মা সন্তানের অভিভাবক: রায় প্রসঙ্গে যা বললেন তারা
এসএসসি-এইচএসসি পরীক্ষাসহ সব ফরম পূরণে সন্তানের অভিভাবক হিসেবে মাকেও স্বীকৃতি দিয়ে মঙ্গলবার (২৪ জানুয়ারি) রায় দিয়েছেন হাইকোর্ট। এই রায়ের মধ্যদিয়ে পিতৃপরিচয়হীন সন্তান, যৌনকর্মীদের সন্তান, যাদের বাবার পরিচয় নেই তারা শুধু মায়ের নাম দিয়েই ফরম পূরণ করতে পারবেন। এই রায়ের পর সমাজের বিভিন্ন শ্রেণী-পেশাজীবীরা সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন। তারা বলেছেন এটি মানবাধিকারের প্রশ্নে একটি যুগান্তকারী রায়।
সোনালী ব্যাংকের কর্মকর্তা ইসরাত জাহান দিপা বলেন, ‘সেই বহু বহু বছর ধরে কিছু নিয়মের বেড়াজালে আটকে আছে আমাদের সমাজব্যবস্থা। সংবিধানের নারী-পুরুষের সমতা আইনটি যেন কিছু নিয়মের কারণে হয়ে যায় বাকরুদ্ধ। আজকের এই রায় শিক্ষার্থীদের শিক্ষার অধিকারসহ মানবাধিকার রক্ষাএবং নারী পুরুষের সমতা রক্ষাকারী এক যুগান্তকারী রায়।’
এই ব্যাংক কর্মকর্তা আরও বলেন, ‘এই রায়ের মাধ্যমে এসএসসি-এইচএসসি পরীক্ষাসহ সব ফরম পূরণে কিংবা পাসপোর্টে সন্তানের অভিভাবক হিসেবে বাবা অথবা মা অথবা আইনগত অভিভাবকের নাম লেখা যাবে। শুধু মায়ের নাম দিয়েই ফরম পূরণ করতে পারবেন, যা পূর্বে বাবার নাম বাধ্যতামূলেক ছিল। আমার মতে পিতৃপরিচয়হীন সন্তান তো বটেই, আমাদের সমাজে কিছু নরপশু আছে যারা স্ত্রী এবং দুধের সন্তান ফেলে চলে যায়, সন্তানের কোনো দায়িত্বই তারা পালন করে না, যেই মা বুকে আগলে সন্তান বড় করে সেই সন্তানের সব কাগজ-দলিলে তো মায়ের নামই স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকা উচিত।’
দিপা বলেন, ‘আমরা অনেক সময় দেখে থাকি যেকোনো সংসারে ফুটফুট একটি সন্তান অথচ এই সন্তানটি হয়তো কোনো এতিমখানা কিংবা পরিচয় বিহীন স্থান থেকে নেওয়া হলো। এইক্ষেত্রে আইনগত অভিভাবক কে প্রাধান্য দেওয়া যাবে। এত গ্রহণযোগ্য একটি রায় হলো, আর যেন ২০০৭ সালের ঠাকুরগাঁয়ের ঘটনার পুনরাবৃত্তি না ঘটে। আর যেন কোনো তরুণী শিক্ষার্থীকে বাবার নাম লিখতে না পারার কারণে পরীক্ষার প্রবেশপত্র আটকে দেওয়ার সাহস না দেখায়। যে শিশু বাবা দেখেনি,তার জন্য সন্তান সমাজে কত জায়গায় ভুক্তভোগী হয়েছে,যে সন্তান জানে না বাবার স্পর্শ কেমন, সেই সন্তানের জন্য বাবা নামক কলংকের নাম কোনো প্রয়োজন নেই।’ তিনি আরও বলেন, ‘ন’মাস গর্ভে পরম যত্নে যে আগলে রেখেছে, রোদ, বৃষ্টি কিংবা শীতের কষ্টেও যে সন্তানকে নিয়েই পৃথিবী গড়েছে, সেই মায়ের নাম শুধু কাগজপত্রে থাকলেও এ ঋণ শোধ হওয়ার না। তাও এটুকুই সান্ত্বনা কারও দ্বারে আজ তোমার আর কড়া নাড়তে হবে না ‘মা’। তুমি একাই আজ তোমার সন্তানের পৃথিবী।’
ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনল ইউনিভার্সিটির শিক্ষক ফায়াজুন্নেসা চৌধুরী বলেন, ‘‘ভ্রূণ গ্রহণের পর থেকে সেই সন্তানকে নিজের দেহে পরিপূ্র্ণভাবে ধারণ করে পৃথিবী চেনায় একজন মা। এরপর সেই সন্তানের বহুলাংশের কর্তব্য যে মাকেই নিতে হয়, এই চিত্র প্রায় একশো ভাগ ক্ষেত্রেই দৃশ্যত। এই দেশে বহুকাল পর্যন্ত কাগজে কলমে সেই মায়ের অবস্থান ছিল অনেকটা অপশনাল, যেন বাবার নাম ব্যবহারেই মায়ের পরিচয় কিছুটা প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়ে যায়।
