নারী ও পলিসিস্টিক ওভারি সিনড্রোম
কানিজের বয়স ২১। ছোটবেলা থেকে শরীরের গড়ন হালকা পাতলা হলেও হঠাৎ করেই তার ওজন বাড়া শুরু করেছে, প্রথম সে ও তার পরিবার ব্যাপারটিকে আমূলে না নিলেও চলতি মাসের মাসিক না হবার কারণে পুরো পরিবার আতঙ্কিত হয়ে যায় ও চিকিৎসকের শরণাপন্ন হয়। চিকিৎসক তার পুরো ব্যাপারটি শোনার পর কিছু টেস্ট দেন এবং সকল প্রকার পরীক্ষানিরীক্ষার পর জানা যায় কানিজের পিসিওএস শনাক্ত হয়। চিকিৎসা কানিজ ও তার মাকে পিসিওএস সম্পর্কে ধারণা দেন ও একটি নিয়মতান্ত্রিক জীবন অনুসরণ করতে বলেন।
পিসিওএস কি?
পিসিওএসের পুরো নাম হচ্ছে পলিসিস্টিক ওভারি সিনড্রোম। এটি একটি হরমোনজিত সমস্যা৷ এই অবস্থা নারীর শরীরের হরমোন তার ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে। গবেষনা বলছে প্রতি ১০ জন্য নারীর মধ্যে একজন নারী পিসিওএসে আক্রান্ত।পিসিওএস হলে নারীর অ্যান্ড্রোজেন হরমোনের পরিমাণ বেড়ে যায় এবং অ্যান্ড্রোজেন হরমোন বেড়ে যাওয়ার কারনে ডিম্বাশয়ের আশেপাশে ছোট ছোট সিস্ট হয়৷ ফলে প্রতি মাসে ডিম্বাশ থেকে যে ডিম বের হওয়ার কথা তাতে বাধা সৃষ্টি হয়৷ অনেক সময় পুরোপুরিভাবে ডিম বের হওয়া বন্ধ হয়ে যায়৷ এবং এ কারনের মাসিকের অনিয়ম শুরু হয় কিংবা মাসিক বন্ধ হয়ে যায়।
পিসিওএসের লক্ষণ
১। পিসিওএসের প্রধান লক্ষণ হচ্ছে অনিয়মিত মাসিক।
২। ওজন বেড়ে যাওয়া৷ তবে ওজন স্বাভাবিক থাকার পরেও পিসিওএসে আক্রান্ত হতে দেখা যায়৷
৩। মুখে অস্বাভাবিক ব্রণ ও ত্বক কালো হয়ে যেতে থাকে।
৪। শরীরের বিভিন্ন স্থানে অবাঞ্ছিত লোম।
৫। চুল পাতলা হয়ে যাওয়া।
৬। বিষণ্ণতা সহ নানাবিধ মানসিক ব্যাধি।
৭। গর্ভধারণে ব্যর্থতা।
পিসিওএসের কারণ
রক্তে ইনসুলিন অত্যধিক বেড়ে যাওয়ার ফলে পিসিওএস হয়ে থাকে। এ ইনসুলিন বাড়ার বেশ কিছু কারণ রয়েছে। যেমন পারিবারিক ইতিহাসে যদি কারো পিসিওএস থেকে থাকে তাহলে পিসিওএসে আক্রান্ত হবার অনেক সম্ভবনা রয়েছে। এছাড়া অনিয়মতান্ত্রিক জীবনের ফলে ওজন বেড়ে গিয়ে পিসিওএস হতে পারে৷ পিসিওএস আক্রান্ত নারীদের ইতিহাস থেকে জানা যায় তাদের বেশিরভাগই কোনো প্রকার শারীরিক পরিশ্রম করে না ও অতিরিক্ত ফাস্টফুড খেয়ে থাকে৷
পিসিওএসেএ জটিলতা
