গান্ধারী: নির্মমতার বলি এক মহিয়ষী
মহাভারতের একটি অন্যতম ক্রিয়াশীল নারী চরিত্র গান্ধারী। গান্ধার দেশের রাজকন্যা বলেই তার নাম গান্ধারী । পিতা রাজা সুবল ও ভাই শকুনি। গান্ধারী ধৃতরাষ্ট্রের স্ত্রী। দুর্যোধন ও দুঃশাসনসহ ১০১ সন্তানের মা। মহাভারতের যুদ্ধের বীজ গান্ধারীকে কেন্দ্র করেই মূলত সংঘটিত হয়েছে।
হস্তিনাপুরের মাতা সত্যবতীর নির্দেশে ধৃতরাষ্ট্রের বিয়ে গান্ধারীর সঙ্গে ঠিক করে অতন্দ্র প্রহরী ও কর্ণধার দেবব্রত ভীষ্ম। সবকূল বিবেচনায় গান্ধার রাজা সুবলও কন্যাকে ধৃতরাষ্ট্রের সঙ্গে বিয়েতে অমত করেন না। গান্ধারীও মাতা-পিতার ইচ্ছেকে সমর্থন করেন। জন্মান্ধ স্বামীর সঙ্গে একাত্মা হতেই গান্ধারী প্রতিজ্ঞা করে বস্ত্রখণ্ড দ্বারা নিজের চোখ বেঁধে রাখবেন। গান্ধারীর এই পদক্ষেপ আপাতদৃষ্টিতে ভালোবাসার নিদর্শন মনে হলেও শোষণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদই মুখ্য।
সুন্দরী, শিক্ষিত হলেও নিজের রুচি-অভিরুচিকে গুরুত্ব দিয়ে সে সঙ্গী নির্বাচন করতে পারেননি। রাজার নির্দেশে যেমন প্রজার গলা কাটা যেতেই পারে, তেমনি রাজ্যকে সুরক্ষিত রাখতে ধৃতরাষ্ট্রের হাতেই নিজেকে সমর্পণ করেন। কিন্তু গান্ধারী অন্যায়ের নীরব প্রতিবাদ করলেও তাকে গতি দিয়েছে গান্ধার রাজ শকুনি। তার জটিলজালে একসময় হস্তিনাপুরের রাজ শাসন টলমলে হয়ে পড়ে। গান্ধারীর হতভাগ্য-নির্মমতার প্রতিশোধের বীজই অঙ্কুরিত হয় কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধেও।
গান্ধারীকে শতপুত্রের বর দেন ব্যাসদেব। যথাসময়ে গান্ধারী অন্তঃসত্ত্বা হন। অথচ এরপর দুই বছরেও তিনি কোনো সন্তান জন্ম দিতে পারেননি। এদিকে কুন্তীর সূর্যতূল্য সন্তান জন্মগ্রহণ করলে ধৃতরাষ্ট্রের লাঞ্ছনার শিকার হন গান্ধারী। একসময় দুঃখ-কষ্ট সহ্য করে ধৃতরাষ্ট্রের অজ্ঞাতেই গর্ভপাত করেন তিনি। ফলে তার গর্ভ থেকে একটি লৌহ-কঠিন মাংসপিণ্ড নির্গত হয়। ধৃতরাষ্ট্রের আশা ভঙ্গ হওয়ায় গান্ধারীকে ত্রাসের মুখে পড়তে হয়। মানসিকভাবে প্রচণ্ড বিধ্বস্ত হয় গান্ধারী! পরবর্তী সময়ে ব্যাসদেবের নির্দেশে মাংসপিণ্ডটি শীতল জলে সিক্ত করে একশত ভ্রূণে বিভক্ত করেন ব্যাসদেব। ভিন্ন ভিন্ন ঘৃতপূর্ণ কলসীতে রাখেন। এরই মধ্যে বছর পার হয়। সবগুলো ঘৃতপূর্ণ কলস থেকে একে একে বের হয় শত পুত্র ও একটি কন্যা। কন্যার নাম দুঃশলা। ধৃতরাষ্ট্র ও গান্ধারীর শতপুত্রের মধ্যে জ্যেষ্ঠ দুর্যোধন, তারপর দুঃশাসন, বিকর্ণ প্রভৃতি।
শত পুত্র-কন্যা জন্মগ্রহণ করলেও গান্ধারীর ভাগ্যে শান্তি মেলেনি। বরং পাণ্ডবদের প্রতি নিত্যই শত পুত্রের নির্মম অত্যাচারে বিব্রত হয়েছে। কুন্তীর সামনে অপরাধবোধে ভুগেছে। গান্ধারীর জীবনের সূচনাপর্বেই যে অন্ধকারের ছাঁয়া নেমে আসে শেষপর্যন্ত তা থেকে রক্ষা মেলেনি। দ্যুত সভায় দুর্যোধনের কপটতা ও পাণ্ডবগণের হার, দ্রৌপদীকে সভামধ্যে অপদস্ত করার পর গান্ধারী একাধিকবার দুর্যোধনকে পরিত্যাগ করার জন্য ধৃতরাষ্ট্রকে অনুরোধ করে। কিন্তু পিতৃস্নেহে অন্ধ ধৃতরাষ্ট্র অনুরোধ উপরোধের ধার ধারেনি। ধৃতরাষ্ট্র জন্মাগত অন্ধ আবার হৃদয়গতদিক থেকেও অন্ধ তাই সন্তানের অন্যায় মার্জনা করেন। কিন্তু কুন্তীর ও পাণ্ডবদের অপমানে গান্ধারীও অপমানিত হন। ফলে সন্তানকে নিজেও এই দোষে ক্ষমা করতে পারেননি।
