সাফজয়ী ঠাকুরগাঁওয়ের গর্বিত তিন ফুটবলার স্বপ্না, কোয়াতি, সাগরিকা
ঠাকুরগাঁও, ৬ নভেম্বর, ২০২৪ (বাসস) : টানা দ্বিতীয়বারের মত সাফ নারী চ্যাম্পিয়নশীপের শিরোপা জিতে বাংলাদেশকে গর্বিত করেছে সাবিনা খাতুনের দল। যে দলে ছিল ঠাকুরগাঁওয়ের গর্বিত তিন সন্তান স্বপ্না, কোয়াতি ও সাগরিকা।
ঠাকুরগাঁওয়ের প্রত্যন্ত গ্রামে মাটির কুঁড়েঘরে বেড়ে ওঠা স্বপ্না-কোয়াতি-সাগরিকা অন্যান্যদের মতই নারী ফুটবলে আলো ছড়িয়েছেন। সেই আলো বাংলাদেশের গন্ডি পেরিয়ে আলোকিত করেছে সারা বিশ্ব।
ফুটবল ক্যারিয়ারে অনেক কঠিন পথ পাড়ি দিতে হয়েছে স্বপ্না-সাগরিকা ও কোয়াতি কিসকোকে। অতি দরীদ্র ঘরে বেড়ে ওঠা এই মেয়েরা আপন মহিমায় রাঙিয়ে চলেছেন নিজেকে। প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করে উঠে আসা এই তিনজনই বাংলাদেশের নারী ফুটবলে বড় বিজ্ঞাপন।
২০২২ সালে প্রথমবারের মতো সাফ নারী চ্যাম্পিায়নশিপের শিরোপা জিতে ইতিহাস গড়েছিলো বাংলার মেয়েরা। নেপালের কাঠমান্ডুতে ওই আসরের ফাইনালে স্বাগতিক দলকে ৩-১ গোলে হারিয়ে প্রথম শিরোপার স্বাদ পায় বাংলাদেশ। একই ভেন্যুতে সদ্য সামপ্ত নারী সাফের সপ্তম আসরের ফাইনালে প্রতিপক্ষ ছিলো সেই নেপাল। হিমালয় কন্যাদের ২-১ ব্যবধানে হারিয়ে টানা দ্বিতীয় শিরোপা জয় করে নতুন ইতিহাস গড়েছে লাল-সবুজের মেয়েরা। সেই দলের গর্বিত তিন সদস্য স্বপ্না, সাগরিগা ও কোয়াতির বেড়ে ওঠা রাণীশংকৈল উপজেলার অজপাড়াগাঁয়ে। পাশাপাশি তিনজনই উঠে এসেছেন রাঙ্গাটুঙ্গী গ্রামে গড়ে ওঠা একটি ফুটবল একাডেমি থেকে।
অত্যন্ত দরিদ্র পরিবারের মেয়ে স্বপ্না রাণী ২০১৯ সালে অনূর্ধ্ব-১৭ বয়সভিত্তিক দলে প্রথম সুযোগ পান। এরপর ভারতের ঝাড়খন্ড রাজ্যের জামশেদপুরে গত মার্চে সাফ অনূর্ধ্ব-১৮ টুর্নামেন্টে অসাধারণ পারফরম্যান্স করেন তিনি। ২০২২ ও ২০২৪ সাফ নারী চ্যাম্পিয়ন দলে খেলেছেন। শিরোপা জয়ে পালন করেছেন গুরু দায়িত্ব।
স্বপ্না রাণীর বাড়ি শিয়ালডাঙ্গি গ্রামে। এখানে দুটি মাটির ঘরে বসবাস করে তার পরিবার। বিভিন্ন সময়ে ফুটবল খেলে পাওয়া ট্রফিগুলো রাখার জায়গা নেই ঘরটিতে। স্বপ্নার সব পুরস্কার বস্তায় ভরে টিনের বাক্সতে রেখে দিয়েছেন পরিবারের সদস্যরা। স্বপ্নার বড় বোন কৃষ্ণা রানী স্থানীয় একটি দর্জির দোকানের কাজ করেন। তার আয়ে চলে সংসারের খরচ।
