Skip to content

২৫শে অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দ | শুক্রবার | ৯ই কার্তিক, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

জুনকো তাবেই: এভারেস্ট-চূড়ায় প্রথম পা-রাখা নারী

স্বপ্ন দেখতেও নারীদের কিছু বাধ্যবাধকতা থাকে৷ চাইলেই নিজের স্বপ্ন পূরণ তো অনেক দূরের ব্যাপার, স্বপ্ন দেখতে হলেও তাদেরকে মুখোমুখি হতে হয় এক গুচ্ছ বাধাবিপত্তির। তবে ইচ্ছাশক্তি যদি প্রবল হয়, কোনো বাধাই দীর্ঘস্থায়ী হয় না। যুগে-যুগে তা প্রমাণ করেছে বহু নারী। জুনকো তাবেই তেমনই একজন । প্রথম নারী হিসেবে এভারেস্টের চূড়ায় পা রেখেছিলেন তিনি। 

 

খুব ছোটোবেলা থেকেই তাঁর তীব্র আগ্রহ তৈরি হয় পাহাড়-পর্বতের প্রতি। তাঁর জন্ম ২২ সেপ্টেম্বর ১৯৩৯ সালে৷ তখনকার সময়ের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপট ছিল একদমই ভিন্ন, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না৷ এর ওপর তাদের ছিল সাত ভাই-বোনের সংসার। ক্লাইম্বিংয়ে আগ্রহ থাকলেও, পরিবারের পক্ষে তাঁর এই অভিজাত শখ পূরণের সামর্থ্য ছিল না। এক দিকে নারী, অন্য দিকে আর্থিক অভাব। সব-কিছু মিলিয়ে তাঁর স্বপ্ন কেবল স্বপ্নই থেকে যাচ্ছিল। 

 

জুনকো তাবেই: এভারেস্ট-চূড়ায় প্রথম পা-রাখা নারী

 

কিন্তু ওই যে শুরুর দিকেই বলেছিলাম, বাধা ভেঙে এগিয়েছেন বহু নারী। জুনকো তাদের দলেরই একজন। তাঁর জন্ম জাপানে। সামান্য টাকা জোগাড় করতে পারলেই ছুটে যান পাহাড়ে। জাপানের কয়েকটি শৃঙ্গও আরোহণ করে ফেলেন কেবল স্কি-পোল নিয়ে।

 

তখনকার সময় বিভিন্ন দেশের পুরুষরাই সাধারণত পর্বতারোহণে আসতেন। সেখানে পুরুষতান্ত্রিক সমাজ এক গরিব মেয়ের দাপট দেখতে ছিল নারাজ। তাই পদে-পদে হেনস্থা হতে হয়েছে তাঁকে। পুরুষ পর্বতারোহীদের আচরণে ক্ষিপ্ত হয়ে তিনি লেডিস ক্লাইবিং ক্লাব: জাপান (এলএলসি) প্রতিষ্ঠা করেন।

 

জুনকো তাবেই: এভারেস্ট-চূড়ায় প্রথম পা-রাখা নারী

 

টিউশন ও সেলাইয়ের কাজ করে তিনি টাকা জোগাড় শুরু করেন। কখনো কোনো পুরুষ অভিযাত্রী দলের সাথে পাহাড়ে গেলেও তাঁকে দিয়ে করানো হতো রান্না ও বাসনমাজার মতো কাজ। সব পুরুষ সদস্যের মধ্যে একা মেয়ে থাকায় তাঁকে সমাজ থেকে নেহাত কম কথা শুনতে হয়নি। বাসস্থান ফুকুশিমা শহরে তাঁকে নিয়ে রটে বিভিন্ন গুঞ্জন, চরিত্রের দোষও দেয়া হয় একসময়। 

 

তবে এত কিছুর মধ্যেই তাঁর জীবনে আসে জাপানের পর্বতারোহী মাসানুবো তাবেই। তাঁর আর্থিক পরিস্থিতিও ছিল অনেকটা জুনকোর মতোই। মানসিক দিক থেকে তাঁদের অনেক মিল ছিল। ১৯৬৫ সালে তাঁরা বিয়ে-বন্ধনে আবদ্ধ হন। আর বিয়ের পরই তিনি জুনকো ইশিবিশি থেকে হয়ে যান জুনকো তাবেই।  

 

