Skip to content

৫ই মে, ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দ | রবিবার | ২২শে বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

ভুলে যাবেন না বন্ধ্যা নারীরাও মানুষ

নারী, জন্মলগ্ন থেকে যার নিজের পরিচয় নেই। সে বড় হয় কারো মেয়ে হিসেবে, বিয়ের পর জীবন কাটে স্বামী-সন্তানের পরিচয়ে। আমাদের সমাজে একটি প্রচলিত কথা আছে, ‘নারীর পূর্ণতা শুধু মাতৃত্বে।’ কতটুকু যৌক্তিক এই প্রবাদ?

সন্তানের আকাঙ্ক্ষা নর-নারী নির্বিশেষে প্রত্যেক মানুষের জীবনে থাকে। একজন নারী ও একজন পুরুষ যখন বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়, তখন থেকে তাদের বিবাহিত জীবনের শুরু হয়। আর বিবাহিত জীবনে তাদের উভয়ের যত ধরনের আশা-আকাঙ্ক্ষা থাকে তার মধ্যে একটি সন্তানের আকাঙ্ক্ষাই সবচেয়ে বেশি ও তীব্র থাকে। যখন একজন নারী গর্ভবতী হয়, তখন পুরো পরিবারে আনন্দের বন্যা বয়ে যায়। সবাই অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে নতুন অতিথিকে সাদরে বরণ করতে। আবার এত আশা-আকাঙ্ক্ষা ও আনন্দ-ভালোবাসার মাঝেও কেউ কেউ একটি সন্তানের জন্ম দিতে পারে না। আর এই ব্যপার নিয়ে স্বামী-স্ত্রীর মাঝে মানসিক টানাপড়েন ও পারিবারিক অশান্তির সৃষ্টি হয়। সন্তান না হওয়ার জন্য দায়ী হতে পারে স্বামী-স্ত্রীর যে কেউ, কিন্তু ভুক্তভোগী হয় বিশেষ করে নারীরা।

আমাদের সমাজে নারীর জীবন স্বামী সন্তান ছাড়া অসম্পূর্ণ মনে করা হয়। মনে করা হয় সন্তান ছাড়া নারীর জীবন বৃথা। মাতৃত্বের স্বাদ না পেলে নারী হয়ে জন্মানোর স্বার্থকতা কোথায়! আমাদের উপমহাদেশে নারীকে এভাবেই মূল্যায়ন করা হয়।

আমরা এতটাই সংকীর্ণ মানসিকতার যে, নিঃসন্তান নারীর কাছে অনেক মায়েরা তাদের বাচ্চাকে ঘেষতে দেয় না, বাচ্চার মুখ দেখাতে চায় না এমনকি ছবিও দেখাতে চায় না। কী অদ্ভুত মানসিকতা!

সংসার জীবনে বা বিবাহিত নারীর সামাজিক অবস্থানে তার নিজ পরিচয় যাই হোক না কেন, সেই নারী যদি সন্তান জন্ম দিতে না পারে, তবে হোক সে গ্রামের একজন সাধারণ বধূ বা হোক সে একজন উচ্চপদের সফল নারী, তার পরিচয় তখন বন্ধ্যা নারী হিসেবেই হয়ে থাকে আমাদের সমাজে। তার অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীয় পরিচয় গৌণ হয়ে যায় সন্তানহীন হওয়ার কারণে।

আমাদের সমাজে উত্তরাধিকার রক্ষায় একমাত্র প্রক্রিয়া মনে করা হয় নারীর গর্ভধারণ অর্থাৎ সন্তান জন্মদান। অথচ এটা একটা জৈবিক প্রক্রিয়া যেটাকে উত্তরাধিকার রক্ষার দোহাই দিয়ে মা হওয়াকে এত গুরুত্বপূর্ণ ভাবে দেখানো হয়। মধ্যবিত্ত, উচ্চবিত্ত বা নিম্নবিত্ত সব শ্রেণিতেই এই ধ্যান-ধারণা রয়েছে। শুধু আমাদের সমাজ নয়, নারী নিজেও তার জীবনের সার্থকতা মা হওয়াকেই মনে করে। সে তার পরিবার থেকে, সমাজ থেকে এই মানসিকতা নিয়েই বড় হতে হতে এটাকেই জীবনের স্লোগান ভেবে নেয়।

প্রতিষ্ঠিত স্বামী পাওয়া,সন্তানের মা হওয়াকেই বিবাহিত নারীর জীবনের সাফল্য, সুখ ও সার্থকতা মনে করা হয়। অবশ্যই মাতৃত্ব খুব সুন্দর ও আনন্দদায়ক একটি অনুভূতি। সন্তান হওয়ার পর একজন নারী নারী থেকে একজন মা হয়ে ওঠে। তখন তার জীবনটাই পাল্টে যায়। কিন্তু মা হওয়াটাই কি সবকিছু?

