মেয়ে, আওয়াজ উপরে!
চারপাশে একদল উন্মত্ত যুবকের চিৎকার, স্লোগান। একা এক তরুণীকে দমিয়ে রাখার প্রচেষ্টা। গেরুয়া উত্তরীয় পরা 'জয় শ্রীরাম' স্লোগান দেওয়া একদল যুবকের মধ্য দিয়ে স্কুটি নিয়ে চলে যায় মেয়েটি৷ বোরখাপরা একা শীর্ণকায় তরুণী স্কুটি থেকে নেমে এগিয়ে আসে তাদের স্লোগানের মুখে। মুখে নেই কোনো ভয় কিংবা চিন্তার চিহ্নমাত্র৷ গলার আওয়াজ তুলে একাই শুরু করেন 'আল্লাহু আকবর' স্লোগান। তার চোখ রাঙানোতে যেন চুপসে যায় পুরো সমাজ।
এমন ঘটনা আমাদের সমাজে সচরাচর চোখে পড়ে না। আমাদের সমাজে নারীদের এতটাই দুর্বল হিসেবে ধরা হয়। একা নারীও যে প্রতিবাদী হয়ে উঠতে পারে, হাজারো শত্রুর সামনে তা আমাদের সুস্থ মস্তিষ্ক ভাবতেই পারে না। সমাজ বরাবরই কিছু অদৃশ্য অস্ত্র দিয়ে মেয়েদের পায়ে শেকল বেঁধে দিতে চায়। যেমন, "মেয়েদের জোরে কথা বলতে নেই। মেয়ে মানুষের গলা যেন দেয়ালও না শুনতে পায়। তুমি মেয়ে, তুমি মাথা নিচু করে হাঁটবে" এগুলো আমাদের বহু পরিচিত কিছু বাক্য। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীদের দমিয়ে রাখার অদৃশ্য কিছু অস্ত্র।
তবে নারীরা বাঁধা ভেঙে এগোতে জানে। যুগে যুগে বহু নারীই প্রমাণ করেছেন, তারা বাধা ডিঙতে ভয় পান না। তেমনি এক নারী মুসকান খান। শুরুর দিকে যাঁর গল্প বলছিলাম৷ যে ঘটনার মধ্য দিয়ে তিনি এখন পুরো বিশ্বের আলোচনায়৷
বাণিজ্য বিভাগে দ্বিতীয় বর্ষে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থী মুসকান। গত এক মাসের বেশি সময় ধরে কর্ণাটকের বিভিন্ন স্কুল-কলেজে হিজাব পরে আসা যাবে না, এই দাবিতে পথে নেমেছে কর্নাটকের কট্টর হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলো। গেরুয়া উত্তরীয় পরে হিজাব-বিরোধী আন্দোলন শুরু করেছে হিন্দু শিক্ষার্থীরা। অন্য দিকে, হিজাব পরে ক্লাস করার অনুমতির দাবিতে আন্দোলন করছে মুসলিম ছাত্রীরা।
এই সব ঘটনার জের ধরেই সম্প্রতি যখন কলেজ চত্বরে হিজাব পরে প্রবেশ করেন মুসকান নামে ওই তরুণী, সে-সময় গেরুয়া উত্তরীয় পরা একদল তরুণ তাঁকে ঘিরে হিজাব-বিরোধী স্লোগান দেয় এবং হেনস্তার চেষ্টা করেন। গত মঙ্গলবার এমন একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে।
ভিডিওতে দেখা যায়, ওই তরুণী স্কুটার পার্কিংয়ে রেখে কলেজ ভবনের দিকে হাঁটছেন। এ সময় গেরুয়া উত্তরীয় পরা একদল তরুণ ‘জয় শ্রীরাম’ স্লোগান দেয় এবং তাঁর দিকে এগিয়ে যায়। পালটা ‘আল্লাহু আকবার’ স্লোগান দেওয়ার সময় ওই তরুণীকে ভীত দেখা যায়নি। ওই সময় হাত ওপরে তুলে ‘আল্লাহু আকবার’ স্লোগান দিয়ে সামনে এগিয়ে যেতে দেখা যায় তাঁকে। একপর্যায়ে কলেজ-চত্বরে থেমে এক ব্যক্তির ক্যামেরার দিকে উদ্দেশ করে স্থানীয় ভাষায় মুসকান বলেন, ‘আমি বোরকা পরলে সমস্যা কী?’ পরে কলেজের অধ্যক্ষ ও অন্যান্য শিক্ষকরা তাঁকে সরিয়ে নেন।
ভারতীয় সংবাদ সংস্থা এনডিটিভিকে দেয়া সাক্ষাৎকারে মুসকান বলেন, গেরুয়া উত্তরীয় পরা তরুণদের সামনে একাই প্রতিবাদ জানানোর সময় কোনও ধরনের ভয় পাননি তিনি। তার ভাষায়, “আমি উদ্বিগ্ন ছিলাম না। আমি যখন কলেজে ঢুকে পড়লাম, তখন তারা আমাকে বাধা দিচ্ছিল। কারণ, আমি বোরকা পরেছি। তারা ‘জয় শ্রীরাম’ স্লোগান দেওয়া শুরু করে। আমিও ‘আল্লাহু আকবার’ বলতে থাকি । কলেজের অধ্যক্ষ ও প্রভাষকরা আমাকে সমর্থন জানান। তাঁরা আমাকে রক্ষা করেন।”
সাক্ষাৎকারে মুসকান আরও বলেন, ‘এটি গত সপ্তাহে শুরু হয়েছে। আমরা সব সময় হিজাব ও বোরকা পরে আসি। আমি ক্লাসে হিজাব পরতাম এবং বোরকা খুলে রাখতাম। হিজাব আমাদের অংশ। আমাদের কলেজের অধ্যক্ষ কখনোই এ বিষয়ে কিছু বলেননি। বহিরাগতরা এটা শুরু করেছে। আমরা হিজাবের জন্য আমাদের আন্দোলন চালিয়ে যাব। এটা একজন তরুণীর মুসলিম হওয়ার অংশমাত্র।’
এ-ছাড়াও মুসকান দাবি করেন, উপস্থিত গেরুয়া উত্তরীয় পরিহিতদের কয়েকজনকে তিনি চিনতে পেরেছিলেন। তবে বেশির ভাগই বহিরাগত। মুসকান জানিয়েছেন, পড়াশোনা করাই তাঁর অগ্রাধিকার। তিনি বলেন, ‘ওরা আমাদের পড়াশোনা করার অধিকারটাই ছিনিয়ে নিতে চায়, এক টুকরো কাপড়ের জন্য।’
উল্লেখ্য, ভারতের দক্ষিণাঞ্চলীয় রাজ্য কর্ণাটকের স্কুল-কলেজে মুসলিম ছাত্রীদের হিজাবপরা নিয়ে শুরু হওয়া এই বিতর্ক তীব্র আকার ধারণ করেছে। এ কারণে এরই মধ্যে রাজ্যটির মুখ্যমন্ত্রী তিন দিনের জন্য সব স্কুল-কলেজ বন্ধ ঘোষণা করেছেন।