Skip to content

৮ই সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দ | রবিবার | ২৪শে ভাদ্র, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

নারীকে কথা বলতে দিন

গর্ভধারণের ভার যেই নারীর ওপর, যে নারী বংশবৃদ্ধির অন্যতম সহায়ক, যে নারীরা সংসার-সন্তান লালন-পালনে দিবারাত্রি অক্লান্ত পরিশ্রম করে চলেছে, মায়া-মমতার অটুট বন্ধনে পরিবারগুলোকে সুগঠিত করে রাখতে সহয়তা করে, সমাজ-সংসারে সেই নারীরাই আজন্ম নিপীড়নের শিকার। কন্যাশিশু জন্ম নেওয়ার পর থেকে পরিবারের বৈষম্যমূলক আচরণ একজন শিশুর প্রকৃত বিকাশের পথে প্রধানতম অন্তরায়। 

বাবা-মা, আত্মীয় -স্বজন যখন শুধু কন্যাশিশু বলে তার অভিমত, খাওয়া-পরা, জীবনযাপন, খেলাধুলা প্রভৃতির প্রতি রেশ টেনে দেন; তখন স্বভাবতই একটি ভয়, আতঙ্ক, হতাশা ঘিরে ধরে ছোট্ট প্রাণটিকে ঘিরে। ধীরে ধীরে বড় হলেও এই সংকোচ, বাধা তাকে প্রাণখোলা, উচ্ছ্বল জীবনের সন্ধান দিতে পারে না। যখন একটি পাখির ডানা ভেঙে দেওয়া হয়, তখন স্বাভাবিকভাবেই সে উড়তে পারে না। উড়তে চেষ্টা করলেও প্রতিপদেই তাকে হতে হয় ব্যর্থ। শুধু তাই নয়, পাখিটি যেহেতু অন্য পশু-পাখির থেকে দুর্বল থাকে, তাই সামন্যতম কীট-পতঙ্গও তার ওপর অত্যাচার করতে শুরু করে, ঝাঁপিয়ে পড়ে। ধীরে ধীরে একসময় পাখিটির জীবনগতি শ্লথ, মৃত্যুমুখী হয়ে পড়ে। 

মনবজন্মও ঠিক এই পাখির মতোই। তাকে মুক্ত আকাশে উড়তে দিলে সঠিকভাবে বেড়ে উঠবে। দিনশেষে ঘরে ফিরবে। কিন্তু আমাদের অতি রক্ষণশীল সমাজ নারীদের কণ্ঠরোধ করে শৈশব থেকে। জীবনের ধারাবাহিকতাকে নদীর মতো বহমান হতে দেয় না। তবু কিছু অপ্রতিরোধ্য গতি তো থাকেই তাই উৎসমুখে যতই গতি থামিয়ে দেওয়া হোক না কেন, তারা গন্তব্য খুঁজে ফেরে। তবু নারীর মুক্তি ঘটে না। ঠোকর খেতে খেতে রক্তাক্ত মনে এগিয়ে যাওয়ার বাসনা নিয়ে মাঝে মাঝে ডুবে যায় হতাশায়-বিষাদে। 

পরিবারে নারীর প্রতি যে বৈষম্য তা দূরীভূত হোক। নারী তার আপন সত্তার মালিক হোক। কন্যা শিশুটি জন্মানোর পর থেকে বাবা-মা, আত্মীয়ের মুখে কালো ছাপ না পড়ুক। ছেলে-মেয়ের বিভেদ ভুলে পরিবারে বৈষম্যহীন মানসিকতা তৈরি হোক। পরিবার যদি সুস্থ মানসিকতায় ছেলে-মেয়েকে লালন-পালন করে তবে নারীর জাগরণ ঘটবে। নারী নিজের অধিকারের কথা মুখ ফুটে বলতে সক্ষম হবে। 

বেশিরভাগ নারী আছেন যারা আজীবন পরিবার-পরিজনের জন্য শুধু দিয়েই যান কিন্তু তাকে কেউ একটিবারও জিজ্ঞাসা করেন না, তার কী প্রয়োজন? তার মনের চাহিদা বা আকাঙ্ক্ষা কী! নারী শুধু চুপচাপ তাকে শুষে-নিংড়ে দিতে থাকেন।  কিছু বলার ক্ষমতা তার তৈরি হয় না। কারণ শৈশবেই পরিবার তার কণ্ঠরোধ করেছে। সব কথা বলা যাবে না, সব করা যাবে না, উচ্চস্বরে হাসতে নেই, মাথা নিচু করে চলতে হবে, পরিবারের সম্মান; সবকিছু একটি ছোট্ট প্রাণের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়। ভারটা এত বেশি হয়ে যায় যে, ভার সামলাতেই কন্যাশিশু ব্যস্ত থাকে। 

