রতিপত্তি কিংবা প্রজ্ঞার বিচারে, এনহেদুয়ানা ছিলেন মেসোপটেমিয়ার অন্য দশজন মহিলা থেকে ব্যতিক্রম। পরাক্রমশালী শাসকের সন্তান হওয়ায়, শিক্ষা কার্যক্রমের সম্পূর্ণটাই গ্রহণের সুযোগ পেয়েছিলেন তিনি। তিনি সুমেরীয় এবং আক্কাদীয় উভয় ভাষা-ই পড়তে ও লিখতে জানতেন। জটিল গাণিতিক হিসেবেও সমান পারদর্শী ছিলেন তিনি।

উর শহরের একজন মহাযাজিকা হিসেবে, কিউনিফর্ম লিপির ব্যবহার সর্বক্ষেত্রে ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন তিনি। বণিকদের মাঝে যোগাযোগ ও বাণিজ্যিক বিবরণী সংরক্ষণে এর বহুল ব্যবহার শুরু হয় তখন। কিউনিফর্ম লিপিতে প্রচুর সাহিত্যকর্ম ও স্তুতি রচিত হয়েছে তার হাত ধরে। মেসোপটেমীয় দেবী ইনানার শ্রদ্ধার্ঘে তিনি চমৎকার তিনটি মহাকাব্য লিখেছিলেন।

 তিনি ছিলেন চন্দ্র দেবতা নান্না ও দেবী ইনান্নার ধর্মযাজিকা। নান্না ছিলেন উর শহরের পৃষ্ঠপোষক দেবতা। নিজ রাজত্বকালে সম্রাট সার্গন এনহেদুয়ানাকে গুরুত্বপূর্ণ একজন উপদেষ্টা হিসেবে দাবার ঘুটির মতো ব্যবহার করেছেন। সার্গন জানতেন, পুরো সুমেরে নিজের কর্তৃত্ব বিস্তার করতে হলে তাকে অত্যন্ত সাহসী পদক্ষেপ নিতে হবে। হতে হবে সামরিক জ্ঞানে ঝানু, থাকতে হবে সূক্ষ্মতর কূটনৈতিক জ্ঞান। সকল প্রজাকে এক ছাদের নিয়ে নিয়ে আসতে তিনি কাজে লাগালেন ধর্মীয় অনুভূতিকে। 

এখানেই সফলতার সাথে উত্তীর্ণ হয়েছিলেন এনহেদুয়ানা। সুমেরীয় ধর্মমন্দিরে এনহেদুয়ানাকে প্রধান পুরোহিতের আসনে বসানো হয়েছিল। সম্রাট জানতেন, মেসোপটেমিয়ার বিভিন্ন দেবতাকে এক প্যান্থিয়নের অধীনে একীভূত করতে পারবে এই এনহেদুয়ানা। চমক হিসেবে এনহেদুয়ানা দেব-দেবীদের উদ্দেশ্যে স্তোত্র এবং কবিতা রচনা করেছেন বলে জানা যায়। উদাহরণস্বরূপ, সুমেরীয় দেবী ইনানাকে আক্কাদীয় দেবী ইশতারের অনুরূপ হিসেবে বর্ণনা করেছিলেন তিনি। এভাবে উর্বরতা ও ভালোবাসার দেবী ইনানা রূপ নিয়েছিলেন যুদ্ধের দেবী ইশতারে। এভাবে সুমেরীয় দেবকুলে আক্কাদীয় দেবতাদের অন্তর্ভুক্তি ঘটিয়েছিলেন এনহেদুয়ানা।