কোনো নারী ইচ্ছে করে সন্তানহীন থাকে না। শারীরিক জটিলতা, হরমোনাল ইমব্যালেন্স, ইকটোপিক প্রেগন্যান্সি প্রভৃতি কারণে একজন নারী সন্তান জন্মদানে অক্ষম হতে পারেন। কিন্তু সমাজ কখনো সন্তান জন্মদানে অক্ষম নারীকে মেনে নিতে পারে না। আর সব জায়গায় দেখা যায় ,যদি স্বামীও সন্তান জন্মদানে অক্ষম হয়, তবুও নারীটিকেই সমস্ত অত্যাচার সহ্য করে যেতে হয়। যে নারী মা হতে পারে না, তার এই সমাজে কোনোই মূল্য নেই। গর্ভে সন্তানধারণ না করেও কি মা হওয়া যায় না? এভাবে কি ভাবা যায় না, সন্তানহীন নারীর অক্ষমতাকে মেনে নিয়ে দত্তক সন্তান গ্রহণ করা বা আপনজনদের কারওনিকট থেকে একজন নিয়ে তাকে সন্তানরূপে লালন-পালন করা?

যদিও এ ব্যাপারগুলো বলা যত সহজ তা মেনে নেওয়া অনেক কঠিন। কারন, মাতৃত্বই নারী জীবনের সফলতার একমাত্র মাপকাঠি নয়। কিন্তু এতসব কিছু আমাদের জানা থাকার পরেও কেন এমন মানসিকতা আমাদের সমাজের মানুষের ? একজন নারী একজন মা হওয়ার আগে একজন মানুষ। মাতৃত্বই নারী জীবনের কেন্দ্রবিন্দু নয় এবং হওয়া উচিতও নয়। স্বামী, পরিবারের, সমাজের ভুলে গেলে হবে না যে, মা হওয়াই তার জীবনের একমাত্র সত্য নয়। সন্তান জন্ম বা লালন-পালন ছাড়াও নারী তার জীবনে আরও অনেক কাজ করে থাকে এবং তাকে সামগ্রিকভাবে সব মিলিয়ে মূল্যায়ন করা উচিত। শুধু একজন মা হিসাবে নয়। তবে খুবই হতাশার কথা, এই কথা পরিবার, সমাজ তো ভুলে যায়, নারী নিজেও ভুলে যায়।

আমাদের সমাজে মা না হতে পারাকে একমাত্র নারীরই দোষ মনে করা হয়। সন্তান হওয়া বা না হওয়ার জন্য নারীর একার কোনো ভূমিকা নেই আমরা খুব ভালো করে জানি। তা সত্বেও আমাদের সমাজে পুরুষের অক্ষমতাকে একদমই এড়িয়ে যাওয়া হয়। আর একারণেই নিঃসন্তান নারীকে আজীবন বন্ধ্যা শব্দটি শুনতে হয়। আমরা ভুলে যাই, সৃষ্টিকর্তা না চাইলে সন্তানের মা-বাবা হওয়া যায় না। মানুষ চাইলেই সন্তানের মা বাবা হয়ে যেতে পারে না।

আমরা বই-পুস্তকে বা সাহিত্যে দেখি বিভিন্নভাবে নারীর জীবনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বর্ণনা করা হয়। কিন্তু ওসব শুধু বই-পুস্তকের মাঝেই সীমাবদ্ধ । বাস্তব জীবনে এর সম্পূর্ণ বিপরীত ধ্যান-ধারণা ও চিত্র দেখা যায় । আমরা যা দেখি-নারী জীবনের একমাত্র লক্ষ্য হচ্ছে বিয়ে করে স্বামী-সংসার ও সন্তান জন্মদান। নিঃসন্তান নারীর মেধা আর পরিশ্রমকে কখনো কখনো মূল্যায়ন করা হলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অবমূল্যায়ন করা হয়। তাদের মেধা আর পরিশ্রমকে ধর্তব্যের মধ্যেই ফেলা হয় না। অথচ তার ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র দোষ ত্রুটিকে ম্যাগনিফাইং গ্লাস দিয়ে বড় করে দেখতে খুব পারদর্শী আমরা।

নারীর তুলনায় পুরুষের পিতৃত্বে বন্ধ্যা শব্দটি খুব একটা প্রভাব ফেলে না। পান থেকে চুন খসলেই যেখানে আমরা নারীরাই আরেকজন নারীকে সব দোষ দেই, আর যদি হয় নিঃসন্তান তবে তা যেন হয়ে যায় আগুনে ঘি ঢালার মতো। সন্তানহীন নারীকে মানুষ বলেই মনে করা হয় না। নিজের মেধা আর পরিশ্রম দিয়ে স্বমহিমায় উজ্জ্বল হয়ে আছেন এমন অনেক নিঃসন্তান নারী আছেন, যাদের বন্ধ্যা পরিচয়টি তাদের অবস্থান থেকে টলাতে পারেনি।

