Skip to content

৮ই সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দ | রবিবার | ২৪শে ভাদ্র, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

আফ্রিকার বৃক্ষমাতা ওয়াঙ্গারি মাথাই!

ওয়াঙ্গারি মাথাই, যাঁকে অনেকে বৃক্ষমাতা বলেই ডাকতে পছন্দ করেন। মাটির গন্ধের ডাকে নিজ দেশেই গড়ে তোলা সর্বজনীন কার্যক্রম যে সমগ্র বিশ্বকেই অন্তর্ভুক্ত করতে পারে, তার প্রমাণ ওয়াঙ্গারি মাথাই। নিজের কাজের জন্য পেয়েছিলেন শান্তিতে নোবেল পুরষ্কার। সমগ্র বিশ্ব তাঁকে চেনেন গ্রিন বেল্ট মুভমেন্টের কারণে। কে এই ওয়াঙ্গারি মাথাই? একবার এই আফ্রিকান নারীর দিকে চোখে ফেরানো যাক। 
 
১৯৪০ সালের পয়লা এপ্রিল, কেনিয়ার নায়েরি শহরে ওয়াঙ্গারি মাথাইর জন্ম। নিজ দেশের প্রতি টান তাঁর বরাবরই ছিল। অবশ্য উচ্চশিক্ষার জন্য ওয়াঙ্গারি মাথাইকে বিশাল একটা সময় বিদেশের মাটিতে অবস্থান করতে হয়েছিল। প্রথমেই উচ্চশিক্ষার উদ্দেশ্যে আমেরিকায় পাড়ি। সেখানে ১৯৬৪ সালে আমেরিকার মাউন্ট সেন্ট স্কলাস্টিকা কলেজ থেকে জীববিজ্ঞানে বিএস ডিগ্রি অর্জন করেন। প্রাণী ও পরিবেশ নিয়ে তাঁর আগ্রহ বরাবরই বেশি ছিল। তারপর ১৯৬৬ সালে পিটসবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে এমএস ডিগ্রি অর্জন করেন। এবার দেশের টানে আবার কেনিয়ায় ফিরে আসা। পেছনে ফেলে আসা এক সম্ভাবনাময় পাশ্চাত্য-জীবন। সে-সব না হয় না-ই হলো, তবু মাথাইর হারানোর কিছু নেই।

 

আফ্রিকার বৃক্ষমাতা ওয়াঙ্গারি মাথাই!
 
তার আগে ডক্টোরাল ডিগ্রির জন্যে জার্মানি গিয়েছিলেন। কিন্তু মূলত নাইরোবি বিশ্ববিদ্যালয়েই ডক্তরাল ডিগ্রির কাজ সম্পন্ন করেন। নাইরোবি বিশ্ববিদ্যালয়ে তত দিনে ভেটেরিনারি অ্যানাটমির ওপর ক্ল্যাস নেওয়া শুরু করে দিয়েছিলেন। ওয়াঙ্গারির ডক্টরাল ডিগ্রি অর্জন একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। সমগ্র মধ্য এবং পূর্ব আফ্রিকায় সর্বপ্রথম নারী হিসেবে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জনের সুনাম তিনিই করেন। আফ্রিকায় তখনো নারী-শিক্ষা বিস্তারে বিভিন্ন সমস্যা ছিল। নারী-নির্যাতন একটি স্বাভাবিক ঘটনা। সেখানে উচ্চতর শিক্ষা অর্জনের সুযোগ হয়তো গুটিকয়েকের মিললেও ডক্টরাল ডিগ্রি পাওয়া এত সহজ ছিল না। এই ডিগ্রি অর্জনের পর তিনি ১৯৭৬ সালে ভেটেরিনারি অ্যানাটমির চেয়ার পদ পান। পরের বছর ওয়াঙ্গারি মাথাই একজন অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর হন। দুটো ক্ষেত্রেই ওই অঞ্চলেই তিনি প্রথম নারী হিসেবে এই যোগ্যতা অর্জন করেন। হয়তো মাথাইর গল্পটা এই সাফল্যের প্রচ্ছদেই আটকে রেখে শেষ করা যেত। কিন্তু না, মাথাইর জীবনে আরো অনেক কাজ বাকি। এই অর্জন তাঁকে এক ভীত গড়ে দিয়েছে মাত্র।