গান্ধারীর চোখে কাপড় বাঁধা থাকলেও তার মন ছিল উন্মুক্ত। অন্যায়কে সমর্থন করেননি কখনো। ভাই শকুনিকে বার বার সন্তানদের সঠিক সঙ্গ দেওয়ার পক্ষ বললেও কাজ হয়নি। মহাভারতে গান্ধারীও নির্মমতা, নিপীড়নের শিকার।
দুর্যোধনের হাতেই কৌরবকুল ধ্বংস হবে, আগে জেনেছিলেন গান্ধারী। তাই তাকে ত্যাগ করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সেখানেও গান্ধারীর মতের গুরুত্ব দেননি ধৃতরাষ্ট্র। গান্ধারী সাধারণ নারীদের প্রতিনিধি। অন্যায়-অত্যাচারে বিপর্যস্ত হয়েছেন বারবার।
গান্ধারী পণমুক্ত পাণ্ডবদের অর্ধরাজ্য দান করে সন্ধিস্থাপনের যথাসাধ্য চেষ্টা করে। বারো বছর বনবাস এবং এক বছর অজ্ঞাতবাসের পর পাণ্ডবগণ যখন তাদের হৃতরাজ্য পুনরুদ্ধারের জন্য হস্তিনাপুরে দূত প্রেরণ করে, তখন গান্ধরী দুর্যোধনকে বোঝাতে চেষ্টা করেন। ধর্মহীন ঐশ্বর্যপ্রাপ্তির ফলে ধ্বংস নিশ্চিত। দুর্যোধন মাতৃবাক্যকেও অবজ্ঞায় ভাসিয়ে দেয়। সন্তানের প্রতি গান্ধারীর ভালোবাসা থাকলেও বিরাগও ছিল। প্রতিনিয়ত পাণ্ডবদের সঙ্গে দ্বন্দ্ব গান্ধারীকে বিশেষভাবে বিচলিত করেছিল। কারণ গান্ধারী জানতো তার সন্তানেরা অধর্মের পক্ষে এবং পাণ্ডবদের পক্ষে স্বয়ং কৃষ্ণ। ফলে তার সন্তানদের ধ্বংস সুনিশ্চিত। গান্ধারীর উপদেশ, শঙ্কাকে অবজ্ঞা করে দুর্যোধনরা নিজেদের ধ্বংস ডেকে আনে।
কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের আগে দুর্যোধন মায়ের আশীর্বাদ ভিক্ষা করতে আসে। সেখানেও গান্ধারী শতপুত্রকে সৎ পরামর্শ দেন। বলেন, যেখানে ধর্ম, সেখানেই জয়। তবুও দুর্যোধনের রাজ্যপ্রাপ্তির নেশা তাকে প্রতিশোধে অন্ধ করে দেয়। আঠারো দিনের যুদ্ধে এগারো অক্ষৌহিনী কৌরব সেনা নিহত হয়। দুর্যোধনদের পরাজয় ঘনিয়ে আসে। গান্ধারীর চোখ বাঁধা ছিল বলেই তিনি দৈব শক্তি অর্জন করেন। যুদ্ধকালে মায়ের আশীর্বাদ প্রাপ্ত হলেও শতপুত্রকে রক্ষা করতে পারেননি গান্ধারী। একসময় পাণ্ডবদের জয় ও নিজ সন্তানদের হীনদশা দেখে অপ্রকৃতস্থ হয়ে পড়েন। যুদ্ধ শেষ হলে পাণ্ডবরা জয়ী হলে গান্ধরী শত পুত্রকে হারিয়ে ক্রোধে ফেটে পড়েন। কৃষ্ণকে অভিশাপ দেন।
গান্ধারীর উপস্থিতি মহাভারতে বিশেষভাবে সক্রিয় কিন্তু শান্তির আভাস তার জীবনে পরিলক্ষিত হয় না। রাজ্যকে টেকাতে যে পদক্ষেপ নেন, পরবর্তী সময়ে সেটাই তাকে পরিপূর্ণরূপে বিধ্বস্ত করে। মায়ের কাছে সন্তানই পৃথিবী। কিন্তু শকুনির সংস্পর্শে গান্ধারীপুত্র ধর্ম ছেড়ে অধর্মের পথে হাটতে শুরু করে। আর একপর্যায়ে গান্ধারী সব হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়েন।
শেষবয়সে গান্ধারী ও ধৃতরাষ্ট্র পাণ্ডবদের অনুমতি নিয়ে বানপ্রস্থ অবলম্বন করে গঙ্গাতীরে শতযূপের আশ্রমে বাস করতে শুরু করেন। বনবাসকালে শুধু জলপানেই গান্ধারী তপস্যারত থেকেছেন। তিন বছর বানপ্রস্থে বাস করতে থাকেন গান্ধারী, ধৃতরাষ্ট্র। অকস্মাৎ দাবানলে বানপ্রস্থেই প্রাণত্যাগ করেন তারা। গান্ধারীর জীবন সাধনার। শেষপর্যন্ত সেটাই তার ভাগ্যের পরিহাস!
অনন্যা/এসএএস