Skip to content

৩রা মে, ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দ | শুক্রবার | ২০শে বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

নিজ মাতৃভাষাই যেখানে নারীকে অবমাননা করে! 

যে নারী অঘটন ঘটাতে পটু, তাকে বলে 'অঘটন ঘটন পটিয়সী'। এটা ছাড়াও আরো অনেক প্রচলিত শব্দগুচ্ছ আছে, যেগুলো শুনলে নারীর প্রতি তীব্র অবমাননাকর ভাষা ব্যবহারের সংস্কৃতি ছাড়া কিছুই মনে হয় না। যেমন, 'চোরের মায়ের বড় গলা'। 'আবার নাও, ঘোড়া, নারী যে চড়ে তারই'। 'সংসার সুখের হয় রমনীর গুণে', 'রমনী সুন্দর হয় সতিত্ব রক্ষণে' ইত্যাদি। 

আবার, 'বাপ কা বেটা' একটা বাক্য প্রচলিত আছে। এই প্রচলিত বাগধারা ব্যবহৃত হয় কোনো সাবাস প্রকাশ করার অর্থে৷  অপর দিকে, 'চোরের মায়ের বড় গলা' ব্যবহৃত হয় উলটো অর্থে। মানে, কোনো একটা খারাপ কিছু করলে, সেটা মায়ের মতো। 

সম্প্রতি কিছু পাঠ্যপুস্তক ঘেঁটে দেখা গেছে, অনেক শব্দই বইগুলোতে এমনভাবে ব্যবহার করা হয়েছে, যা প্রচণ্ড জেন্ডার-সংবেদনশীল। শুধু তা-ই না, পাঠ্যপুস্তকে যখন মায়ের কোনো ছবি থাকে, সেই ছবিতে মায়ের অবয়ব থাকে রান্নাকরা আর ঘরের কাজ করার মত কিছু। আর বাবার থাকে শার্ট-প্যান্ট পরে অফিসে যাওয়ার অবস্থায়। অর্থ্যাৎ মা এবং বাবার যে দুটি ভিন্ন রোল পরিবারে  থাকে, সেটাকে আরো স্পষ্ট করে বৈধতা দেওয়ার প্রচেষ্টা। কিন্তু এ সমাজে কি এমন মা নেই, যারা চাকরিজীবী? যারা চাকরি করে এবং ঘর সামলায়? তাদের কোনো ছবি তো পাঠ্যপুস্তকে কখনো দেওয়া হয় না। 

কিছু শব্দ আছে, যেগুলোর কোনো লিঙ্গ-পরিবর্তন হয় না। যেমন, ‘বেশ্যা’ বা ‘পতিতা’। যে-সব মেয়ে টাকার জন্য পুরুষের সাথে যৌন-সম্পর্ক স্থাপন করে, তাদের বলে ‘পতিতা’ বা ‘বেশ্যা’। এই সমাজ যে মেয়েরা নিজের ইচ্ছামতো স্বাধীনভাবে চলাফেরা করে, নিজের পছন্দমতো পোশাক পরে এবং অনেক রাত পর্যন্ত বাইরে থাকে, তাকে বেশ্যা বা পতিতা বলে চিহ্নিত করা হয়! 

এরপর আরেকটি শব্দ হচ্ছে ‘সতী’। এই শব্দের বিপরীত হলো ‘অসতী’ । কিন্তু এর পুংলিঙ্গ নেই কোথাও। কারণ, সতী হওয়ার দায়িত্ব হয়ত কেবল নারীরই। ‘সতীত্ব’ ধারণাটি পুরুষের জন্য নয়।  সমাজে যৌন-পবিত্রতা রক্ষার দায়িত্ব কেবল নারীর! 

‘বিধবা’ শব্দটি ব্যবহার  তখন করা হয়, যখন কোনো নারীর স্বামী মারা যায়। ‘বিধবা’ মানে অমঙ্গল আর অকল্যাণ । তাই যেকোনো শুভ কাজে বিধবাদের পিছিয়ে রাখা হয়। 

মেয়েলি আচরণ কাকে বলে? বন্ধুদের আডডা এবং সাম্যাজিক আড্ডায় অনেক সময়ই ছেলেদের অপদস্ত করার জন্য অনেকে বলে, মেয়েদের মতো আচরণ করছিস ক্যান? বা মেয়েলি স্বভাব কেনো তোর। এই কথা শুনলে অনেকে অপমানিত বোধ করে। মেয়েদের মতো কোমল আবেগী কোনো বৈশিষ্ট্য কারো মধ্যে থাকলে সেটা যথেষ্ট অপমানজনক। তাই, ছেলেরা যখন কোমল আচরণ করে, তখন তাকে যথেষ্ট পুরুষালি বলা যায় না, বরং তাকে নিয়ে উপহাস করা হয়! 

এ-ছারা, পুরুষের রাগের যে একটা গৌরব আছে, সেটা সমাজ-স্বীকৃত। একটা প্রবাদ আছে, ‘পুরুষেরা রাগলে হয় বাদলা, আর মেয়েরা হয় বেশ্যা’। এই কথার মর্মার্থ বোঝানোর জন্য কোনো অভিধানের প্রয়োজন হয় না। এমন আরো অনেক বাংলা ব্যাকরণের অন্তর্ভুক্ত প্রবাদ রয়েছে এদেশে, যা পুরুষকে ও নারীকে ভিন্ন ভিন্ন কাঠগড়ায় রাখার অকৃত্রিম ভূমিকা পালন করে।প্রবাদ-প্রবচনে নারীর অবমাননা নিয়ে বিশ্বজিৎ ঘোষ বলেন, পুরুষ মারা গেলে শোক প্রকাশ করার মানুষের অভাব হয় না। যেমন, ‘মাছের মায়ের পুত্রশোক’। আর মেয়েরা মরে গেলে সেটাকে উপভোগ্য মনে করা হয়। সেখান থেকে এসেছে, ‘অভাগার গরু মরে, ভগবানের বউ মরে’।

মানুষের এই প্রচলিত বাক্যগুলো ব্যবহার করা বন্ধ করার অভ্যাস করা উচিত। কারণ, এই শব্দ দিন দিন ব্যবহৃত হয়ে মানুষের মনে অনেক বাই ডিফল্ট ধারণার জন্ম দিয়েছে। সেগুলোর ফল ভালো হচ্ছে না। সমাজের মানুষেরা কোন নারীর কত পুরুষের সাথে পরিচয় আছে, নারীর ছেলে-বন্ধু কয়জন সেটা দিয়ে সেই নারীকে সম্মান করবে কি করবে না, সেটা বিবেচনা করে। কিন্তু ছেলেরা যৌন- হয়রানি করলেও সেটা একরকম বৈধতা পেয়ে যায়। কারণ, ছেলেদের একটু ‘আলুর দোষ তো থাকেই’ বলে সমাজ ও মাতৃভাষা সেটাকে বৈধতা দিয়ে দেয়! 

 

 

ডাউনলোড করুন অনন্যা অ্যাপ