Skip to content

২২শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দ | শুক্রবার | ৭ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

বিয়ে, বাচ্চা- সংসারই কি নারীর জীবন?

আমাদের সমাজে আজ অবধি একজন নারীর জীবন কতটা সফল তা নির্ধারণ করা হয় বিয়ে-বাচ্চা ও সংসারের ওপর। ‘নারী সাফল্যে’র নিক্তি আজও এই তিনটি! এরবাইরে নারীর যে আরও বিস্তৃত পরিসর রয়েছে সে সম্পর্কে অধিকাংশ উদাসীন। একজন মেয়েকে জন্মের পরই তার মস্তিষ্কে এই তিনটি বিষয় সফটওয়্যারের মতোই ইনপুট করা হয়। ফলে নারীরাও যত বড় হতে থাকে এই চিন্তাগুলো তাদের ঘিরে ধরো সমাজের বাইরে অধিকাংশ নারীরাও বের হতে পারে না। এমনকি তাকে বের হতে দেওয়া হয় না।
একটা বয়সের পর কোন নারী যদি অবিবাহিত থাকে তবে তার কপালে কী বিরাজ করে তা শুধু নারী মাত্রই অনুধাবন করতে পারো নিয়ে-বাচ্চা এবং সংসারই যে একজন নারীর জন্য সবটা তা আমাদের সমাজ বুঝিয়ে দেয় পদে পদে। কোনো নারী যদি উচ্চ শিক্ষা গ্রহণের পর ক্যারিয়ার গড়ে তোলার প্রতি মনোনিবেশ করেন সেখানে নারীকে অনুৎসাহিত করা হয়। কারণ তার ক্যারিয়ার গড়ায় চেয়ে ভালো নিয়ে হওয়া জরুরি। এ সমাজের চাহিদা এমনভাবে গড়ে উঠেছে অধিকাংশ বিয়ের জন্য পাত্রী খোঁজে স্বল্প বয়সী মেয়ে। এতে করে সংসারের সব ভার নারীটির ওপর বর্তে দিয়ে পুরুষ গায়ে হাওয়া লাগিয়ে ঘুরতে পারেনা এখনও পর্যন্ত অধিকাংশ পুরুষ তার সমবয়সী বা অধিক বয়সী নারীকে স্ত্রীরূপে মানতে নারাজ। বরং পুরুষের চেয়ে নারীর বয়স ন্যূনতম পাঁচ কী দশ বা তারও অধিক হলেই ভালো হয় বলে গণ্য করে। তবে নারীর ক্ষেত্রে এক ইঞ্চি ছাড় নয়। এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজ শিখিয়েছে নারীর অল্প বয়স হলে সংসার সুখের হয়!

এ তো গেলো অল্প বয়সী পাত্রীর প্রতি অদম্য আকর্ষণ। এরচেয়েও নারীর জন্য আরও ভয়াবহ সত্য রয়েছে এ সমাজের অলিতে-গলিতে লুকিয়ে। কোনো পাত্রীর বয়স পঁচিশ-ত্রিশের কোটা পেরুলে এদেশে পাত্র পাওয়া ভার। বলা চলে তাও অধিক বেশি। পাত্রের বয়স যেখানে পঁয়ত্রিশ সেখানে পাত্রী খোঁজা হয় সর্বোচ্চ ইন্টার ফার্স্ট ইয়ারে পড়ে এমনা এদেশের হালচাল বেশিরভাগই এমন!