সার্গনের সরকারব্যবস্থার একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা হিসেবে এনহেদুয়ানা মেসোপটেমিয়ার ব্যস্ততম ও গুরুত্বপূর্ণ শহর ‘উর’ এর মন্দিরের সভাপতি হিসেবে নিযুক্ত ছিলেন। তৎকালে শহরটির জনসংখ্যা ছিল প্রায় ৩৪ হাজারের কাছাকাছি। তবে শহরের মহাযাজিকা হিসেবে, এনহেদুয়ানার ভূমিকা শুধু ধর্মীয় ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ ছিল না। শহরকে শান্তিপূর্ণ এবং স্থিতিশীল রাখার জন্যও তিনি সদা সচেষ্ট ছিলেন। তাকে সেচ এবং শস্যভাণ্ডারসহ শহরের অবকাঠামোগত ব্যবস্থায় অংশ নিতে হয়েছিল। তিনি শহরের বাজার, মন্দির এবং স্মৃতিস্তম্ভসহ বহু প্রকল্পের নির্মাণ নিজে হাতে তদারকি করতেন। স্বপ্নের ব্যাখ্যাও পাওয়া যেত তার কাছে। তার প্রাথমিক উদ্দেশ্য ছিল নব্য আক্কাদীয় সভ্যতার সাথে প্রাচীন সুমেরীয় সংস্কৃতির সংমিশ্রণকে সহজতর করা।

এনহেদুয়ান্নার কাব্যপ্রতিভা তৎকালীন মেসোপটেমিয়ার নারীদের শিক্ষা গ্রহণে এগিয়ে আসতে অনুপ্রাণিত করে এবং রাজবংশের নারীদের কবিতা লিখতে উৎসাহিত করে। একসময় এটা প্রায় অবধারিতই হয়ে ওঠে যে রাজকন্যা ও রাজবধূরা অবশ্যই কবিতা লিখতে জানবেন। যদিও তাঁর সমসাময়িককালে আর তেমন উল্লেখযোগ্য কোনো নারী কবির সন্ধান পাওয়া যায়নি।

২২৫০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে মাত্র ৩৫ বছর বয়সে পৃথিবী থেকে বিদায় নেন পৃথিবীর প্রথম কবি এই মহীয়সী নারী। তিনি কোনো পুরুষ সঙ্গী গ্রহণ করেছিলেন কি না বা কোনো সন্তান জন্ম দিয়েছিলেন কি না—এ সম্পর্কে কোনো তথ্য জানা না গেলেও এটা অনুমিত যে রাজ্যের প্রধান পুরোহিত হওয়ার কারণে হয়তো সংসারের মতো জাগতিক মায়ার বাঁধনে তিনি জড়াননি।

তাঁর কয়েকটি শ্লোকের বাংলায় অনুবাদ। অনুবাদ করেছেন কাজী জহিরুল ইসলাম। 

এনহেদুয়ানার শ্লোক

১.

আমি তোমার এবং সব সময় তোমারই থাকব

তোমার হৃদয় আমার জন্যে শীতল হোক,

তোমার চেতনা, সমবেদনা আমার প্রতি

                        করুণার্দ্র হোক

তোমার কঠিন শাস্তির স্বাদ আমি উপলব্ধি করেছি।

(তৃতীয় লাইনের কিছু অংশ উদ্ধার করা যায়নি। ‘করুণার্দ্র’ শব্দটি যোগ করা হয়েছে চরণকে অর্থবহ করার জন্য। এনহেদুয়ান্নার শ্লোক: ১২)

২.

আমার দেবী, আমি ভূমণ্ডলে তোমার মহানুভবতা ও মহিমা ঘোষণা করছি

আমি চিরকাল তোমার মহানুভবতার

                        গুণগান করে যাব।
(শ্লোক: ১৩)

৩.

রানি যে বড় কাজগুলো করেন তা নিজের জন্য

তিনি জড়ো করেন নিজের স্বর্গ-মর্ত্য

তিনি মহান দেবীর প্রতিদ্বন্দ্বী।

(শ্লোক: ১৬)

৪.

দেবরাজ, শ্বাস-প্রশ্বাস এবং বাতাসের দেবী এই মহাবিশ্বকে করেছে তোমার দিকে ধাবমান

হে দেবীদের দেবী ইনানা, তোমার পদতলে

                        অর্পিত মহাবিশ্ব

তুমিই নির্ধারণ করো রাজকন্যাদের ভাগ্য।

(শ্লোক: ১৮)

৫.

মহীয়সী, তুমি সুমহান, তুমি গুরুত্বপূর্ণ

ইনানা তুমি মহান, তুমি গুরুত্বপূর্ণ

আমার দেবী, তোমার মহানুভবতা উদ্ভিন্ন

আমার দোহাই তোমার হৃদয় ফিরে যাক যথাস্থানে।
(শ্লোক: ১৯)

ডাউনলোড করুন অনন্যা অ্যাপ