জুনকো তাবেই: এভারেস্ট-চূড়ায় প্রথম পা-রাখা নারী

 

ছোটোখাটো অনেক অভিযান শেষে তাঁর মাথায় চেপে বসে এভারেস্ট জয়ের ইচ্ছে। আর যেকোনো পর্বতারোহীর জীবনের সেরা স্বপ্ন এভারেস্ট জয়। জুনকোও তাঁর ব্যতিক্রম নন। তবে বাধ সেধেছিল সমাজ। তখনকার সময় জাপানে ৩ বছর বয়সের বাচ্চাকে ঘরে রেখে দূর দেশে পাহাড় চড়তে যাওয়া এক ধরনের অন্যায়ই ধরা হতো। কিন্তু জুনকো হার মানতে নারাজ৷ স্বামীর ভরসায় বোনের কাছে বাচ্চাকে রেখে রওনা হয়েছিলেন এভারেস্ট প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে।

 

এভারেস্ট অভিযানের জন্য তিল-তিল করে তৈরি হন জুনকো। টাকার অভাবে চিন থেকে সস্তায় হাঁসের পালক কিনে নিজেই সেলাই করে তৈরি করে নিলেন স্লিপিং ব্যাগ। পুরনো পর্দার কাপড় কেটে তৈরি করেন ট্রাউজার। সব প্রস্তুতির পর দীর্ঘ ট্রেনিংয় শেষে, ১৯৭৫ সালে কাঠমান্ডু দিয়ে দলটি তাদের অভিযান শুরু করে।

 

১৯৫৩ সালে স্যার অ্যাডমন্ড হিলারি এবং তেনজিং নরগে যে পথে এভারেস্টে ওঠেন, তাঁরা সেই পথই অনুসরণ করেন। মে মাসের শুরুর দিকে তাঁরা যখন মাটি থেকে ৬,৩০০ মিটার উচ্চতায় ক্যাম্প করেন, একটা বরফ-ধস তাঁদের ক্যাম্প তছনছ করে দেয়। দলের গাইড এবং মেয়েরা বরফের নিচে চাপা পড়েন।

 

বরফ-ধসে তখন প্রায় ৬ মিনিটের জন্যে অজ্ঞান ছিলেন জুনকো, ততক্ষণে তাঁর শেরপা গাইড তাঁকে বরফের নিচ থেকে বের করে আনেন। কিন্তু সেই প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও হার মেনে পিছিয়ে যাননি জুনকো। দলের সবাই হাল ছেড়ে দিলেও তিনি ছাড়েননি। তাঁর মধ্যে আরো প্রবলভাবে জেঁকে বসেছিল এভারেস্ট জয়ের জেদ। সবাই ফেরার পথ ধরলেও শেরপা আন শেরিংকে সঙ্গে নিয়ে থেকে যান তিনি। 

 

জুনকো তাবেই: এভারেস্ট-চূড়ায় প্রথম পা-রাখা নারী

 

দিন শেষে শেষ-হাসি ফোটে তাঁর মুখেই। বরফ-ধসের ১২ দিন পর, ১৯৭৫ সালের ১৬ মে শেরপা আন শেরিংকে সঙ্গে নিয়ে জুনকো তাবেই পৃথিবীর প্রথম নারী হিসেবে হিমালয়ের সর্বোচ্চ চূড়া এভারেস্ট জয় করেন। পূরণ করেন আকাশ-ছোঁয়া স্বপ্ন, এভারেস্টের চূড়ায় দাঁড়ানো জুনকো তাবেই যেন বুড়ো আঙুল দেখিয়ে দিলেন পুরুষতান্ত্রিক সমাজকে। 

 

এভারেস্ট জয় ছাড়াও জুনকো তাবেই প্রথম নারী হিসেবে সেভেন সামিট (সাত মহাদেশের সাতটি সর্বোচ্চ পর্বতচূড়া) আরোহণ করেন। বিশ্বের প্রায় ৭০টি দেশের সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গে ওঠার রেকর্ড আছে জুনকোর ঝুলিতে। সব প্রতিকূলতার সাথে কঠিন লড়াই করলেও শেষ বয়সে এসে ক্যান্সারের কাছে হার মানেন তিনি। ২০১৬ সালের ২০ অক্টোবর ক্যান্সার আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন লড়াকু এই নারী।

 

 

ডাউনলোড করুন অনন্যা অ্যাপ