স্বপ্না রাণীর বাবা নিরেন চন্দ্র বলেন, ‘আমার মেয়ে অনেক কষ্ট করে আজ এই পর্যন্ত পৌঁছেছে। এলাকার তাইজুল স্যার জোড় করে খেলতে নিয়ে গিয়ে তাকে এতবড় অর্জন এনে দিয়েছেন। বাসায় ডিসের লাইন না থাকায় মেয়ের খেলা দেখতে পারিনি। প্রতিবেশীরা আমাকে জানিয়েছেন ওর সফলতা। মেয়েকে নিয়ে আমি অনেক গর্বিত।’
ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী সাঁওতাল পরিবারের সন্তান কোয়াতি কিসকোর বাড়ী রাঙ্গাটুঙ্গী গ্রামে। বড় বোন ইপিনা কিসকো নারী দলকে শুভেচ্ছা জানিয়ে বলেছেন এই দলে আমার বোন আছে। আমার বোন যখন খেলা শুরু করেছিল তখন অনেকেই উপহাস করেছিল। আজ চ্যাম্পিয়ন হওয়ায় সেই মানুষরাই আমাকে তার সাফল্যের গল্প শোনাতে এসেছে।
গত ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত অনুর্ধ-১৯ চ্যাম্পিয়নশিপে বাংলাদেশ দলের অধিনায়ক সাগরিকার পরিবারও স্বচ্ছল নয়। রাঙ্গাটুঙ্গী গ্রামের বাসিন্দা তিনিও। তার বাবার একটি চায়ের দোকান রয়েছে। দুই সন্তানের মধ্যে সাগরিকা ছোট। তার ভাই মোহাম্মদ সাগর একটি ইটের ভাটায় কাজ করেন।
সাগরিকার বাবা লিটন জানান, মেয়েদের ফুটবল খেলা দেখে অনেকেই কটূক্তি করতেন। তাদের কথায় বিরক্ত হয়ে মেয়েকে মাঠে যেতে বারণ করে ঘরে আটকে রাখতাম। এসব উপেক্ষা করে মাঠে চলে যেত সাগরিকা।
এক সময় রাঙ্গাটুঙ্গী ইউনাইটেড ফুটবল একাডেমির প্রতিষ্ঠাতা তাজুল ইসলামের অনুরোধকে আর উপক্ষা করতে পারেননি সাগরিকার বাবা-মা। এরপর ধীরে ধীরে সাগরিকার খেলায় উন্নতি হয়।
রাঙ্গাটুঙ্গী ইউনাইটেড প্রমিলা ফুটবল একাডেমির পরিচালক তাইজুল ইসলাম এই তিন ফুটবালের গল্প শুনিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘দেশের নারী ফুটবল উন্নয়নে আমি এই ফুটবল একাডেমি প্রতিষ্ঠা করি। প্রথমদিকে কোনো পরিবার তাদের মেয়েদের ফুটবল খেলতে অনুমতি দিচ্ছিল না। স্বপ্না রাণীর মতো মেয়েদের পরিবারকে আমি অনেক অনুরোধ করে রাজি করাই। এলাকার মেয়েদের নিজ খরচে ফুটবল খেলতে শেখাই। এভাবেই আমার একাডেমি থেকে এখন পর্যন্ত ১৬ জন মেয়ে বিভিন্ন সময়ে জাতীয় দলে খেলেছে।’
ঠাকুরগাঁও জেলা প্রশাসক ইসরাত ফারজানা বলেন, ‘বাংলাদেশ নারী ফুটবল দলকে অভিনন্দন। চ্যাম্পিয়ন দলে ঠাকুরগাঁও জেলার তিন মেয়ে খেলছেন। বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের একটি ফুটবল একাডেমি থেকে এ পর্যন্ত ১৬ জন খেলোয়াড় বিভিন্ন পর্যায়ে জাতীয় দলের হয়ে খেলেছেন। এটা আমাদের জন্যে অনেক গর্বের। ফুটবল একাডেমি উন্নয়নে সার্বিকভাবে সহযোগিতা করবে ঠাকুরগাঁও প্রশাসন।’