অধ্যাপনার সময়েই মাথাই নির্যাতিত নারীদের নিয়ে কাজ শুরু করেন। এ সময় তিনি একটি অদ্ভুত বিষয় লক্ষ্য করলেন। কেনিয়ার স্বাভাবিক ফসল উৎপাদনের ক্ষেত্রে বাধা লক্ষ্য করা গেল। সমগ্র বিশ্বে চা এবং কফির চাহিদা তখন তুঙ্গে। তাই স্থানীয় ব্যবসায়ীরা অন্য ফসল বাদ দিয়ে চা এবং কফি উৎপাদনে জোর করছেন। এতে কফি ও চা চাষের প্রয়োজনীয় জমির জন্যে বন কেটে উজাড় করে ফেলা হচ্ছে। সারা জীবন নিজ মাতৃভূমির বাতাসে বড় হয়েছেন। এই প্রাকৃতিক সমারোহ হারিয়ে যাবে, কখনই তা মেনে নিতে পারেননি। নিজের শিক্ষার জগত থেকেই প্রাণী-বৈচিত্র্য এবং পরিবেশ নিয়ে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল ছিলেন তিনি।

 

আফ্রিকার বৃক্ষমাতা ওয়াঙ্গারি মাথাই!

 
বন উজাড় এবং কফি চাষের সংকট আরো বড় সমস্যার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। কৃষকরা খাদ্য উৎপাদন করতে পারছেনা। স্বার্থান্বেষী মহল অবশ্য চা ও কফির মধ্যে সম্ভাবনা খুঁজে পাচ্ছেন। কিন্তু এদিকে কেনিয়ার মাঝে খাদ্যসংকট দেখা দিচ্ছে। এমনিতেও আফ্রিকাতে খাবারের অভাব আছে। আর বাজারে খাদ্যদ্রব্যের অভাবের সাথে সাথেই খাদ্যদ্রব্যের দাম পারদের মতোই উঠতে শুরু করেছে। এছাড়াও মাটির গুণগত মান নষ্ট হওয়া, গবাদিপশুর খাদ্যসংকট ও সুপেয় পানির অভাব যেন দিনকেদিন বেড়েই চলেছে। এই সংকট কিভাবে মোকাবেলা করা সম্ভব? মাথাই ভেবে দেখলেন গাছ লাগাতে হবে। এই গাছ থেকেই খাদ্য, জ্বালানী, আশ্রয় মিলবে। মূল সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে হলে গাছ লাগানোর বিকল্প নেই।

 

এতদিন কাজ করছিলেন নারীদের নিয়ে। লক্ষ্য করলেন গ্রামীণ নারীদের জীবন ও জীবিকার ক্ষেত্রে গাছ লাগালে বেশ সুবিধা হয়। দুটো ক্ষেত্রকেই তিনি এক করে নিলেন। শুরু করলেন বিখ্যাত 'গ্রিন বেল্ট মুভমেন্ট'। পরিবেশ নিয়ে একটি আন্দোলন – সহজই তো হবে, তাইনা? ১৯৭৭ সালে প্রথম প্রতিষ্ঠিত এই আন্দোলনের পথ এতটা সহজ ছিলোনা। কেনিয়ার অবকাঠামো এবং সামাজিক প্রেক্ষাপটে এমন চিন্তা রীতিমত অসম্ভবের কাতারে পরে। তখন নাইরোবিতে একটিমাত্রই পার্ক ছিলো। এই পার্কে একটি বহুতল ভবন নির্মাণের প্রস্তাবনা শুরু হয়। কিন্তু তা তো হতে দেয়া যায়না। মাথাই দ্রুতই এই সরকারী প্রকল্পের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নামেন। কেনিয়ার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ড্যানিয়েল ওয়াপ মোইয়ের এই আন্দোলনকে ভালো চোখে আর দেখতে পারলেন না। জেলকামান ও পুলিশ নামিয়ে আন্দোলন বানচালের পরিকল্পনা করেন। কিন্তু এই দমননীতি মাথাই-কে থামাতে পারেনি। তিনি আন্দোলন চালিয়ে গেলেন।একটি গাছ লাগালেই কয়েক সেন্ট মিলবে। এই রকম অভিনব ভাবনা শুধু পরিকল্পনাতেই নয়, বাস্তবেও প্রয়োগের নজির গড়ে তোলেন মাথাই। নিজ উদ্যোগে তিনি কেনিয়াতে সাড়ে চার কোটি গাছ লাগানোর ব্যবস্থা করেন। কেনিয়ার কিছু অঞ্চল যেন মরুভূমি হয়ে উঠছিলো। গাছ লাগিয়ে থামিয়েছিলেন এই মরুময়তা। আস্তে আস্তে কর্মসংস্থানও গড়ে উঠতে পেরেছিলো।

 

আফ্রিকার বৃক্ষমাতা ওয়াঙ্গারি মাথাই!

