বাংলা একাডেমি বনাম গোয়াল ঘর
১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুর জাতির উদ্দেশ্যে একটা শিক্ষণীয় বক্তব্য দিয়ে শুরু করছি, “মাতৃভাষার প্রতি যার ভালবাসা নেই, কিন্তু মাতৃভূমির প্রতি ভালবাসা আছে, এটা বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়।“ এই বক্তব্যের উদ্দেশ্য ছিলো, উনার নির্দেশ দেওয়া শর্তেও সমসাময়িক বাংলাদেশের দাপ্তরিক কাজগুলো বাংলা ভাষাতে সম্পন্ন হচ্ছিল না।
যদিও ২০১৬ সাল থেকে বানান পরিবর্তনের শুরু এই দেশে, কিন্তু ২০২০ সালে এসে আমরা দেখছি, আমরা আমজনতা অত্যন্ত সচেতন আমাদের ভাষা নিয়ে। ফেসবুক, মিডিয়াতে ট্রলসহ কত শত রকম প্রতিবাদ দেখে আমরা আসলেই গর্বিত। যদিও এদের অনেকেই আবার শুদ্ধ বাংলা বলতে ও সঠিক বানান তো জানা দূরের কথা ব্যক্তিগত ও পেশাগতভাবে বাংলা ভাষা ব্যবহারটাকে চূড়ান্ত নিম্নমানের ব্যাপার বলে ভাবেন। যাই হোক, আসুন বাংলা একাডেমির কাজকর্মের একটা হালকা ময়না তদন্ত করি। তারপর না হয় ভেবে নেবো, গোয়াল ঘরে স্থায়ী হবো নাকি বর্জন করবো।
আমরা কি জানি বানান সংস্কার কি? অথবা আসলে বাংলা একাডেমি প্রকাশিত ক’টা অভিধান আমাদের জন্য আছে? অথবা আমরা কি আসলেই অভিধান একটু ঘেঁটে দেখি আর জানতে চেয়েছি এইসব কিছুর ইতিহাস? আচ্ছা বেশি বেশি প্রশ্ন হয়ে গেলো, কিন্তু অমূলক ভাবছি। প্রতিবাদ আন্দোলন যাই হোক না কেন তার আগে আমাদের উচিৎ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে প্রয়োজনীয় জ্ঞান ধারণ করে মাঠে নামা। তাহলে বিজয় নিশ্চিত হবার সুযোগ থাকে বেশি। কঠিন বিষয় গুলো নিয়ে মানুষ কৌতুক করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে কিন্তু এটা নিয়ে পাঠ করতে আগ্রহবোধ করে না। তাই একটু সহজবোধ্য কথা বলতে চাই।
বানান পরিবর্তন নিয়ে এই যে অস্থিরতা, এটা কিন্তু নতুন কিছু নয়। ১৯২৫ সাল থেকে বানান পরিবর্তনের কিছু রীতি ও নিয়মাবলী রয়েছে। ১৮১৭ সালে প্রথম বাংলা থেকে বাংলা অভিধানের সংকলন প্রকাশ করেন রামচন্দ্র বিদ্যাবাগীশ। এটাকে পুর্ণাঙ্গ সংস্কার করে ১৯৯২ সালে বাংলাদেশ প্রকাশ করে “বাংলা একাডেমি ব্যবহারিক অভিধান” নামে। তাহলে বোঝা যায়, এদেশের জনসাধারণ বাংলা ভাষার শুদ্ধতা চর্চার বিষয়টা বেশ পরেই শুরু করেছিল। আদৌতে আমরা ক’জন এটা চর্চা করি, আমার ঠিক জানা নেই।
এরপর আমাদের জন্য আর কিছু অভিধান প্রকাশিত হয়েছে এবং সবগুলো প্রচলিত আছে। উল্লেখযোগ্য হলো, সহজ বাংলা অভিধান, বাংলা ইংরেজি অভিধান, বিবর্তনমূলক অভিধান, বানান অভিধান, আধুনিক অভিধান, সংক্ষিপ্ত বাংলা অভিধান। অভিধানগুলোতে শব্দ নিজ ইচ্ছামতো জুড়ে দেওয়া হয় নি। ইতিহাস বলে, চর্যাপদ থেকে শুরু করে হাজার বছরের প্রাচীন কবি সাহিত্যিকদের উপর অনায়াসে এই দায়ভার দেওয়া যেতে পারে। তাদের লেখাগুলোতে যে শব্দ বানান ব্যবহৃত হতো সেগুলোকেই সর্বপ্রথম অভিধানে সংকলিত করা হয়। উদাহরণস্বরূপ চন্ডিরামকে আনতে পারি, সেখানে চতুষ্পদ প্রাণি “গরুকে গোরু” লেখা আছে।
