পরীমনিদের খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে সমাজ কী সুখ পায়
পরীমনি আসলে পরীর মতোই সুন্দর। অদম্য সাহস, যোগ্যতা এবং দক্ষতা দিয়ে বর্তমান চলচ্চিত্র জগতের এক অন্যতম তারকা। শৈশবে পিতৃ-মাতৃহীন একজন অনাথ বালিকা কত কষ্টেই না বেড়ে উঠেছেন। প্রতিনিয়ত লড়াই করেছেন বেঁচে থাকার জন্য। কারণ আমরা জানি, ‘অপনা মাঁসে হরিণা বৈরী’। হরিণীর সৌন্দর্যই তার সব অসুখের মূল। পরীও ঠিক তাই। সে যতটা বাঁচার তাগিদে হাত বাড়িয়েছে ততই ফাঁদে পড়েছে। আর ঠিক ততটাই শক্তি নিয়ে আবার উঠে দাঁড়িয়েছে। কারণ পরীমণি জানেন, এ জগতে কেউ কারো নয়। নিজেই নিজেকে দাঁড় না করালে সবাই তাকে পায়ে পিষে চ্যাপ্টা করে যাবে। তবে একটা ভাবনা মাথায় বেশ ঘুরপাক খাচ্ছে: অর্থ, সৌন্দর্য, পরিচিতি কোনোটায় পরীর কম নয়। তবু একজন শরীফুল রাজ তার প্রতি মুগ্ধ নন! কী আজব দুনিয়া! আসলে পুরুষ কী চায় নারীর কাছে!
সংসার যখন ভেঙে যায় তখন অনেকেই নারীকে উদ্দেশ করে বলেন, যদি নিজের প্রতি আরও যত্ন নিতেন, শারীরিক সৌন্দর্যের প্রতি খেয়াল রাখতেন, স্বামীর রুচি-মন-মেজাজ অনুযায়ী পোশাক-পরিচ্ছদ পরিধান করতেন, তাহলে হয়তো সংসার ভাঙতো না। ভেঙেছে কারণ নারী সারাদিন কর্মক্লান্ত হয়ে স্বামীর পাশে যান বাড়ির কাজের মেয়েটির মতো। তার হাতে হলুদ, গায়ের কাপড়ে ঘামের গন্ধ আরও কত কী!
আবার অনেকেই নারীটিকেই বলেন তোর ক্যারিয়ারটকে আরও ফোকাস করা উচিত ছিল। যদি ক্যারিয়ার গঠনে মননিবেশ করতে তবে ঠিক সংসারটা এভাবে শেষ হতো না! সৌন্দর্য, ক্যারিয়ার, পতিভক্তি, সংসারভক্তি, সবটা যোগ্যতা নারীর থাকতে হবেই। কারণ নারী কোনো মানুষ নয়। সে প্রত্যেক পুরুষের কল্পনা ও লালসার সঙ্গী। এককথায় ভোগ্যপণ্য স্বরূপ! যাকে সে নিজ রঙে সাজাতে পছন্দ করে যখন-তখন!
কিন্তু পরীর ক্ষেত্রটা একটু ভাবুন তো, তিনি আমার চোখে দেখা একজন অসম্ভব সুন্দরী নারী। সাহসী। ক্যারিয়ার বেইজড, বিভিন্নভবে আলোচনায় থাকা একজন নারী। ফলে তার পরিচিতিরও ঘাটতি নেই। তবু কেন পরীর কপালে দুর্ভাগ্যের শেষ নেই! পরী কেন সংসার জীবন নিয়ে বারবার মিডিয়ার আলোচনার খোরাক জোগাচ্ছেন।
এ সমাজ কী উত্তর দেবে এর! তবু কিছু উজবুক ও পুরুষতান্ত্রিক ধারাপুষ্টরা পরীর দিকে আঙুল তুলবে। বলবে, তিনি কোনো সংসারই টেকাতে পারেননি! সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ঘাটলে এমন মন্তব্য যে চোখে পড়ে না এমনটা নয়! কিন্তু একবারও কী এসব অমানবিক, অসভ্য বর্বরেরা ভেবেছে, এই নারী বারবার তার সংসার টিকিয়ে রাখতে মরিয়া হয়ে উঠছেন। নিজের ভুল স্বীকার করে ক্ষমা চাচ্ছেন। যদিও ভাইরাল হওয়া ভিডিও ক্লিপে তার সংসার ভাঙনের সুর! কোথায় বিবেকবুদ্ধি এ সমাজের? কোন চক্ষুর জোরে সমাজ নারীর দিকে আঙুল তোলে! পুরুষ কী চায় তথা পরীর দাম্পত্য সঙ্গী কী চায় তার কাছে! যা পরীমনি দিতে ব্যর্থ! আমাদের সাধারণের মনে এর জবাব কী?