আবার যে সন্তানকে বাবা গ্রহণই করলো না, ফেলে রেখে চলে গেলো, সেই সন্তানও তার প্রতিষ্ঠিত হওয়ার প্রতিপর্বে বাবার ‘নাম’টুকুই কাগজের দালিলিক প্রয়োজন মিটিয়ে যায়। যা সেই ভুক্তভোগী মায়ের জন্য অভিসম্পাতে ছাইচাপা কষ্টের তীব্র হাহাকার।’’ তিনি বলেন, ‘হাইকোর্টের এই রায়ের মাধ্যমে মায়ের চিরকষ্টের মর্যাদা এবার হাতে কলমে কিছুটা হলেও পেতে যাচ্ছে। সংবিধান নারী পুরুষ উভয় কে সমান অধিকার দিয়েছে। সংবিধানের সমতা রক্ষার্থে বাবা অথবা মায়ের পরিচয় থাকলে এখন থেকে যেকোনো ফরম পূরণ বা রেজিস্ট্রেশন করার অধিকার পাবে সন্তান। সংকীর্ণতার দেয়াল ভেঙে আলোর বিচ্ছুরণ এবার হবেই। এ যেন সহস্র বিনিদ্র রাত্রির বেদনাচাঁপা মলিন কষ্টের এক অম্লান অবদান।’
এই শিক্ষক বলেন, ‘জন্মদাত্রী মা তার মাতৃত্বের পূ্র্ণরূপ ব্যবহারিক অর্থেই শুধু পাবে না, বরং বহুক্ষেত্রের কাগজ কলমজনিত হয়রানি থেকেও মুক্তি পাবে সন্তান।’
বরিশাল জেলা সমন্বয়কারী কর্মকর্তা দীপ্তি মণ্ডল দিতি বলেন, ‘মা একাধারে গর্ভধারিণী, স্তন্যদায়িনী, সেবিকা, ধাত্রী, শিক্ষায়িত্রী ও অভিভাবক প্রভূতির ন্যায় বহুমুখী ভূমিকা পালন করেন। শিশুর দৈহিক গঠনের সঙ্গে সঙ্গে তার চরিত্র গঠনের দায়িত্ব ও কর্তব্য নির্ভর করে মায়ের ওপর। মাকে সব সময় সর্তক থাকতে হয়, যেন তার সন্তান বা পরিবারের কেউ বিপদগামী হতে না পারে। দীর্ঘ ১০ মাস একজন মাকে অপরিসীম ধৈর্য ও কষ্টের মধ্যে কালাতিপাত করতে হয়। সন্তানের ভবিষ্যৎ চিন্তা করে মাকে শারীরিক ও মানসিক অসুবিধাকে তুচ্ছ মনে করা তার দায়িত্ব পালন করতে হয়।’ তিনি আরও বলেন, ‘নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সর্বাত্মক মুক্তিযুদ্ধে শামিল হয়েছিল সমানভাবে। নারীরা ধর্ষিত, অত্যাচারিত যেমন হয়েছেন তেমনি রণাঙ্গনে দাঁড়িয়ে বিপুল বিক্রমে লড়েছেন।’
এই সরকারি কর্মকর্তা আরও বলেন, ‘সংবিধানের চার জায়গায় বলা হয়েছে সুযোগের সমতা, মহিলাদের অংশ গ্রহণ, সমান অধিকার ও সর্বজনীন শিক্ষা। নারী এই সমাজের পুরুষের পাশাপাশি বিরাট একটা অংশ জুড়ে রয়েছেন। বাংলাদেশের মাতৃতান্ত্রিক পরিবার গুলো সুশৃঙ্খলভাবে পরিচালিত হচ্ছে যেখানে মা হচ্ছেন পরিবারের অভিভাবক। যে সমাজ ব্যবস্থায় গৃহ পরিচালনা থেকে শুরু করে রাষ্ট্র ও বিশ্বপরিচালনায় সেখান একচ্ছত্র নারী কেন অভিভাবক হতে পারবে না। নারীরা এখন আয় করেন পরিবার পরিচালনায় অংশ নিতে পারেন সেখানে অভিভাবক কেন নয়? শুধু পিতৃপরিচয়হীন কোনো সন্তান যদি চায়, তার পিতার পরিচয় ব্যবহার করবে না, তাহলে হাইকোর্টের এই যুগান্তকারী রায়কে আমি স্বাগত জানাই।’
লেখক ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শেখ কানিজ ফাতেমা বলেন, ‘‘মা’কে অভিভাবক হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে আদালত যে রায় দিয়েছেন, বাংলাদেশর ইতিহাসে সেটি একটা মাইলফলক হয়ে থাকবে বলে আমি মনে করি। এই রায়ের মাধ্যমে আইনগতভাবে ও সামাজিকভাবে একজন মায়ের মাতৃত্ব স্বীকৃতি পেলো। নারীর ক্ষমতায়ন ও উন্নয়নে এই রায় একটি দৃষ্টান্ত হিসেবে থাকবে। অবহেলিত নারীরা তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠিত করতে পারবেন। অনেক সিংগেল মাদারকে আর বিড়ম্বনায় পড়তে হবে না। আমি মনে করি, সন্তান জন্ম দেওয়ায় একজন মায়ের যে সম্মান পাওয়া উচিত, সেটা এই রায়ের মাধ্যমে প্রস্ফুটিত হলো।’’