সময়মতো পিসিওএস নিয়ন্ত্রণে না আনতে পারলে শরীরে নানা ধরণের জটিলতা দেখা দিতে পারে৷ পিসিওএসে আক্রান্ত বেশিভাগ নারীর টাইপ টু ডায়াবেটিস দেখা যায়৷ তারা সহজে গর্ভধারণ করতে পারে না, করলেও গর্ভপাতের প্রবল ঝুঁকি রয়ে যায়। এছাড়া হৃদরোগ ও উচ্চ রক্তচাপের মতো জটিলতা দেখা দেয়৷ মেটাবলিক সিনড্রোম দেখা দিতে পারে। পিসিওসে আক্রান্ত ব্যক্তিদের বিষন্নতা ও উদ্বেগের মতো মানসিক ব্যাধি দেখা দেয়।
পিসিওএসের চিকিৎসা
পিসিওএসের সঠিক কোনো চিকিৎসা নেই। অনেক সময় মাসিক নিয়মিত করার জন্য চিকিৎসক ঔষধের পরামর্শ দিয়ে থাকে। তবে এটি কিছু অভ্যাসে পরিবর্তন এনে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। পিসিওএসে আক্রান্ত হলে ওজন বেশি থাকলে প্রথমে ওজন নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। পিসিওএসে আক্রান্ত ৫০% নারীর ওজনই বেশি থাকে। তাই ওভারওয়েট হলে ওজন কমিয়ে আনতে হবে। তবে ইনসুলিন বেশি থাকার ফলে অন্যদের তুলনা ওজন কমানো কিছুটা কষ্টসাধ্য হয়, তাই স্বাস্থ্যসম্মত খাবারের পাশাপাশি নিয়মিত ব্যায়াম করতে হবে। ব্যায়ামের ফলে বিষণ্ণতাও কমে আসবে কারণ শারীরিক পরিশ্রমের ফলে শরীরে ডোপামিন হরমোনের পরিমান বেড়ে যায় আর এই হরমোন আমাদের মুড নিয়ন্ত্রণ করে থাকে৷ পলিসিস্টিক ওভারিয়ান সিন্ড্রোম থাকলে খাবারের প্রতি বিশেষ নজর দিতে হবে, খাদ্যতালিকায় রাখতে হবে ফাইবারযুক্ত খাবার৷ প্রতিদিন শাক ও সবজি খেতে হবে ও ডায়েটে ভিটামিন সি সমৃদ্ধ একটি ফল রাখতে হবে। যেমন, লেবু, কমলা, আঙুর, পেয়ারা, তরমুজ ইত্যাদি। এছাড়া পরিমাণমতো প্রোটিন গ্রহণ করতে হবে। প্রতিদিন ডিম ও দুধ খেতে হবে।রক্তে শর্করার মাত্রা বেড়ে যায় এমন সব খাবার থেকে বিরত থাকার চেষ্টা করতে হবে। ফাস্টফুড ও মিষ্টি জাতীয় খাবার এড়িয়ে যেতে হবে।
কুসংস্কার
আমাদের সমাজে পিসিওএস নিয়ে একটি কুসংস্কার প্রচলিত রয়েছে যে বিয়ে হলে নারীদের এ সমস্যা কমে আসে। ফলে অল্প বয়সেই অনেক নারীকে বিয়ে দিয়ে দেয়া হয়, বিশেষ করে গ্রাম অঞ্চলে এটি বেশি ঘটে থাকে। কিন্তু মনে রাখতে হবে বিয়ের সাথে পিসিওএস ভালো হয়ে যাওয়ার কোনো সম্পর্ক নেই। পিসিওএস নিয়ন্ত্রণ করতে চাইলে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী লাইফস্টাইলে পরিবর্তন আনতে হবে ও স্বাস্থ্যসম্মত জীবন যাপন করতে হবে। এটিই পিসিওএসের একমাত্র সমাধান।