Skip to content

২রা মে, ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দ | বৃহস্পতিবার | ১৯শে বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

সিনেমাকে হার মানায় যার জীবন কাহিনি

পরনে পুরনো মলিন কোট-টাই, ঢিলেঢালা পুরনো প্যান্ট, মাথায় কালো রঙের বাউলার হ্যাট, হাতে একটি ছড়ি, পায়ে পুরনো এক জোড়া বুট এবং ঠোঁটের উপর খাটো একটুখানি টুথব্রাশ গোঁফ – এই লোকটাকে কে না চেনে! তিনি আমাদের সকলের প্রিয় মূকাভিনেতা চার্লি চ্যাপলিন। যিনি শুধু মাত্র তাঁর মুখের হাসি আর অঙ্গ ভঙ্গির অভিনয় দিয়ে বিশ্বের প্রতিটি মানুষের বিনোদনের খোরাক যোগায়। বিশ্বের ইতিহাসে সর্বকালের সেরা ও সবচেয়ে জনপ্রিয় চলচ্চিত্র ব্যক্তিদের তালিকা করা হলে নিঃসন্দেহে চার্লি চ্যাপলিনের নাম একদম উপরের দিকেই থাকবে।

 

চার্লি চ্যাপলিনের পুরো নাম স্যার চার্লস স্পেনসার চ্যাপলিন জুনিয়র। তিনি শুধু অভিনেতাই ছিলেন না, একই সাথে ছিলেন পরিচালক, সুরকার, চিত্রনাট্যকার, প্রযোজক এবং সম্পাদক। চার্লি চ্যাপলিনের জন্ম হয়েছিলো ১৬ এপ্রিল ১৮৮৯ সালে যুক্তরাজ্যের এর লন্ডন শহরে। তাঁর বাবা চার্লস স্পেনসার্স চ্যাপলিন সিনিয়র ও মা হেরা চ্যাপলিন মিউজিক হলের জুনিয়র আর্টিস্ট ও সিঙ্গার ছিলেন।

 

চার্লি চ্যাপলিনের জীবন সিনেমাকেও হার মানায়। তাঁর প্রথম রোজগার ছিল মাত্র পাঁচ বছর বয়সে। যখন তাঁর মা একদিন টাউন হলে গান গাওয়ার সময় গলায় সমস্যা দেখা দেয় ও আওয়াজ বের হচ্ছিল না। দর্শকরা বিরক্ত হয়ে চিৎকার চেঁচামেচি করেন ও সবাই চ্যাপলিনের মাকে অপমান করা শুরু করেন। ছোট চ্যাপলিন তখন মায়ের বিপদ দেখে স্টেজে উঠে আসেন এবং তাঁর মায়ের গাওয়া গান অভিনয়ের সাথে গাইতে শুরু করেন দর্শকদের তাঁর এই আধো আধো কণ্ঠে গাওয়া গান খুব উপভোগ করেন স্টেজে পয়সার বৃষ্টি শুরু হয়। বাস্তবে ঘটে যাওয়া দরিদ্রতায় পিষ্ট মানুষের জীবনের গল্পও যে মানুষকে বিনোদন দিতে পারে চ্যাপলিন তা বুঝেছিলেন। তাই পরবর্তীতে তাঁর অভিনয়ে মাধ্যমে তিনি দুঃখ, কষ্ট, একাকীত্ব, বেকারত্বে মতো ঘটনা অভিনয়ের মাধ্যমে তুলে ধরেছেন লোককে আনন্দ দেয়ার জন্য।

 

কষ্ট ও দরিদ্রতায় পরিপূর্ণ ছিল চার্লি চ্যাপলিনের শৈশব। মাত্র ছয় বছর বয়সে চার্লির বাবা ও মায়ের মধ্যে বিবাহ বিচ্ছেদ হয়। দারিদ্র্যতার দুঃচিন্তায় চার্লির মা কিছুদিনের মধ্যেই মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে পাগলা গারদে চলে যায়।

তখন আদালতের নির্দেশে চার্লি ও তার ভাইকে তাঁর বাবার কাছে থাকতে হত। চার্লির বাবা তখন আবারো বিবাহ করেছিলেম সৎ মায়ের সংসারে তাই চার্লি ভাইদের কষ্টের কোন কমতি ছিল না। এক বছর পরে চার্লির মা ভালো হয়ে ফিরে আসলে তাদের জীবনে আবার প্রাণ ফিরে আসে।