নারীদের যে জীবনে কিছু পাওয়ার আছে সেটা আজ অবধি বেশিরভাগ পরিবার শেখান না। তাদের শুধু শেখানো হয় দেওয়া, সহ্য করা, মেনে নেওয়া, মানিয়ে নেওয়ার শিক্ষা। ফলে নারীর জীবনের দুর্বিষহ যন্ত্রণা ক্রমাগত বাড়তেই থাকে। 

পরিবারের বাইরে এসে নারীর জন্য রয়েছে সমাজ নামক মহাসমুদ্র। পরিবার তাকে শেখায় না, সাঁতরে পার হওয়ার পদ্ধতি ফলে সমাজের মাঝে ডুবে মরতে হয় নারীকে। পরিবার যা শিক্ষা দেয় সেই শিক্ষার সঙ্গে যুক্ত হয় সমাজের আরোপিত আরও অজস্র বিধিনিষেধ। এই বিধিনিষেধ মানতে মানতেই একসময় জীবনের ক্ষণ ফুরিয়ে যায়। নারীর বোঝা হয়েই ওঠে না তার জীবনের উদ্দেশ। 

যুগের পরিবর্তনে কিছু সংখ্যক নারী আধমরা হয়ে ভাসতে ভাসতে তীর খোঁজার চেষ্টা করে।  কিন্তু সেই তীরে দাঁড়িয়ে আবারও পাশবিকতার শিকার হতে হয়। গণপরিবহন, কর্মক্ষেত্রে কোথাও সামান্যতম নিরাপত্তা মেলে না। নারীর শরীর হয়ে ওঠে যৌনতা, লালসা চরিতার্থ করার বস্তু সদৃশ। তাই গণপরিবহনে নারীকে দেখলেই অধিকাংশ পুরুষের মধ্যে কুপ্রবৃত্তি  জাগে। শুধু গণপরিবহন নয়, কর্মক্ষেত্রেও নারীরা চাপে থাকে। সবসময় সম্ভ্রম বাঁচিয়ে চলতে হয় তাকে। ঘরে-বাইরে নারীরা এমন  নিপীড়নের শিকার হলেও অধিকাংশ সময় নারীর কণ্ঠরোধ করা হয়। প্রতিবাদের ভাষা থাকে নীরব, নিশ্চুপ। 

সামাজিকভাবে সম্মানহানির ভয়ে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নারীরা চুপ থাকে। আবার কখনো কখনো  ভয়েও নারীরা মুখ বুজে অত্যাচার সহ্য করে। এই ভয় যেমন পরিবারে, তেমনি কর্মক্ষেত্রে; আবার বাইরের জগতেও। পরিবারে নারী ভীত; কারণ হয়তো মুখ খুললে সংসারটা ভেঙে যাবে, পিতা-মাতার কাছে নিজের অধিকারের নিশ্চয়তা বিধান করতে চাইলে পরিস্থিতির বৈপরীত্য ঘটতে পারে। কর্মক্ষেত্রে কথা বললে চাকরি চলে যেতে পারে। সম্মানহানি হওয়ার ভয়; গণপরিবহনে নির্যাতনের বিরুদ্ধে কথা বললে মানুষের চোখে সম্মানহানি ঘটতে পারে। ফলে নারীর কণ্ঠরোধ করছে পরিবার, সমাজ, পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা। 

মানুষরূপে সমাজে যতদিন নারী গ্রহণযোগ্য না হবে, ততদিন নারীরা নিরাপদ নয়। প্রতিনিয়তই নারীর সঙ্গে অন্যায়- অত্যাচার ঘটবে। তবে নারীকেই এই শৃঙ্খল ভেঙে বেরুতে হবে। নারীর কণ্ঠ উচ্চকিত থাক। নারী অন্যায়- অত্যাচার, মিথ্যার বিরুদ্ধে গিয়ে নিজের অধিকার, সত্যের সঙ্গে চলুক।  সুন্দর, সুস্থ জীবনযাপনের পথে এগিয়ে যাক বাধাহীন চিত্তে। 

ডাউনলোড করুন অনন্যা অ্যাপ