রবীন্দ্রনাথের যুগে হৈমন্তীর বয়সের জন্যই তাকে প্রতিনিয়ত সমাজের কাছে হেয় প্রতিপন্ন হতে হয়েছে। শেষপর্যন্ত সমাজ থেকে রক্ষা না পেয়ে তাকে মৃত্যুর কোলে ঢোলে পড়তে হয়েছে। সেই যুগ আজও পেরোয়নি এ সমাজ। শুধু কৌশলটা বদল ঘটেছে। আজও এ সমাজ মনেই করে, পৃথিবীতে মেয়েদের জন্ম সংসার-বাচ্চা সামাল দেওয়ার জন্য। যে নারী এ ধরনের কাজ থেকে আজও দূরে সে সমাজের পরিতাজা। মেয়ে হয়ে জন্মালে তার নামমাত্র শিক্ষা হলেই চলবে। তাকে নিজের মেরুদণ্ড গঠনের প্রয়োজন নেই। এ সমাজ আজ অবধি মেরুদণ্ড গঠনের পরিপন্থী। কারণ তারা মনে করে, নারী শিক্ষা-দীক্ষা গ্রহণ করলে সংসারে অশান্তি সৃষ্টি হবে। ফলে মেয়েকে যত দ্রুত সম্ভব বিয়ের পীড়িতে বসাতে হবে। সংসারের ভার পড়লে তার চরিত্র ভালো থাকবে। এককথায় নারী জীবন সার্থক হবো

নারীর জীবনের অর্থ যে, সুবিশাল তা অধিকাংশই মানেন না। কারণ পুরুষতান্ত্রিক সমাজ নারীর বেড়ে ওঠাকে ভয় পায়। নারী যখন নিজের পায়ে ভর করে চলতে পারবে তখন নারীর ওপর নির্যাতন কমাতে হবে। নাহলে নারী এর বিরোধিতা করে নানাবিধ কারণে পুরুষতান্ত্রিক সমাজ নারীকে কুক্ষিগত রাখতে চায়। একজন মেয়ে সন্তান থাকলে অভিভাবকদেরও চিন্তার শেষ নেই। “সুপাত্রে হাতে কনর সন্তানকে তুলে দিতে পারলে পিতা-মাতার মরেও শান্তি।” একথা এ সমাজের অতীব পরিচিত। অর্থাৎ কন্যা সন্তানকে অভিভাবকরা বোঝান, জীবনের সার্থকতা বিয়ে-সংসার জীবন, বাচ্চা লালন-পালনের মধ্যে। আজ অবধি এমন পরিবারের সংখ্যা হয়তো হাতে গোনা যে, তারা কন্যা সন্তানের ক্যারিয়ার গড়ে তোলার প্রতি মনোযোগী!

বিয়ে-সংসার-বাচ্চা নারীর জীবনের সব নয়। বরং একজন নারী যখন সুশিক্ষিত হবেন তখন তার নিজের জগৎ গড়ে উঠবে। যেই জগতের অধীশ্বর সে নিজে। সমাজের হীন মানসিকতাকে ডিঙিয়ে যে নারীরা যোগ্যতা দিয়ে পৃথিবীতে জায়গা করে তারাই শ্রেষ্ঠ। কিন্তু এ সমাজে নারীকে তা করতে দেওয়া হয় না। অধিকাংশ নারীকেই সংসারের বেড়ি পরিয়ে খোয়াড়ে পোরা হয়।