প্রকৃতার্থে মানুষ বড্ড বিচিত্র প্রাণী। সে যে কী চায় সে নিজেই বোঝে না। তাইতো ভালোকেও ভালো হিসেবে গণ্য করার চোখ তার অধিকাংশ সময়ই থাকে না। আর পরীমনির ক্ষেত্রে সবটা প্রকাশিত। কোনটাই লুকিয়ে-চুরিয়ে তিনি করেননি। তবে কেনো এমন ভাঙন? কেনো নারীর প্রতি এত অত্যাচার-অন্যায়- অবিচার? পরীমনিরা কী আজীবন এভাবেই পুরুষের শোষণের শিকার হতে হবে! আর এ সমাজ তার অন্ধ চোখ দিয়ে নারীকেই দোষী সাবস্ত করবে! পরীমনির সাংসারিক জীবন তার একান্ত ব্যক্তিগত জীবন। এ বিষয় নিয়ে সাধারণের কথা বলা উচিত নাহলেও সবাই একনাগাড়ে নাক গলিয়ে যাচ্ছে। শুধু নাক গলিয়েই পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ক্ষান্ত থাকছেন না বরং নারীটিকে বারবার কাঠগড়ায় দাঁড় করাচ্ছেন। তার পাপের হিসেব মাপছেন বাটখারা দিয়ে। খুবই হাস্যকর হলেও সত্যি কবি নজরুলের কবিতার সঙ্গে গলা মিলিয়ে বলতেই হয়, ‘ আমরা সবাই পাপী / আপন পাপের বাটখারা দিয়ে অন্যের পাপ মাপি।’ আসলেই তাই বাইরের কিছু দৃশ্যমান চিত্র দেখেই হুমড়ি খেয়ে সবাই পরীমনিকে হেনস্তা করছেন। বিশ্রী কথাবার্তা বলছেন। এ সমাজে নারীর প্রতি এমন অবিচারে অংশ নেওয়া কতটা বিবেকবোধের কাজ!
পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারী তার সবটা দিলেও তিনি হেরে যান। কারণ এ সমাজ নারীকে দোষী করে। সমাজ আঙুল তোলে নারীর দিকে। এই সমাজ বলে নারী তুমি জঘন্য। তোমার যোগ্যতা নাই তাই সংসার টেকেনা। তোমার পতিভক্তি নাই, সৌন্দর্য নাই, টাকাপয়সা নাই, ক্যারিয়ার নাই তোমাকে দিয়ে পুরুষের কী লাভ! কিন্তু একজন শরীফুল রাজকে কয়েকদিন আগেও দেশের নব্বই শতাংশ মানুষ চিনতো না বলেই আঁচ করা হয়। যাকে নিয়ে তিনি আলোয় আসলেন তাকেই ছুঁড়ে ফেলছেন অন্ধকার নরকে। ছোট্ট শিশুটির ভবিষ্যৎ না ভেবে, স্ত্রীর কর্তব্য ভুলে যে পুরুষ নারীকে হেনস্তা করলেন তিনি কারো কটাক্ষের শিকার নন। তাকে কেউ প্রশ্ন করেন না। কারণ তিনি পুরুষ। আর পুরুষের সবটা সাজে! এ সমাজের এই অনৈতিক, অনুদার কালো কাপড়ে বাঁধা চোখ কবে উন্মোলিত হবে?
পরীমনির সংসারিক জীবনও মিডিয়ার খোরাক! প্রতিদিন পত্রিকার পাতা খুললেই রসাত্মক সব হেডলাইনে তাকে শিকারে পরিণত করা হচ্ছে! কারো কোনো মানবিকতা নেই, সভ্যতার নিদর্শন নেই, শুধু প্রতিহিংসা আর কিছু রগরগে উপকরণে জনগণকে বিমোহিত করার পায়তারা। নারীর প্রতি সমাজের এসব নোংরা মানসিকতার অবসান হোক।