বলা হয়ে থাকে, নারী মায়ের জাত। মায়ের জাত বলে তাকে স্পষ্ট করে বুঝিয়ে দেওয়া হয়, তার কাজ মা হওয়া। মা হওয়া ছাড়া তার কোনো অস্তিত্ব নেই। কোনো পরিচয় নেই। আর তাই সন্তান না হলে বা হতে দেরি হলে তাকে নিয়ে আড়ালে ও প্রকাশ্যে চলে আলোচনা-সমালোচনা। তাকে নানান লোকের নানান কথা শুনতে হয় এবং জবাব দিতে হয় নানান অদ্ভুত প্রশ্নের।

সন্তান না হওয়ায় অনেক দম্পতির বিবাহ বিচ্ছেদও ঘটে। সন্তান জন্ম দিয়ে নারীকে প্রমাণ দিতে হয় যে তার মন ও শরীর ঠিক আছে। সন্তানহীন বিবাহিত নারীর দিকে সমাজের অধিকাংশ মানুষের দৃষ্টিতে মিশে থাকে সহানুভূতি, করুণা। থাকে পরিতৃপ্তি ও অহঙ্কার। আমরা এতটাই সংকীর্ণ মানসিকতার যে, নিঃসন্তান নারীর কাছে অনেক মায়েরা তাদের বাচ্চাকে ঘেষতে দেয় না, বাচ্চার মুখ দেখাতে চায় না এমনকি ছবিও দেখাতে চায় না। কী অদ্ভুত মানসিকতা!

এই দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনই সন্তানহীন নারীর প্রতি আমাদের মানবিক করতে পারবে। গড়ে উঠবে একটি সুন্দর সমাজ। আর তাই সন্তানহীন নারীদের প্রতি আমাদের এই দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনে পরিবার ও সমাজ তথা আমাদের সকলকে এগিয়ে আসতে হবে।

আমাদের উপমহাদেশের সমাজ ব্যবস্থায় এরকম সংকীর্ণ মানসিকতা বেশি দেখা যায়। সামাজিক বা পারিবারিক অনুষ্ঠানে নারীর প্রবেশের অনুমতি থাকলেও অংশগ্রহণের সুযোগ দেওয়া হয় না সন্তানহীন হওয়ার কারণে। তাদের বিড়ম্বনা হিসেবে দেখা হয়। অথচ এই বিড়ম্বনা দিচ্ছেন কারা? সমাজের তথাকথিত সুখি টাইপ মানুষরাই নিঃসন্তান নারীদের বিড়ম্বনার কারণ হচ্ছেন। বাঁজা, অপয়া শব্দগুলো তাদের জন্য নির্দিষ্ট করে তাদের আলাদা করে ফেলা হয়। যেন তাদের দেখা নিষেধ, ছোঁয়া নিষেধ।

সমাজের এমনতর আচরণ ও মানসিকতার কারণেই বিবাহিত নারী মা হওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে।সন্তান ছাড়া সংসার টিকবে তো! স্বামী তোমায় ভালোবাসবে তো আজীবন এমনি করে! আরেকটি বিয়ে করে ফেললে কী হবে তোমার! স্বামীর সম্পত্তি পাবে তো তুমি! ইত্যাদি নানান হতাশার কথা নিঃসন্তান নারীকে শুনতে হয়।ফলে সে নিজের জীবনকে অনিরাপদ মনে করে পরিবারে ও সমাজে। সর্বোচ্চ দিয়ে সে চেষ্টা চালিয়ে যায় মা হওয়ার জন্য, তা বয়স যতই হোক আর তার শারীরিক সুস্থতা থাকুক বা না থাকুক। সমাজের এই চাপিয়ে দেওয়া মা হওয়ায়ই নারীর মনে আনন্দের চেয়ে বেশি কাজ করে ভয়।

আমরা সমাজ পরিবর্তন নিয়ে এত কথা বলি, অথচ মাতৃত্ব বা মা হতেই হবে, এই পুরনো ধ্যান-ধারণা নিয়ে কিছুই বলি না, ভাবি না। এ থেকে বের হতে পারি না। নারী কেন শুধু কোনো জাত হবে? জীবনে নারীকে কেন বিভিন্ন সম্পর্কের নারী হতে হয়?

আমাদের দায়িত্ব বিবাহিত নিঃসন্তান নারীকে মানসিক সাপোর্ট দেওয়া। তাকে এমন সাপোর্ট দেওয়া, যেন তিনি নিজেকে ছোট বা বঞ্চিত মনে না করেন। হতাশা বা দুঃখবোধ যেন তাকে স্পর্শ করতে না পারে। এই মহান দায়িত্ব স্বামীর পাশাপাশি পরিবারের সব সদস্যদের, সঙ্গে অবশ্যই সমাজ-রাষ্ট্রেরও। সন্তানহীন নারীর প্রতি সব ধনের মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন রোধের জন্য আমাদের প্রয়োজন দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন। এই দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনই সন্তানহীন নারীর প্রতি আমাদের মানবিক করতে পারবে। গড়ে উঠবে একটি সুন্দর সমাজ। আর তাই সন্তানহীন নারীদের প্রতি আমাদের এই দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনে পরিবার ও সমাজ তথা আমাদের সকলকে এগিয়ে আসতে হবে।

ডাউনলোড করুন অনন্যা অ্যাপ