এখন বিষয়টা হলো আপনি প্রাচীন রচনা পড়তে গিয়ে এমন হঠাৎ ধাক্কা খেতেই পরেন, তাই আপনাকে প্রাচীন বানানটাও জেনে রাখতে হবে। আবার এক জিনিসের একাধিক বানান প্রচলন থাকাটাও কাজের কথা না। যারা প্রতি নিয়ত বানান পরিবর্তন নিয়ে কাজ করছেন, তারা দিন-রাত পার করছেন পুরো নাজেহাল অবস্থায়। কারণ কয়েকটা বিষয় খেয়াল রাখার নিয়ম এই পরিবর্তনের ক্ষেত্রে যা অত্যন্ত কষ্টসাধ্য বলে বিবেচিত। সেগুলো হল, বানানের সমতা রক্ষা, বানানের একাধিক রূপ বর্জন, সার্বজনীন গ্রহণযোগ্যতা, প্রচলিত উচ্চারণের প্রতি মনোযোগ প্রদান, শ্রুতিমধুরতা ইত্যাদি। আসুন এগুলো কিভাবে হচ্ছে হালকা পাতলা বিশ্লেষণে যাই।
সম্প্রতি দেখলাম “ঠেলাগাড়ি বানান ঠ্যালাগাড়ি” হয়েছে। আসলেই খেয়াল করলে বোঝা যাবে, ঠ এ কার দিয়ে আমরা উচ্চারণ করি না। আমরা ঠ য-ফলা ব্যবহার করি মুখে বলার সময়। সংস্কৃত শব্দ হন্ত>হস্ত>হাত এইভাবে উচ্চারণের খাতিরে পরিবর্তন হলে ঠ্যালাগাড়ি কেন আমাদের ঠ্যালা দিচ্ছে এখন! আবার গো-রূপ মানের গরুর মতো রূপ। প্রাচীন অভিধানে গরু বানানটা গোরূ/গোরু দুটো ছিলো। সেটাকে প্রাচীন উৎপত্তির যথার্থতা অনুযায়ী গোরু করা হয়েছে তাতে কেন আমরা বারবার গোয়ালঘরে প্রবেশ করছি।
এবার আসি আমাদের কাছাকাছি উচ্চারণের কিছু বর্ণ সমস্যায়, যার কারণে বানান পরিবর্তন করা হয়েছে সময়ের প্রয়োজনে। ই, ঈ কার, র/ড়/ঢ়, শ/স/ষ, ন/ ণ, ৎ ইত্যাদি জনসাধারণের ভিতর বানান লিখতে গিয়ে বেশ দ্বিধাতে পড়তে হয়। এটাকে সহজ করাটা বাংলা একাডেমির জন্য কতটা অন্যায় তা জাতির বিবেকের কাছেই ছেড়ে দিলাম। আমরা খুবই আবেগপ্রবণ জাতি, ইদানিং বলছি বানানগুলোকে নগ্ন লাগছে। কিন্তু নিজেরা বা আমাদের পরবর্তী যে ভুলে ভরা একটা বাংলা বাক্য লিখে দিশেহারা হচ্ছে তা নিয়ে মাথা ব্যথা নেই। এটাকে সহজ করে দেওয়াটার ভিতর অন্যায় কিছু দেখা যাচ্ছে না।
অবশ্য সম্প্রতি একটা ভয়ানক প্রশ্ন উঠেছে। বাংলা একাডেমি এই “একাডেমী” শব্দটা কেন ইংরেজি মানে! বাংলা কিছু কি ছিল না। খুব গভীরে ব্যাখ্যাতে না যাই। আপনি আমি কি কেদারা বা চৌপায়া/চোপায়া বলি? বুঝতে কষ্ট হচ্ছে না তো! চেয়ার , টেবিলের বাংলা এগুলো। আসলে বাংলা কিন্তু খুব সমৃদ্ধশালী শব্দ। ভিনদেশী প্রচুর শব্দ আমাদের বাংলা শব্দ হিসেবে জায়গা করে নিয়েছে যার বাংলাটা জানা বা প্রয়োগের আমাদের কোনো আর প্রয়োজনই নেই। তবু ইংরেজি থেকে সরাসরি বাংলা বানান লিখতেও কিছু নিয়ম আছে। যেমন “একাডেমী” শব্দটা ইংরেজি থেকে সরাসরি লেখা হতো এক সময়, কারণ লং ভাওয়েল উচ্চারণ হলে সেটাতে ঈ কার ব্যবহার করা হতো। এটাকে পরবর্তীতে বাংলা রূপ দিতে ই কার দিয়ে “একাডেমি” করা হয়েছে এবং বাংলা রূপ দান করা হয়েছে। কিছু বিশেষ্য আছে , কিছু রেজিস্ট্রার্ড বানান আছে যা পরিবর্তন করার নিয়ম নাই। যেমন, “আওয়ামী লীগ” এখানে দুইবার ঈ কার ব্যবহার করা হয়েছে। এখানে কোনোভাবেই ই-কার দেওয়া যাবে না, কারণ এটা এটা একটা রেজিস্ট্রার্ড শব্দ। আমরা করব/ করবো, লিখন/ লিখবো, পড়ব/পড়বো এই বানান নিয়েই চিন্তিত হই কারণ দুই রকম বানানই আমরা দেখি। বানান রীতির ধারা নীতি ২.