Skip to content

৮ই সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দ | রবিবার | ২৪শে ভাদ্র, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

মরিশাসের সেগা সংগীতের জয়গান গাইছেন নিকিতা

১৮৩৪ সাল থেকে প্রায় একশো বছর ধরে ভারত থেকে মরিশাসে শ্রমিক আনা হয়েছিল। সমাজের বাকি জনগোষ্ঠীর সঙ্গে মেলবন্ধনের মাধ্যমে সে দেশে এক মিশ্র সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে। সংগীতই সেই মেলবন্ধনের প্রতীক।

মরিশাসে সবচেয়ে জনপ্রিয় সংগীত হলো সেগা – যা মিশ্র ক্রেওল ভাষায় গাওয়া হয়৷ কিন্তু এই দ্বীপরাষ্ট্রের বাইরে সেই সংগীতের কোনো ভবিষ্যৎ আছে কি?

২০১৪ সালে সেগা সংগীত ইউনেস্কোর মানবজাতির সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের তালিকায় স্থান পেয়েছে। লা নিকিতা সেই ধারার অন্যতম প্রধান ধারক ও বাহক। কিন্তু সেগা গানের বৈশিষ্ট্য কী? সেগা গায়ক হিসেবে লা নিকিতা বলেন, ‘‘জানেন, সেগা সংগীত আমাদের জনগণ, আমাদের সংগীত এবং আমাদের আনন্দের কাহিনি বলে৷ আমাদের পূর্বপুরুষরা সেগার তাল ও লয় সৃষ্টি করেছিলেন৷ দাসত্ব থেকে মুক্তি, স্বাধীনতা, নিজেদের কাহিনি, নিজেদের সংগ্রাম ফুটিয়ে তুলেছিলেন৷ আমরা এখনো সেগা গানে সংগ্রামের উল্লেখ করি বটে, কিন্তু সেইসঙ্গে কিছু আনন্দ, উৎসব ও ভালোবাসার কথাও বলি।”

লা নিকিতার কাছে সেগা সংগীতের থেকেও বড় কিছু। মরিশাসের মানুষ হওয়ার চেতনা ও দেশের ঐক্যের প্রতিফলন। তিনি মনে করেন, ‘‘সেগা যদি আমাদের বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করতে পারে, তাহলে গোটা বিশ্বকেও ঐক্যবদ্ধ করতে পারে। মাইকেল জ্যাকসনের ‘উই আর দ্য ওয়ার্ল্ড’ গানের কথা মনে আছে? এবার হয়তো সেগা শৈলিতে, ক্রেওল ভাষায় সেই গান আবার সৃষ্টি করার সময় এসেছে৷ কেন সেটা হবে না?”

লা নিকিতা কীভাবে সেটা ঘটাতে চান? যেখানেই যান, সেগা-র জয়গান করেন তিনি। ঐতিহ্যের সঙ্গে আধুনিক প্রবণতার মেলবন্ধন ঘটিয়ে তিনি নিজের গান প্রাসঙ্গিক ও সবার ধরাছোঁয়ার মধ্যে রাখেন। বর্তমান প্রবণতা সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘‘মরিশাসে এখন আধুনিক সেগার চাবিকাঠি হলো ড্রাম৷ অনেক বছর আগে আমাদের শুধু রাভান ছিল। আজকাল আমরা রাভান ও ড্রাম একত্র করি৷ এটাই আমাদের আধুনিক সেগা। এই বাদ্যযন্ত্রের নাম মারাভান। মরিশাসে আমরা সেটাই বলি। লা রেউনিয়ঁ দ্বীপে আমাদের ভাইবোনেরা সেটাকে কাইয়ম্ব বলে। মাটিও ও মাশা সম্প্রতি সেখানে ট্যুরে গিয়েছিল। কেনিয়ার মানুষ এটিকে কাইয়াম্বা বলে৷ আফ্রিকার পূর্বে অনেক দেশে এই বাদ্যযন্ত্র দেখা যায়। তারাও বাজায় বটে, তবে সেখানে বাদ্যযন্ত্রের নাম ভিন্ন। এটি আইডিওফোন গোত্রের বাদ্যযন্ত্র. মরিশাসে আখের ফুলের ডাঁটি দিয়ে মারাভান তৈরি করা হয়। ভেতরে কিছু বীজ ভরে দেওয়া হয়। ফলে বিশেষ ধ্বনি সৃষ্টি হয়। এদের জন্য একটু মারাভান বাজাতে পারো।

