ভারতীয় রেনেসাঁর জননী রানি রাসমণি
সমগ্র বাংলার ইতিহাসে খুব কমসংখ্যক নারীই ইতিহাসে নিজের স্থান গড়ে নিয়েছে। বিশেষত ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে বহু প্রগতিশীল এবং সাহসী নারীর দেখা পাওয়া গেছে। ব্রিটিশ উপনিবেশের সময়েও অনেক বিবাহিত নারীকে সামাজিক সংস্কারমূলক কাজে অংশগ্রহণ করতে দেখা গেছে। খুব কম নারীই সে-সময় তাদের বিখ্যাত স্বামীর কৃতকর্মকেও পার করে গেছেন। রানি রাসমণিকে সেই নারীদের প্রথম সারিতে বিবেচনা করা হয়।
ভারতবর্ষের আধুনিক যুগ-উত্তরণের সময়টি খুব আশাব্যঞ্জক কিছুই ছিল না। গোঁড়া ধর্মীয় মতবাদ, বর্ণপ্রথা, কুসংস্কারের অন্ধকারে নিমজ্জিত সমাজব্যবস্থার দিকে আস্তে আস্তে শিক্ষিত বাঙালিদের নজর পড়তে শুরু করেছিল। তবে সব চেয়ে বড় সমস্যা ছিল, পুরুষ-অধ্যুষিত সমাজে নারীদের অবস্থান। সে-সময় অভিজাত সমাজের অনেক নারীর মাঝেই প্রবল ব্যক্তিত্বের ঝলক দেখা গিয়েছিল। তবে রানি রাসমণি যেন উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে কলকাতার জানবাজারে শক্তির স্তম্ভ হয়ে উঠেছিলেন।
রানী রাসমণি কোনো অভিজাত পরিবারের মেয়ে ছিলেন না। কৈশোরের আগেই কলকাতার ধনী ব্যবসায়ী জমিদারপুত্র বাবু রাজচন্দ্র দাসের সাথে তাঁর বিয়ে হয়। এই বিয়ের পক্ষে রাজচন্দ্রের পরিবারের কারো মত ছিল না। কিন্তু রাজচন্দ্র রাসমণিকে ভালোবেসে সবার অমতেই বিয়ে করেছিলেন।
ঘটনাটি ঠিক এমন, রাজচন্দ্র দাস ব্যবসায়িক সূত্রে ত্রিবেনী যাচ্ছিলেন। এমন সময় গঙ্গার ঘাঁটে স্নান করতে যাওয়া এক কিশোরীর রূপ দেখে তিনি মুগ্ধ হন। সে-বার আর ত্রিবেণী যাওয়া হয়নি তাঁর। বরং পরে বেশ কয়েকবার হালিশহরে রাসমণির গ্রামে খোঁজ নিয়েছেন। পরবর্তীতে তিনি রাসমণিকে বিয়েই করে ফেলেন।
রাসমণির মধ্যে সম্ভবত একজন আধুনিক নারীর সব গুণ ছিল। সেটা কিভাবে হলো, তা জানা সত্যিই কঠিন। তবে তা সর্বপ্রথম ধরতে পেরেছিলেন রাজা রামমোহন রায়। রাজচন্দ্রের একজন ঘনিষ্ঠ সহযোগী হওয়ায় তিনি প্রায়ই রাজচন্দ্রের বাড়ি আসতেন। রাসমণি প্রথম থেকেই তাঁর মমতাময়ী প্রকৃতি দিয়ে রাজা রামমোহন রায়কে মুগ্ধ করেন। তিনি আশির্বাদ করে বলেন, ‘আপনি শত শত অসহায় নারীর জীবন থেকে অন্ধকার দূর করুন, আপনি নিজের নাম দ্বারা বেঁচে থাকুন এবং জনসাধারণের রানি হয়ে উঠুন।’
রাজচন্দ্র নিজেও আধুনিকমনস্ক ব্যক্তি। তাই রানি রাসমণিকে তিনি তাঁর নিজের বিচার-বিবেচনার ওপর আস্থা রাখার কথা বলেছিলেন। এই দুজনই দরিদ্র, অসহায়, অবহেলিত মানুষদের সাহায্য করেছেন। রাসমণি নিজেও প্রচুর অর্থদান করতেন। রাজচন্দ্র এ-ক্ষেত্রে স্ত্রীকে কোনোভাবেই বাধা দিতেন না।
দুজনের পাঁচ সন্তান হয়েছিল। সুন্দর একটি পরিবার। কিন্তু ১৮৩০ সালে দুর্ভাগ্যক্রমে রাজচন্দ্র মারা যান। বিধবা অবস্থায় তাঁকে স্বামীর এস্টেটের দায়ভার নিতে হয়। সেখানেই রানি রাসমণি বিচক্ষণতার প্রমাণ দিয়েছেন। তাঁর অধীনে ব্যবসার পসার আরো বাড়তে শুরু করেছিল। তাঁর ব্যবস্থাপনাজ্ঞান বিষয়ে একটি গল্প প্রচলিত আছে।