৩ অনুযায়ী দেখা যায় ক’টা জায়গা বাদে এমন বানানের ক্ষেত্রে ও কার বাদ দেওয়া যাবে, যা আমরা অনেকেই জানিই না। আবার অনেক ক্ষেত্রে ভাষায় লিঙ্গ বৈষম্য দূর করার চেষ্টা চলছে। যেমন শিক্ষিকা লেখিকা ইত্যাদি না লিখে সার্বজনীনভাবে নারী পুরুষ সবাইকে শিক্ষক , লেখক বলা হচ্ছে। এটা মেনে নেওয়া কষ্ট হবার কথা না।
এবার একটু আসি বাংলা ভাষাতে কয়জন মানুষ শ্বাস নেন প্রতিদিন এই পৃথিবীতে তার হিসেবে। এথনোলগ এর বিশতম সংস্কার আমাদের জানাচ্ছে , ২০১৭ সালের হিসাব অনুযায়ী, মোট ২৭ কোটি মানুষ আছেন বাংলা ভাষাকে বাঁচিয়ে রাখতে। বাংলাদেশে প্রায় ১৭ কোটি মানুষ থাকলে বাকি ১০ কোটি আছেন ভারত ও অন্যান্য দেশে প্রবাসী হিসেবে। বাংলাদেশ, ভারত, সিয়েরালিয়ন মোট তিনটা দেশের দাপ্তরিক কয়েকটা ভাষার ভিতর বাংলা ভাষা একটি। তাহলে বানান পরিবর্তনের ক্ষেত্রে এই সকল জাতির দিকগুলোকেও বিবেচনাতে আনা দরকার।
তবে ভুল যে বাংলা একাডেমির নেই একদমই তা নয়। অনেক দেশের বড় বড় অনেক ভাষা গবেষণা প্রতিষ্ঠানও ভুল করেন। কোনো কিছু অমার্জিনীয় ভুল নয়। আমরা সাধারণ জনগণ সীমিত জ্ঞানে বানান পরিবর্তনের ক্ষেত্রে বাংলা একাডেমিকে কিছু বিষয় বিবেচনায় আনতে বলতে পারি অত্যন্ত বিনয়ের সাথে। আর বিনয়টা এই জাতির একটা বড় ও ঐতিহ্য বলেই সারাবিশ্ববাসী জানেন। আর আমরা অবশ্যই সেটা ধরে রাখব।
বিবেচ্য বিষয়গুলো হলো, প্রথমত, অবশ্যই বানান পরিবর্তনকালীন একটা বানান পরিবর্তনকারী নির্বাচিত ও গ্রহণযোগ্য প্যানেল থাকবে। সংস্কারকৃত অভিধান প্রকাশকালে অবশ্যই সেই পুরো প্যানেল পরিচিতিও প্রকাশ করা হবে। দ্বিতীয়ত, জনগণের মতামতকে গুরুত্ব দিতে হবে। তৃতীয়ত , প্রথমে বানান পরিবর্তনের জন্য প্রস্তাবনা রেখে আলোচনা, মত আদান প্রদান করা যেতে পারে বিশেষজ্ঞগণ ও সাধারণ জনগণের মাঝে বিভিন্ন গণমাধ্যমের সাহায্যে। চতুর্থত, চূড়ান্ত বানান পরিবর্তনের পূর্বে বিভিন্ন মানসম্মত বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষাতত্ত্ববিভাগকে এই ব্যাপারে গবেষণার জন্য আমন্ত্রণ জানালে কাজটি আরো শুদ্ধতা পাবে ও গ্রহণযোগ্য হবে। সর্বশেষে বলা যেতে পারে, এমন একটা অভিধান আসুক যেখানে শব্দটির উৎপত্তি, প্রাচীন প্রয়োগসহ বর্তমান প্রয়োগ, অর্থসহ বিশদ বর্ণনা থাকবে, তাহলে অনেক তর্ক, মন খারাপের অবসান হবে।
আসুন ভাষার বিশুদ্ধতা চর্চায় মন দেই, গালিগালাজ বা বোকামিতে নই। কারণ আমরা যে অত্যন্ত সাহসী ও বুদ্ধিমান জাতি, এটা যেনো কখনোই আমরা ভুলে না যাই।
লেখক: প্রভাষক, আহসানিয়া মিশন কলেজ, ঢাকা।
প্রবন্ধ লেখক ও গল্পকার