ডেঙ্গু সম্পর্কে সচেতন হওয়ার বিকল্প নেই
আমরা জানি, যেকোনো রোগের ক্ষেত্রে প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধই উত্তম। ফলে যেভাবে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েছে তাই এখনই সচেতন নাহলে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থেকেই যায়। ডেঙ্গু প্রতিরোধে যদি প্রত্যেকেই সচেতন হয় তবে হয়তো কিছুটা পরিত্রাণ পাওয়া যেতে পারে। তবে নারীরা এ ব্যাপারে উদ্যোগী হলে পরিবারের সদস্যের খানিক নিরাপদ রাখা যাবে। সেজন্য পরিবারের নিরাপত্তার স্বার্থে নারীদের কিছু বিষয় মাথায় রাখা জরুরি। তাদের সচেতনতা আক্রান্তের সংখ্যা অনেকটা কমিয়ে আনতে সক্ষম।
এবারের ডেঙ্গু গত বছরের চেয়েও প্রকট। একইসঙ্গে ভয়াবহও বটে। জুনের শুরু থেকেই ডেঙ্গুর প্রকোপ বেড়েছে! সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এর ভয়াবহতা থাকে। এই সময়টাতে সবাইকে প্রচণ্ড পরিমাণে সজাগ থাকা জরুরি। আমরা জানি, এডিস মশার লার্ভা থেকেই ডেঙ্গু ছড়ায়। ডেঙ্গু সাধারণত একটি ভাইরাসজনিত রোগ। স্ত্রী এডিস মশার কামড়ে ডেঙ্গু হয়। এ ভাইরাসে সংক্রমিত মশার কামড়ের মাধ্যমে ডেঙ্গু জীবাণু মানুষের মধ্যে ছড়ায়। এই রোগ ছোঁয়াচে না হলেও ডেঙ্গুতে আক্রান্ত কাউকে মশা কামড়ানোর ফলে সেই মশা অন্য কাউকে কামড়ালেও তার মধ্যে রোগটি সংক্রমিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এছাড়া, সংক্রমিত মশার সংস্পর্শে আসা সব বয়সের মানুষই ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে থাকে। তাই সচেতন হওয়ার বিকল্প নেই।
সাধারণত এডিস মশা স্বচ্ছ পানিতে ডিম পাড়ে এবং বংশ বিস্তার করে। তাই খেয়াল রাখতে হবে বাড়ির আশেপাশে বা বাড়ির আঙিনায় কোথাও যেন পানি জমে কি না, খেয়াল রাখতে হবে। যদি এডিস মশা বিস্তারের এমন উৎস পাওয়া যায় তবে তা দ্রুত ধ্বংস করতে হবে।
এছাড়া ডেঙ্গু প্রতিরোধ করতে সবাইকে নজর রাখতে হবে। সেইসঙ্গে মশা যেন আক্রান্ত না করতে পারে এর উপর্যুপরি ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। রাতে মশা যেন কামড়াতে না পারে, সেজন্য মশারি ব্যবহার করতে হবে। এছাড়া দিনেও যেন কামড় না দিতে পারে সেজন্য মশার স্প্রে, মশানাশক ক্রিম ও লোশন ব্যবহার করা যেতে পারে। আরও কিছু পদ্ধতিও গ্রহণ করা যেতে পারে। তার মধ্যে সবচেয়ে ভালো হয় ঘরে বাতাস যাতায়াতের সঠিক ব্যবস্থা রেখে নিরাপত্তা নিশ্চিত করলে। এজন্য এখন অনেক বাড়িতে মশারির মতো ছোট জাল বা নেটের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। ডেঙ্গু প্রতিরোধে জানালায় এ ধরনের ব্যবস্থা করলে অনেকটা নিরাপদে থাকা সম্ভব। যেহেতু এডিস মশা গোধূলি-লগ্নেই বেশি কামড়ায় তাই দুপুর গড়িয়ে সন্ধ্যা নামের আগেই ঘরের জানালা-দরজা বন্ধ রাখা উচিত। পর্যাপ্ত সতর্কতা অবলম্বন করলে এর ভয়াবহতা থেকে অনেকটা নিরাপদে থাকা সম্ভব। আর এবারের এডিস মশা অন্য বছরের তুলনায় বেশি বিষাক্ত হয়ে উঠেছে। আর যে হারে মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হচ্ছে তাতে সাবধানে থাকতেই হবে সবার নিরাপত্তার স্বার্থে।
তবে ডেঙ্গু প্রতিরোধে সচেতনতার পাশাপাশি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা অতীব জরুরি। বাড়ির আশেপাশে স্বচ্ছ পানি জমে থাকলে সেখানে মশার লার্ভা সৃষ্টি হয়। এডিস মশা রোধ করতে এর বংশবিস্তার আটকাতে হবে। নারীরা যেহেতু তার পরিবার-পরিজন সবারই খেয়াল রাখেন এবং ঘরের কোথায় কী আছে, না আছে সেসব সহজেই নজরে রাখেন সেক্ষেত্রে ডেঙ্গু থেকে রক্ষা পেতে নারীদের সচেতন হওয়া আবশ্যক।
এখন পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর যে রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে সেখানে নারীর সংখ্যাই অধিকাংশ। আইইডিসিসিআর – এর এক রিপোর্টে দেখা গেছে যেই নারীদের মৃত্যু হয়েছে তাদের অধিকাংশের বয়স ১৮-৪০। তবে এই বয়সের নারীদের মৃত্যুহার কেনো বেশি সে সম্পর্কে কোনোই সুরাহা হয়নি!
