পুরাণ-ইতিহাসের হাম্পি নগরী
রাজবাড়ির ইতিহাস মানেই ভুতুড়ে থমথমে পরিবেশ। বিশাল নকশার আড়ালে থাকা অন্ধকারের মাঝে ইতিহাস, গল্প ও অতীতের গমগমে পরিবেশ যেন বারবার ফিরে আসে। সুনসান এই নীরবতার মাঝে এককালের গমগমে পরিবেশ কল্পনা করতে গেলে আপনাকে ভ্রমণপিপাসু হতে হবে। কিন্তু কোনো স্থাপনা যখন আস্ত শহরের রূপ ধারণ করে, তখন তার রূপ কী দাঁড়ায়? কথা বলছি হাম্পির কথা। পুরনো স্থাপনা কিংবা ইতিহাসের প্রতি আগ্রহ থাকলে হাম্পি হতে পারে আপনার পরবর্তী ভ্রমণস্থল।
দক্ষিণ ভারতের কর্ণাটকে অবস্থিত হাম্পি রাজ্য। এই শহরের প্রতিটি কোণেই মুগ্ধতার রেশ যেন লুকিয়ে আছে। তুন্দ্রভঙ্গা নদীর তীরজুড়ে চোখে পড়বে এক বিশাল শহর। রামায়ণ মহাকাব্যে কিস্কিন্ধ্যা রাজ্য সম্ভবত এখানেই ছিল। তখন তুন্দ্রভঙ্গার নামও ছিল পম্পা। এই পম্পা নাম থেকেই হাম্পি নামটি প্রচলিত হয়। রামায়ণের বর্ণনায় অন্তত এটুকু নিশ্চিত, কিস্কিন্ধ্যা ছিল অপূর্ব সুন্দর এক রাজ্য।
হাম্পিকে চারপাশ থেকে ঘিরে রেখেছে মাতঙ্গ পর্বত, মাল্যবান পর্বত, ঋষ্যমুখ পর্বত এবং পম্পা সরোবর। মহাকাব্যের কাহিনির সঙ্গে বাস্তবের ইতিহাস মিলেছে। রোমাঞ্চের হাতছানি এখানেই। কিস্কিন্ধ্যা অধ্যায়েই রাম-লক্ষ্মণের সঙ্গে হনুমানের দেখা হয়। মূলত এই স্থান থেকেই সুগ্রীব এবং তার বানরবাহিনী সীতাকে খোঁজার অভিযানে নেমে পড়ে। স্থানীয় লোকজন অন্তত সে কথাই বিশ্বাস করে। ফলে বহু বছর ধরে হাম্পি তীর্থযাত্রীদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু। ধর্মীয় গুরুত্ব বিবেচনায় হাম্পি তীর্থযাত্রীদের জন্যে গুরুতপূর্ণ স্থান।
তবে হাম্পির বাস্তবিক ইতিহাস পৌরাণিক ইতিহাস থেকে মোটেও কম নয়। বর্তমানে দর্শনার্থীরা হাম্পি বলতে যে জায়গা চেনেন, তা আসলে বিখ্যাত বিজয়নগরের ধ্বংসাবশেষ। চৌদ্দ শতকে বিজয়নগর অসংখ্য শাসকের অধীনস্থ ছিল। ফলে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ছিল প্রধান বৈশিষ্ট্য। বিজনগর সাম্রাজ্যের অধীনেই হাম্পি যেন সমৃদ্ধ হতে শুরু করে। এ সময় স্থাপত্যশিল্পে বিজয়নগর মুন্সিয়ানা দেখাতে শুরু করে। কারুকার্যখচিত প্রাসাদ, মূর্তি আর মন্দিরে ছেয়ে যায় এই নগর। কিন্তু ১৫৬৫ সালে বিজয়নগর সাম্রাজ্যের পতন ঘটে। এবার হাম্পি মুসলমান শাসকদের অধীনে চলে আসে। বিজয়নগর সাম্রাজ্য অবশ্য সহজে হার মানেনি। তারা একাধিকবার প্রতিরোধ গড়ে তোলে। কিন্তু সুকৌশলী মুসলিম যোদ্ধাদের সঙ্গে পেরে ওঠা এত সহজ হয়নি।
মুসলমান শাসনের অধীনে হাম্পির গর্ব করার মতো স্থাপনাগুলো অচিরেই ধ্বংস হতে শুরু করে। সেই ধ্বংসাবশেষগুলোই এখন দর্শনার্থীদের প্রধান আকর্ষণ। মধ্যযুগের ভারতে হাম্পি এক ধনী শহর হিসেবে সুপ্রসিদ্ধ ছিল। সম্ভবত এজন্যেই পর্তুগিজ ও পারস্যের বণিকরা এই শহরের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে ওঠেন।
