নারী মুক্তিযোদ্ধাদের যথাযথ সম্মান মিলবে কবে
বাঙালি জাতির ইতিহাসে মুক্তিযুদ্ধ সবচেয়ে স্মরণীয়, ঐতিহাসিক ও গৌরবময় ঘটনা। এর মাধ্যমে বাঙালি জাতির জীবনে স্বাধীনতার সূর্য উদিত হয়েছে। আমরা লাভ করেছি স্বধীন দেশ, নিজস্ব পতাকা। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ আনুষ্ঠানুনিকভাবে শুরু হয় বাঙালির স্বাধীনতা সংগ্রাম। তবে যুগ যুগ ধরেই বাঙালি জাতি শোষিত হয়ে আসছিল। তারই ভিত্তিতে আন্দোলন ঘনীভূত হতে থাকে। সব শ্রেণি পেশার মানুষ তাদের যা কিছু আছে, তাই নিয়ে দেশের স্বাধীনতা কামনায় জীবন বাজি রাখতেও পিছুপা হয়নি।
মানুষ হোক বা প্রাণী পরাধীনতার শৃঙ্খল কারোরই কাম্য নয়। তাই স্বাধীনতার জন্য সবাই মরিয়া হয়ে ওঠে। আর দেশের অভ্যন্তরে যদি মানুষ পরাধীন হয় তবে এর মতো দুঃখজনক করুণ কাহিনি আর কিছুই থাকতে পারে না। সেই লক্ষ্যে বাঙালি জাতিও এগিয়ে যায় নিজস্ব ভূখণ্ড, রাষ্ট্র, পতাকা, সার্বভৌমত্ব কামনায়। বাঙালির স্বাধীনতা অর্জনের ইতিহাস যতটা গৌরবের ঠিত ততটাই অশ্রুমাখা। এর প্রতিটি পাতায় রয়েছে বেদনার ছাপ। ত্রিশ লক্ষ শহীদের রক্ত ও লাখ লাখ নারীর সম্ভ্রমের বিনিময়ে প্রতিষ্ঠিত স্বাধীনতার ইতিহাস। এই ইতিহাস মুক্তিযুদ্ধের পবিত্র আবেগ ও গৌরবের মধ্যে মিশে আছে। তবে দেশের জন্য যেই নারীরা তার সর্বস্ব বিসর্জন দিয়েছেন স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পালিত হলেও তারা তাদের যথাযথ স্বীকৃতি, মর্যদায় অধিষ্ঠিত হননি।
স্বাধীন সার্বভৌম দেশ গঠনের জন্য যেই নারীরা জীবনকে বাজি রাখলেন, নিজেদের সম্ভ্রম হারালেন ইতিহাসে আজও তাদের ঠাঁই হয়নি। মোলেনি যথাযথ স্বীকৃতি-সম্মান। সরকারি হিসাব মতে, স্বাধীনতাবিরোধীদের দ্বারা নির্যাতনের শিকার ২ লাখ নারী। বিভিন্ন গবেষণা প্রতিবেদন বলছে, সংখ্যাটা ৬ থেকে ১০ লাখের মতো। ২০১৫ সালে প্রথমবারের মতো ৪১ জন বীরাঙ্গনা পান মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি। চলতি বছরের ২৪ মে পর্যন্ত গেজেটভুক্ত ‘বীরাঙ্গনা মুক্তিযোদ্ধার’ সংখ্যা মাত্র ৪৪৮ জন। স্বাধীনতার ৫০ বছর পরে এসে সাম্প্রতিক এক গবেষণায় এ বিষয়ে বিস্তারিত উঠে এসেছে, তাতে গেজেটভুক্তির ক্ষেত্রেও নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ করা হয়েছে। নারীদের প্রতি এরূপ বৈষম্যমূলক আচরণের কারণ কী? মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী নারীরা কেন আজও তাদের যথাযথ মর্যাদায় ভূষিত নন?