মরিশাসের ঐতিহ্যবাহী সেগা সংগীত
সেগা সংগীতের উপর আন্তর্জাতিক প্রভাব সম্পর্কে লা নিকিতা মোটেই চিন্তিত নন। তিনি মনে করিয়ে দেন, ‘‘আজকাল সংগীতের এত ধারা হয়েছে। আমরা সেগার মধ্যে সেগুলি শামিল করি৷ আমাদের সেগা ব্লু, সেগা জ্যাজ আছে। ইলেকট্রো মিউজিক, নাচের মিউজিকের প্রভাব রয়েছে। আজকাল মরিশাসের তরুণ প্রজন্ম কিছুটা ক্যারিবীয় ছন্দের শাতা মিউজিকের সঙ্গে সেগা চর্চা করছে। আমাদের আফ্রো মিউজিকও আছে। এই সব আমাদের সেগা সংগীতকে জীবন্ত রাখে। সেটা মরিশাসে সেগার সুরক্ষার অংশ৷ সংগীতের ধারা যাই হোক না কেন, সেগা আমাদের পরিচয় থেকে যাবে। মরিশাসের প্রতিটি মানুষের হৃদস্পন তার মধ্যে রয়েছে।”

লা নিকিতা তার কণ্ঠ, তার গান, তার টিভি ও রেডিও শো কাজে লাগিয়ে সেগার ঐতিহ্য বাঁচিয়ে রাখছেন। বাকি বিশ্বেও সেই ধারার জনপ্রিয়তা ছড়িয়ে দেওয়ার উদ্যোগ নিচ্ছেন তিনি। লা নিকিতা বলেন. ‘‘বিশেষ করে যে সব নারী আমার আগে সেগা পরিবেশন করেছেন, তাদের কাছ থেকে আমি প্রেরণা পেয়েছি। তাদের সময়ে সেগা মোটেই ভালো চোখে দেখা হতো না। মেয়েরা সে গান গাইলে সবাই তাদের ‘চোলো’ অর্থাৎ খারাপ বলতো। আজকাল এমন সমস্যার কথা ভাবা যায় না। আমি আজ তরুণী হিসেবে এখানে দাঁড়িয়ে সেই নারীদের জন্য গান গাওয়ার সময়ে এটাকে এক শক্তি, এক ঐতিহ্য হিসেবে দেখছি। তাদের ধারা এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছি। সেইসঙ্গে তরুণী গায়িকা হিসেবে আমিও হয়তো সেই সব কমবয়সিদের জন্য একই কাজ করতে পারি, যারা হয়তো সেগা গাইতে সংকোচ বোধ করছে বা শুধু ক্লাসিকাল গান গাইতে চাইছে।

আজকাল আমার কাছে সেগা নাচ ও গানসহ পারফর্মিং আর্ট, অন্যদের শেখানোর যোগ্য হয়ে উঠেছে। বাকি বিশ্বও যাতে সেগা আবিষ্কার করে, সেটাই আমার লক্ষ্য। কারণ মরিশাসে অনেক প্রতিভাবান শিল্পী রয়েছেন। প্রতিদিন, প্রতি রাতে আমি যখন বিদেশি পর্যটকদের সামনে সেগা পরিবেশন করি, তখন তাদের সেগা, মারাভান, ট্রায়াংগেল, গিটারের তাল ও ধ্বনিতে আচ্ছন্ন হতে দেখে অসাধারণ লাগে। সেটা খুবই শক্তিশালী৷ কত মানুষের হৃদয়ে আনন্দ দিতে পারে। সেগা হতে দাও। ভিভা মোরিস, ভিভা সেগা।”

সেগা স্পিরিটের প্রতিমূর্তি হিসেবে লা নিকিতা মরিশাসের হৃদস্পন্দন পরবর্তী প্রজন্মের জন্য বাঁচিয়ে রাখার নেতৃত্ব দিচ্ছেন।

অনন্যা/এআই

ডাউনলোড করুন অনন্যা অ্যাপ