৪৬.৮ বর্গকি.মি স্থানজুড়ে হাম্পি পর্বতমালা অবস্থিত। গ্রানাইট পাথরে নির্মিত এই স্থাপনা দেখলে মনে হবে না, এটি মানবনির্মিত। খুব স্বাভাবিক – হাম্পির স্থাপনা নির্মাণের আগে আশেপাশের পাহাড় থেকেই পাথর খুঁজে বের করা হয়। মনোথেলিক স্থাপনাগুলো এখনো পর্যটকদের আগ্রহ ও বিস্ময় আদায় করতে সক্ষম।
কখনো হাম্পি ঘুরতে গেলে লক্ষ করবেন পুরো অঞ্চল দুটো অংশে বিভক্ত। প্রথমত, বাজার ঘিরে রাখা এক ধর্মীয় চত্বর আর কমলাপুরমের রাজকীয় চত্বর। ধর্মীয় চত্বরে ঘুরতে গেলে দেখা মিলবে বিজয়চট্টল মন্দির, লক্ষ্মী নরসিংহ মূর্তি এবং কৃষমন্দির। অন্যদিকে, রাজকীয় চত্বরের প্রধান আকর্ষণ বিশালায়তন প্রাসাদ, জেনানা মহল, হাতিশালা, হাজার রামমন্দির এবং রানির স্নানাগার।
এরমাঝে বিজয়চট্টল মন্দিরটি স্থাপিত হয় ষোল শতকে রাজা কৃষ্ণদেব রাওয়ের শাসনামলে। মন্দিরের চারপাশ ঘিরে রাখা উঁচু প্রাচীর সহজেই মনোযোগ আকর্ষণ করে। দেয়ালের পাথুরে গায়ে সেনাবাহিনী, রণহস্তী এবং নর্তকীর অবয়ব খোদাই করা। চোখ বুলালেই প্রাচীন স্থপতিদের পরিশ্রমের সুস্পষ্ট ছাপ চোখে পড়বে।
এছাড়া কারুকার্যময় আয়তাকার স্তম্ভগুলোও কম যায় না। স্তম্ভগুলোতে নাকি আঘাত করলেই সুরেলা ধ্বনি ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু মুসলিম শাসনামলে অধিকাংশ স্তম্ভ ধ্বংস হয়ে যাওয়ায় এই অপূর্ব সুরলহরী উপভোগের সুযোগ আপনার হবে না। তবে মন্দিরের আটটি স্তম্ভ থেকে জলতরঙ্গ, সপ্তস্বরা, ডমরু প্রভৃতির মুগ্ধ সুর ভেসে আসে। মন্দিরের সামনেই বিখ্যাত এক পাথরের রথ। আস্ত পাথরে খোদাইকৃত এই রথ দেখতে অপূর্ব। ভারতে গেলে প্রথমেই পঞ্চাশ রুপির নোটে এই রথের চিত্র দেখতে পাবেন। আর হাম্পি ঘুরতে গেলে তো তা নিজ চোখেই দেখবেন।
দেখা তো হলো বিজয়চট্টল মন্দির। এবার নাহয় শহরটাই ঘুরে দেখা যাক। যতদূরে চোখে যায় ততদূর উঁচু-নিচু, ছোট বড় পাথুরে শিল্পকর্ম দেখা যাবে। সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত সব স্থাপনাই দর্শনার্থীদের জন্যে উন্মুক্ত থাকে। স্থাপনাগুলোর দেয়ালে রামায়ণের কাহিনি খোদাই করা। মূলত মুসলিম ও হিন্দু স্থাপত্যের মিশ্রনের ফলে এখানকার স্থাপত্যগুলো বৈচিত্র্যময় হয়ে উঠতে শুরু করে।
এখন একদম ধ্বংসস্তূপ। কিন্তু এখনো এর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আপনায় মুগ্ধ করতে বাধ্য। তিন-চার দিনের জন্যে একটি চমৎকার ভ্রমণ গন্তব্য হাম্পি। বেঙ্গালুরু থেকে সরাসরি বাস বা ট্রেনে হসপেট অব্দি পৌঁছে যাবেন। সেখান থেকে অটোতে চড়ে হাম্পি। এই অঞ্চল সারা বছরই উষ্ণ থাকে। তাই বছরের যেকোনো সময় ঘুরে আসতে পারেন হাম্পি।
অনন্যা/এআই