 

এসময় তিনি মানুষের মধ্যে সচেতনতা বাড়ানোর চেষ্টা চালান। একটি নার্সারি করেছিলেন যেখানে ছিলো প্রায় নয় লাখ চারা। গ্রামীণ নারীদের বাসস্থান, গির্জা ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে তিনি কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছিলেন। এই গ্রিন বেল্ট মুভমেন্ট দ্রুতই আফ্রিকার অন্যান্য নেতাদের মনোযোগ কাড়তে সমর্থ হয়। এই আন্দোলনে দ্রুতই তানজানিয়া, মালাবি, উগান্ডা, ইথিওপিয়া, লেসোথো এবং জিম্বাবুয়েসহ বেশ কিছু আফ্রিকান দেশ অংশগ্রহণ করতে শুরু করে। মূলত আফ্রিকার মরুময়তা কমানোর জন্যে এই আন্দোলন ছিলো একটি অনুপ্রেরণা।
 
এদিকে নারী ও নারী অধিকার নিয়ে কাজ তিনি থামাননি। সত্তরের দশকে রেড ক্রসের প্রধানের দায়িত্ব পালন করেন। এভাবেই তিনি আস্তে আস্তে রাষ্ট্রনীতির সাথে জড়িয়ে পড়তে শুরু করেন। ২০০২ সালে সংসদ নির্বাচনে অংশ নেন। সেবার ৯৮ শতাংশ ভোট পেয়ে তিনি বৈধভাবে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। নির্বাচিত হওয়ার পর ২০০৩ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত সফলভাবে পরিবেশ বিষয়ক প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন।
 
মাথাই এর এই আন্দোলন গুরুত্বপূর্ণ অনেকগুলো কারণে। এই আন্দোলন কেনিয়ায় নিজ দেশ ও এর সৌন্দর্য রক্ষার প্রচেষ্টা হিসেবে সকলের হৃদয়ে স্থান করে নেয়। কিন্তু একইসাথে দেশের গণতন্ত্র ও শান্তি শৃঙ্খলা রক্ষার আন্দোলন হিসেবেও এর পরিচিতি বাড়তে শুরু করে। এমনকি শোষণ ও দুর্নীতিবিরোধী আন্দোলন হিসেবেও এটি রূপ নেয়।

 

আফ্রিকার বৃক্ষমাতা ওয়াঙ্গারি মাথাই!

 

মাথাই এর প্রভাব কতটুকু তা বুঝতে হলে তার সম্মাননার দিকে চোখ ফেরাতে হবে। ২০০৪ সালেই তিনি শান্তিতে নোবেল পুরষ্কার লাভ করেন। পরের বছর ফোর্বস ও টাইম ম্যাগাজিনের প্রকাশিত বিশ্বের ১০০ প্রভাবশালী নারীর তালিকায় তার নাম উঠে আসে। তার পরের বছর তিনি ফ্রান্স সরকারের কাছে 'লেজিও দ্য অনার' এ ভূষিত হন। সে বছর ভারত সরকার তাকে ইন্দিরা গান্ধী শান্তি পুরষ্কার প্রদান করেন।

অবশেষে তার সংগ্রামী ও বর্ণিল জীবন থামে ২০১১ সালের ২৫ শে সেপ্টেম্বর। তার একটি উক্তি হয়তো নারীদের জন্যে একটি বিরাট অনুপ্রেরণা হয়ে উঠতে পারে। " সারা জীবনে আমি কোথাও থামতে শিখিনি। আমার পরবর্তী পদক্ষেপ কি হবে, সেটা আমি আগে থেকেই ভেবে রেখেছি। দরজা খোলা পেলেই আমি এগিয়ে গেছি। থামিনি কখনো। হাঁটুতে জোর থাকা পর্যন্ত- আমি হেঁটেই যাবো।"

 

 

ডাউনলোড করুন অনন্যা অ্যাপ