নারীর জীবনের সার্থকতা কখনোই বিয়ে-বাচ্চা-সংসারের মধ্যে হতে পারে না। কিন্তু এ যুগে এসেও অভিভাবক, পাড়া-প্রতিবেশী, শিক্ষিত-অশিক্ষিত সবার মধ্যে জোরালো ধারণা বিয়ে হয়নি মানে মেয়েদের জীবন শেষ। বিয়ের পর বাচ্চা হয়নি মানে আরও জীবন অর্থহীন। আর যদি বিয়ে ভেঙে যায় তাহলে তো নারীর পৃথিবী শেষ। তাকে মৃত্যু পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয় না। এ সমাজ প্রতি ক্ষণে তাকে মৃত্যুর স্বাদ পাওয়ায়। আমাদের সমাজের এমন কলুষতা কবে দূর হবে? এ সমাজ এবং এই সমাজের মানুষের ধারণা আদৌ কি পরিবর্তন হবে? নারী শুধু বিয়ে বা সংসারের সামগ্রী নয়। নারীর আলাদা মনোজগৎ আছে। সেই জগৎকে সুন্দর করে গড়ে তোলার দায়িত্ব যেমন তার তেমনই এ সমাজ-পরিপার্শ্বের। যদি নারীকে সাহায্য করা হয় তবে একদিন নারী সত্যি সবটা সুন্দর করে গুছিয়ে নিতে সক্ষম হবে। কিন্তু যতদিন সমাজের দীনতা-মুর্খতার অবসান না ঘটবে ততদিন নারীকে কঠিন জীবনযাপন করতে হবে!
পুরুষকে গড়ে ওঠার জন্য পরিবার-পরিজন জায়গা ছেড়ে দেয়। আজ অবধি শোনা যায়নি কোনো নারীকে ভালোভাবে বিকশিত হতে তার পাশে কেউ এসে দাঁড়িয়েছে। বরং নারীর যদি কোনো প্রতিভা থাকে সেখান থেকে টেনেহিঁচড়ে নামানোর প্রতিযোগিতা চলে। নারীকে বোঝানো হয় তোমার জন্ম সংসার বাচ্চা সামলানোর। পৃথিবীতে আর কোন স্থান তোমার নেই। ফলে যতটা পারা যায়, পুতুল, রান্নাবাটি খেলার মাধ্যমে কন্যা সন্তানকে সংসারী করে তোলা হয়। ছেলে সন্তানকে গাড়ি, ব্যাট-বল কিনে দিয়ে তাকে উৎসাহ দেওয়া হয় বড় হলে তোমাকে গাড়ি চড়তে হবে। নামী-দামী খেলোয়াড়দের মতো হতে হবে। বন্দুক তুলে দিয়ে শেখানে হর এ সমাজকে শোষণের দায়িত্ব তোমার। আর নারীকে দেওয়া হয় হাঁড়ি-পাতিল-পুতুল। শৈশবকে ঘিরে দেওয়া হয় একটা ব্যারিকেড!
এ সমাজ কিন্তু আজও একচুল পরিবর্তন হয়নি। তাহলে নারীরা কীভাবে একটু হলেও এগিয়েছে! এই এগিয়ে যাওয়া সম্পূর্ণ এই নারীদের মনোবল। নারীর জীবন যে শুধু বিয়ে-সংসার-বাচ্চার মঞ্চে সীমাবদ্ধ নয় তা এই নারীরা নিজেদের অদম্য মনোবল দিয়ে প্রমাণ করেছে। তবু এ সমাজ আজও নারীকে এই পঙ্কে আটকে রাখতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে!

পুরুষতান্ত্রিক সমাজের হীন মানসিকতা দূর হোক। নারী দিগ্বিজয়ী। নারী যেমন সংসার সামাল দিতে পারে তেমনই জীবিকার্জনে বড় পদের দায়িত্ব নিতে পারে। খেলার মাঠে সদর্পে প্রতিপক্ষকে হারাতে পারে। মেয়েদের জন্ম শুধু বিয়ে- বাচ্চা-সংসারের মধ্যে নিহিত নয়। তাই যারা উচ্চ শিক্ষায় অংশগ্রহণকারী নারী, অবিবাহিত নারী, কররিয়ার ফোকাসড নারী, বিবাহিত কিন্তু এখনও বাচ্চা না নেওয়া নারী, সিঙ্গেল নারী দেখলেই নাক সিটকান তারা দূরে থাকুন। এতে আপনারই মুখেরই বিকৃতি বাড়বো যে নারীর প্রতি এমন আচরণ করছেন তার কিচ্ছু হবে না। আর এই কলুষতা দূর করুন। নারীর প্রতি সহমর্মি হয়ে উঠুন। এটাই চাওয়া যে, সবার মনের দৈন্য দূর হোক। মানবিক সমাজ গড়ে উঠুক। বিয়ে-বাচ্চা-সংসারের মধ্যে নারী জীবনের সার্থকতা না খুঁজুক।

ডাউনলোড করুন অনন্যা অ্যাপ