Skip to content

স্বপ্নভঙ্গের যাত্রা

স্বপ্নভঙ্গের যাত্রা

 

মার্চের সাধারণ ছুটির পর থেকেই রীতিমত থমকে গেছে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা। অনেক কিছুই স্থবির হয়ে গেছে।  কিছু ব্যবসা বাণিজ্য সীমিত আকারে চালু হলেও নেই বেচাকেনা।  দোকান ভাড়াই আসছে না, কর্মচারীদের বেতন আসবে কোথা থেকে? কেই অর্ধেক, কেউ তিনভাগের একভাগ বেতন পেয়েছেন।  এই বেতন ঘরভাড়াতেই চলে যায় নিু মধ্যবিত্তের-সংসার চলবে কীভাবে? এরকম অনিশ্চয়তার মধ্যেই কেউ কেউ পরিবারকে বাড়িতে পাঠিয়ে নিজে ঢাকায় থেকে গেছেন চাকরি রক্ষায়। কেউ কেউ চাকরি হারিয়েই উঠেছেন গ্রামে।  এরকম মহামারী এই একুশ শতকে এসে কেউ ঘুণাক্ষরেও কল্পনা করেনি।  

রাজধানীর প্রায় প্রতিটি এলাকা থেকেই কম-বেশি এমন পরিস্থিতির খবর পাওয়া যাচ্ছে। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রোধে টানা ৬৬ দিন সবধরনের প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখা হয়। সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে এমন কঠোর নির্দেশনায় এই দীর্ঘ সময়ে অচল হয়ে পড়ে দেশের অর্থনীতির চাকা, যা এখনও ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। দিনমজুর থেকে শুরু করে সচ্ছল চাকরিজীবীদের মাঝেও এর প্রভাব পড়েছে। করোনার কারণে নব্য দরিদ্র গোষ্ঠীর সৃষ্টি হচ্ছে।  তাদের কোনো সামাজিক সুরক্ষা নেই। নতুন মধ্যবিত্ত গোষ্ঠীর সৃষ্টি হয়েছিল, তারাও হয়তো নব্য দরিদ্রে পরিণত হবে।  বেসরকারি সংস্থা র্ব্যাক বলছে, এই সময়ে ৯৩ শতাংশ মানুষের আয় কমে গেছে। এখন এই কমে যাওয়া আয়ের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে করোনা পরবর্তী পৃথিবীতে টিকে থাকা নিঃসন্দেহে কঠিন হয়ে পড়বে।

করোনাভাইরাসের প্রভাবে চরম বেকায়দায় পড়েছেন ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তারাও। অনেকে ব্যবসা বদল করে ফেলেছেন।  লম্বা সময় ধরে ব্যবসা-বাণিজ্যে মন্দা থাকায় নিজের সঞ্চয় ও পুঁজি ভেঙে চলতে হচ্ছে। অনেক ব্যবসায়ী এখন দেউলিয়ার পথে।  ক্রেতা নেই, লেনদেনও কম। কিন্তু অফিস-কারখানা ভাড়া, কর্মচারীর বেতন, পারিবারিক খরচ সবই আগের মতো দিতে হচ্ছে। ফলে আয় না থাকায় বাধ্য হয়েই সঞ্চয় বা পুঁজিতে হাত দিতে হচ্ছে।   পাশাপাশি এই সময়ে আয়েসী জীবন যাপন করা মধ্যবিত্তেরাও সঞ্চয় না করে অতিরিক্ত খরচের বিড়ম্বনা টের পাচ্ছেন। ঢাকায় দিন যাপনের ব্যয় বেড়েছে, খরচের স্বভাবটাও বেড়েছে সেই হারে।  দুই দশক আগের মধ্যবিত্ত পরিবার আর আমাদের জীবনধারায় তফাতটা খেয়াল করেছেন?

যে প্রতি মাসে ৩২ হাজার টাকা বেতন পায় তিন বছর ধরে, নবদ¤পতি যে বাসায় থাকে সে বাসার ভাড়া বেতনের ৬০ শতাংশ।  অথচ সুযোগ ছিল অফিস থেকে খানিকটা দূরে স্বল্প ভাড়ায় থাকার। এই শহরে বেতন যাই হোক, দুই রুম, ড্রয়িং ডাইনিং এটাচ টয়লেট সহ বাসা না হলে  চলেই না।  বা ওয়াশিং মেশিন প্রতিটা পরিবারেই এখন দরকারি- মহা দরকারি।  অথচ এক সময় বাবারা অফিসের প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকা দিয়ে একটা ফ্রিজ কিনতেন। এখন আমাদের আছে ইআমআই, পকেটে কার্ড থেকে বেহিসেবি ধার নিয়ে চলে বাজারের সবচে দামী এসি কেনা।  ওয়াশিং মেশিন, স্যান্ডুইচ মেকার, ইলেক্ট্রিক কেটলি, টোস্টার, গিজার, ভ্যাকুয়াম ক্লিনার, ব্লেন্ডারের সমন্বয়ে তৈরি আমাদের মায়েদের হাত কত অশ্ব-ক্ষমতার মটরে চলত তাই ভাবছি!

এবার আসেন কিছু টুকিটাকিতে! একটু চেক করে আসেন তো- মশা তাড়ানোরই কত রকম জিনিস আছে আপনার বাসায়? এরোসল, অডোমস, গুডনাইট এক্সপ্রেস, একটা ইলেক্ট্রিক ব্যাট আর কয়েল! প্রতিটি ফ্রিজে ফ্রোজেন ফুড, নানা রকম ফুড ইনগ্রেডিয়েন্টস ঠাসা।  ২০ টাকার গরম মসলার মিনিপ্যাক না চেনা আমরাই এখন অনলাইনে চিজ, সসেজ, মৌরী, অরিগ্যানো, মেয়োনিজ, সয়া সস, চিলি সস, রেড টমেটো সস, হট টমেটো সস, বার বি কিউ সস কিনি।  অথচ আমাদের শৈশবে গোয়ালার দুই পোয়া দুধ কোনদিন বেচে গেলে তবেই সেমাই রান্না হত।  ডানো বা হরলিক্সের ডিব্বাগুলোতে কোনদিন দুধ কেনা হয়নি, এগুলা ১০ টাকায় ডিব্বা হিসেবেই কেনা হত।  

এই যে পরিবর্তন- এতোদিন একে ভেবে এসেছি অর্থনৈতিক সক্ষমতা বৃদ্ধি! আসলে আমরা এক ঘোরের মধ্যে ডুবে নিজেদের পরিবার থেকে শেখা অর্থনৈতিক বুনিয়াদ ভুলে গিয়েছিলাম।  সঞ্চয় না থাকার খেসারত দিতে হচ্ছে এখন।  যারা ঢাকা ছেড়ে যাচ্ছেন তাদের কোনো আয়ের উৎস নেই। সরকারের অনুদান বোধ করি তারা পাননি। আর পেলেও এই টাকায় তাদের চলা সম্ভব নয়। ফলে তারা গ্রামে ফিরে যাচ্ছেন। তাদের ধারণা হয়তো গ্রামে গেলে অন্তত না খেয়ে মারা যাবেন না। এ অবস্থায়  গ্রামে চাপ পড়বে। আÍকর্মসংস্থান সৃষ্টি করে নিতে হবে তাদের। না হলে গ্রামেও তারা একই অবস্থার মুখে পড়বেন।

এই পরিস্থিতি সামলে নিতে আমরা তৈরি তো?