টিআইবির গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, একদিকে গেজেটভুক্ত বীরাঙ্গনার সংখ্যা লক্ষণীয়ভাবে কম। অন্যদিকে বীরাঙ্গনার স্বীকৃতি ও সুবিধা প্রাপ্তির প্রক্রিয়ায় নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। বীরাঙ্গনাদের চিহ্নিতকরণ প্রক্রিয়ায় সরকারের ও বিভিন্ন জনের ভূমিকা, প্রত্যয়ন ও আবেদনের প্রক্রিয়া, যাচাই-বাছাই ও গেজেট ঘোষণা এবং ভাতা ও অন্যান্য সুবিধা প্রাপ্তির ক্ষেত্রে নানা জটিলতা বা অনিয়ম-দুর্নীতির তথ্য এসেছে। এছাড়া সুশাসনের ৬টি নির্দেশকের আলোকে বীরাঙ্গনাদের নিয়ে সরকারি কার্যক্রম; রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি ও অধিকার প্রাপ্তির প্রক্রিয়া এবং আইনের শাসন সংক্রান্ত চ্যালেঞ্জ; পরিকল্পনা ও উদ্যোগ, হালনাগাদ ও নির্ভুল তথ্য এবং সংশ্লিষ্ট অংশীজনের মধ্যে সংবেদনশীলতার ঘাটতি এবং গেজেটভুক্তির প্রক্রিয়ায় অনিয়ম ও দুর্নীতিসহ বিভিন্ন বিষয় উঠে এসেছে পর্যালোচনায়। দেশে নারী মুক্তিযুদ্ধের সঠিক তথ্য নিশ্চিত করে তাদের যথাযথ সম্মান, মর্যাদা নিশ্চিত করতে হবে।
জাতি হিসেবে আমরা স্বাধীন সার্বভৌম দেশের নাগরিক। তবে এই স্বাধীনতার ছোঁয়া পেতে যারা আমাদের জন্য প্রাণ বিসর্জন দিয়েছেন, সম্ভ্রম হারিয়েছেন জাতির উচিত অবশ্যই তাদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া। বাড়তি কিছু সুবিধা বা প্রাপ্তির আশায় মিথ্যাকে প্রশ্রয় না দেওয়া। সঠিকতা নিরূপনের মাধ্যমে এই নারীদের সম্মানিত করা। এর জন্য সরকারি উদ্যোগ, যাচাই-বাছাই যেমন প্রোয়জন তেমনই মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে একটি সঠিক, অবিকৃত ইতিহাস হিসেবে উপস্থাপন করতে সবার সচেতনতা। যা গর্বের, ইতিহাসের অংশ সেখানে কারচুপির সাহায্য নেওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে সাধারণ নারীদের। তাই সঠিকভাবে যাতে মুক্তিযুদ্ধের অংশগ্রহণকারী নারীদের মূল্যায়ন হয় সেজন্য সবার উদার মানসিকতা প্রয়োজন। সততার প্রয়োজন। যার সাহায্য সরকারি পর্যায়ে তথ্য- উপাত্ত সংগ্রহে বিভ্রান্তিতে না পড়তে হয়।
সাধারণ নাগরিকের পাশাপাশি সরকারের পক্ষ থেকে কার্যকরি ভূমিকা গ্রহণ করতে হবে। জাতির ইতিহাস সবসময়ই একটি জাতিকে চিহ্নিত করতে সহায়ক। ফলে ইতিহাস রক্ষায়, নারীদের প্রকৃত সম্মান ও মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করতো তাদের সঠিক তথ্য সংগ্রহ করতে হবে। কেউ যেন মিথ্যা বা ভুল তথ্য প্রদানের মাধ্যমে এই সম্মানিত আসন গ্রহণ না করেন সেদিকে সুতীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখতে হবে। অতিদ্রুত কমিটি গঠনের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে জড়িত নারীদের যথাযথ মর্যাদায় ভূষিত করা হোক। তাদের প্রাপ্য সম্মান তারা ফিরে পাক।