চলতি বছর ২৮ হাজার ৪৪৩ জন ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে । আর মারা গেছে ১৫৬ জন। এর মধ্যে নারী ৮৯ জন। পুরুষ ৬৭ জন। এ সময়ে রাজধানী ঢাকায় সাড়ে ১৭ হাজার ভর্তি রোগীর মধ্যে ১২২ জন ও সারাদেশে সোয়া আট হাজার ভর্তি রোগীর মধ্যে ৩৪ জনের মৃত্যু হয়েছে।
অন্যদিকে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যার হিসাবে ১৮ থেকে ৪০ বছর বয়সী পুরুষের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। মোট রোগীর সোয়া নয় হাজারই এ বয়সী পুরুষ। এ বয়সী রোগাক্রান্ত নারীদের সংখ্যা প্রায় পাঁচ হাজার। রোগতত্ত্ববিদরা বলছেন, চিকিৎসকের কাছে দেরিতে আসার কারণে চলতি বছর ডেঙ্গু রোগীর মৃত্যুহার বেশি। একই সঙ্গে এ বছর এডিস মশার আচরণ পরিবর্তন ও ভাইরাসের রূপান্তরের কারণে মৃত্যু প্রভাবিত হচ্ছে। বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ বা গবেষণা না থাকায় এ বয়সী নারীদের মৃত্যু বেশি হওয়ারও সঠিক কারণ জানা যায়নি। তবে সবার সচেতনতাই পারে ডেঙ্গু মহামারী থেকে জাতিকে রক্ষা করতে। শুধু সরকারি উদ্যোগের ওপর ভরসা করে থাকা বোকামি। রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার পাশাপাশি সবাইকে ডেঙ্গু সম্পর্কে সচেতন হতে হবে।
এদিকে ডেঙ্গুর সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী, সারা দেশে চলতি বছর ডেঙ্গুতে ২২৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। শুধু রাজধানী ঢাকায় ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন ১৮০ জন।
বর্তমানে দেশের বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে মোট ৮ হাজার ৪৬৭ জন ডেঙ্গু রোগী চিকিৎসাধীন। এর মধ্যে ঢাকায় ৪ হাজার ৮০৯ জন এবং ঢাকার বাইরে ৩ হাজার ৬৫৮ জন রোগী ভর্তি রয়েছেন। ঢাকাসহ সারাদেশে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বাড়ছেই। ভাইরাস ও ডেঙ্গু জ্বরের মধ্যে সূক্ষ্ম পার্থক্য রয়েছে। তাই ডেঙ্গুর উপসর্গগুলো সম্পর্কে জেনে রাখা প্রয়োজন।
ডেঙ্গু জ্বরের তীব্রতা অনেক বেশি হয়। ডেঙ্গুতে শরীরের তাপমাত্রা প্রায় ১০৪ ফারেনহাইট ওঠে। এই জ্বর ২ থেকে ৭ দিন পর্যন্ত স্থায়ী হয়। জ্বর ছাড়াও মাথাব্যথা, গা-হাত-পায়ে ব্যথা, গাঁটে ব্যথা, ডায়রিয়া ও বমি বমি ভাব দেখা দেয়। শরীর অত্যন্ত দুর্বল হয়ে পড়ে। পাশাপাশি গায়ে র্যাশ উঠতে শুরু করে। এছাড়া মাড়ি ও নাক দিয়ে রক্তপাত, গলাব্যথা ইত্যাদি উপসর্গও দেখা দেয়। ডেঙ্গু সংক্রমণের প্রাথমিক পর্যায়ে অন্য কোনো লক্ষণ বা উপসর্গ ছাড়া শুধু জ্বর হয়, তখন সেগুলোকে ফ্লু ভেবে ভুল হতে পারে। এ ধরনের লক্ষণ দেখা দিলে দ্রুত ডাক্তারের পরামর্শ গ্রহণ করতে হবে।
বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ডেঙ্গু রোগীকে বাড়িতে রেখেই চিকিৎসা করা হয়। অবস্থার অবনতি হলে রোগীকে হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে। ডেঙ্গুর শক সিনড্রোম তৈরি হলে শরীর ডিহাইড্রেটেড হয়ে যায়। তখন পালস রেট বেড়ে যায় এবং রক্তচাপ কমে যায়। ফলে শরীর ঠান্ডা হয়ে যায় এবং দেহে অস্বস্তি তৈরি হয়। এমন অবস্থা তৈরি হলে রোগীকে দ্রুত হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে।
ডেঙ্গু জ্বরের জন্য নির্ধারিত কোন ওষুধ নেই। তবে ডাক্তাররা প্যারাসিটামল জাতীয় ওষুধ খাওয়ার পরামর্শ দেন। ডেঙ্গু হলে শরীরকে পানিশূন্য হতে দেয়া যাবে না। তাই প্রচুর পরিমাণে পানি পান করুন। পাশাপাশি তরল জাতীয় খাবার বেশি পরিমাণে গ্রহণ করুন। যেমন-ডাবের পানি, ফলের রস, স্যুপ, চিকেন সুপ খেতে পারেন। দিন দিন বাড়ছে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা। সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে এর ভয়াবহতা। রোগীর ভিড় সামাল দিতে হাসপাতালগুলোরও হিমশিম অবস্থা।
এই পরিস্থিতিতে খাওয়া-দাওয়া ও দম ফেলার ফুরসতও নেই স্বাস্থ্যকর্মীদের। তাই তাদের প্রতিও মানবিক হওয়া আবশ্যক। আমরা একটা সময় পার করছি। যেহেতু ডেঙ্গুর প্রকোপ এতটাই বৃদ্ধি পেয়েছে ফলে সবার ঐকান্তিক সহযোগিতায় পারে এ থেকে জাতিকে রক্ষা করতে।
অনন্যা/ ডিডি