রাজচন্দ্র থেকে এক বন্ধু মোটা অঙ্কের টাকা ঋণ নিয়েছিল। রাজচন্দ্র মৃত্যুবরণ করলে সেই বন্ধু রানি রাসমণির কাছে গিয়ে অনুরোধ করেন, তাকে যেন সম্পত্তির পরিচালক নিযুক্ত করা হয়। কূটনৈতিক বুদ্ধিসম্পন্ন রাসমণি প্রথমে তাঁকে ঋণ শোধ করতে বলেন। ঋণ শোধ করার পর তিনি ক্ষমা চেয়ে জানান যে, তাঁর মেয়ে জামাই এই এস্টেটগুলোর দেখভাল করতে চাচ্ছে। এভাবে তিনি সম্পর্কের তিক্ততা তৈরি না করেই ঋণ উদ্ধার করেন।
রানি রাসমণি বহু কাজের জন্য সুপরিচিত। নিজে গরিবঘরের মেয়ে, তাই গরিবদের প্রতি তাঁর সহানুভূতি ছিল অনেক। বিশেষত ভারতীয় সংস্কৃতির প্রতি মানুষের ভালোবাসা গড়ে তুলতে তিনি বাবুঘাট, আহিরিতলা ঘাট, নিমতলা ঘাটের মত স্নানঘাট তৈরি করা ছাড়া্ও বেলেঘাটা ক্যানেল, এমনকি মধুমতি কানেক্টিং ক্যানেল তৈরি করার জন্য জমি দান করেছিলেন। কলকাতার ইতিহাসের পরতে পরতে এই স্থানগুলো যেন রানি রাসমণির নাম জারি করে।
দেশের নব্যশিক্ষিত এবং অভিজাত সমাজ ভারতীয় ধর্ম এবং সংস্কৃতির প্রতি সব শ্রদ্ধা হারিয়ে ফেলেছিলেন। ইম্পিরিয়াল লাইব্রেরি, হিন্দু কলেজ থেকে শুরু করে অনেক গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানে তাঁর অবদান আছে। বিদ্যাসাগরের বিধবাবিবাহ আন্দোলনেও তাঁর অর্থাবদান আছে। রাসমণিকে অনেকেই ভারতীয় রেনেসাঁর জননী বলে আখ্যা দেন।
কিন্তু রানি রাসমণির সব চেয়ে বড় কৃতিত্ব ব্রিটিশ রাজের সাথে সংঘর্ষ। ইংরেজদের নৌবাণিজ্য বন্ধ করা প্রয়োজন ছিল। গঙ্গায় জেলেদের মাছ ধরার ওপর কর দিতে হতো। রানি রাসমণি মামলা করে এই অন্যায় কর বাতিল করান। এমনকি পূজার সময় ব্রিটিশ প্রশাসন মিছিল করতে বাধা দেয়। তাদের দাবি এতে শান্তি নষ্ট হবে। কিন্তু রানি রাসমণি সেই মিছিল চালিয়ে যেতে বলেন। ব্রিটিশদের কিছুই করার ছিল না। বিশেষত, বাংলাদেশের মকিমপুরে জোর করে নীলচাষ করানো হতো কৃষকদের। রানি রাসমণি সেখানে গিয়েও এই অত্যাচার থেকে মানুষকে মুক্ত করেন। একই সাথে মধুমতি নদীর সাথে গঙ্গার সংযোগ করার জন্যে তিনি খাল খনন করান।
হুগলি নদীর অনেক জেলের পৃষ্ঠপোষকতার ভার তিনি নিয়েছিলেন। একবার জানতে পারেন, হুগলি দিয়ে ব্রিটিশ স্টিমশিপ যাতায়াত করায় জেলেদের কাজে বিঘ্ন হচ্ছে, তিনি নদীতীরের বড় একটি অংশ লিজ নেন। এতে জেলেদের মাছ ধরার পূর্ণ অধিকার আছে।
রানি রাসমণির বহু কীর্তিই তাঁকে ইতিহাসে স্থান করে দিয়েছে। সমসাময়িক অনেক নারীর চেয়ে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি অনেক পরিণত এবং দৃঢ় ছিল। প্রথম দিকে, স্বামীর অনুকূল অনুমোদন থাকায় হয়তো রানি রাসমণি দান করতে পেরেছিলেন। কিন্তু স্বামীর মৃত্যুর পর তিনি স্বীয় মেধাবলেই সব কিছু করেছেন।
১৮৬১ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি রানি রাসমণির মৃত্যুর হলে জানবাজারে শোকের মাতম ওঠে। ভারতীয় রেনেসাঁর এই জননী এখনো তাঁর সেবার জন্যে বিখ্যাত। এমনকি কলকাতার অনেক স্থানেই রানি রাসমণির নাম জ্বলজ্বল করছে।