 

পড়াশোনায় অমনোযোগী চার্লি অভিনয়কেই তাঁর জীবনের লক্ষ হিসেবে মনে স্থান দিয়েছিলেন। দশ বছরের ও কম বয়স থেকে চার্লি স্টেজ শো করতেন। 

 

উনিশ বছর বয়সে চার্লি চ্যাপলিন আমেরিকায় পাড়ি জমান। আমেরিকায় এবং হলিউডে তখন ছিল নির্বাক চলচ্চিত্রের যুগ। কৌতুক করার ব্যাপারে চার্লি চ্যাপলিন ছিলেন অসাধারণ মেধাবী। ১৯১৩ সালে আমেরিকার নামকরা সিনেমা নির্মাতা প্রতিষ্ঠান "নিউ ইয়র্ক মোশন পিকচার" চার্লির সাথে চুক্তি করে। তাঁর পরের বছর মুক্তি পায় চার্লি চ্যাপলিনের একক সিনেমা Making A Living, দর্শক মহলে তাঁর অভিনয়ের মুগ্ধতায় পরবর্তীতে আরো অনেক সিনেমায় কাজ করেন। ১৯১৪ সালেই চার্লি প্রথম পরিচালক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। তাঁর প্রথম পরিচালিত সিনেমা Caught in the Rain, তাকে খুবই জনপ্রিয়তা প্রদান করে এবং তাঁর জীবনের গতিপথ বদলে দেয়। পরবর্তী জীবনে বিশ্বজোড়া যে খ্যাতি তিনি পেয়েছিলেন তাঁর সূতিকাগার ছিল যুক্তরাষ্ট্রেই। লিটল ট্র্যাম্প ভবঘুরের যে চরিত্রটি তিনি তৈরি করেছিলেন, খুব অল্প সময়ের মধ্যে সেটা বিশ্বজোড়া খ্যাতি অর্জন করে।

 

তাঁর বেশীরভাগ চলচ্চিত্র হাস্যরসাত্মক হলেও প্রতিটি চলচ্চিত্রই একটি বার্তা বহন করে। তিনি তাঁর সিনেমাতে দেখিয়ে দেন মানুষের জীবন চলমান, থেমে থাকার নয়। "মডার্ণ টাইমস" চলচ্চিত্রে দেখিয়েছেন যন্ত্রসভ্যতার ভেতরে একজন শ্রমিক যান্ত্রিক হবার বাইরেও পরিপূর্ণ মানবিকতা নিয়ে বাঁচতে পারেন। আবার সম্পদের কাছে একজন মানুষের মানবিকতা খাদের তলানিতেও নামতে পারে। "সিটি লাইটস" চলচ্চিত্রে দেখিয়েছেন সবকিছুর মধ্যেই আছে ভালোবাসা, প্রেম, মানবিকতা ও জীবনের জয়গান। "দ্য কিড" সিনেমাতে দেখিয়েছেন কেউ সাথে না থাকলেও কিভাবে চলতে হবে জীবনের জন্য, মানুষের জন্য। তাঁর অন্যান্য বিখ্যাত চলচ্চিত্র হচ্ছে দ্য সার্কাস, দ্য ডিক্টেটর, দ্য গোল্ড রাশ ইত্যাদি।

 

তাঁর দ্য ডিক্টেটর চলচ্চিত্রটি মূলত এডলফ হিটলারকে ব্যঙ্গ করে বানানো হয়েছিলো কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র তাতে "কম্যুনিজম"-এর ছাপ পেয়েছিল। তাই তারা ১৯৫২ সালে চ্যাপলিন যখন যুক্তরাজ্যে অবস্থান করছিলো তখন তাঁর যুক্তরাষ্ট্রে আসার উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। তখন তিনি সুইজারল্যান্ডে স্থায়ী হোন। মৃত্যু পর্যন্ত সেখানেই ছিলেন। চার্লি চ্যাপলিন ছিলেন অভিমানী। অবশ্য এ ঘটনার ২০ বছর পর ১৯৭২ সালে তিনি অস্কারের বিশেষ সম্মাননা গ্রহণ করার জন্য যুক্তরাষ্ট্রে গিয়েছিলেন।

চ্যাপলিন তিনবার একাডেমি পুরস্কার (অস্কার) অর্জন করেন। এছাড়াও ১৯৭৫ সালে কমান্ডার অব দি অর্ডার অব দ্য ব্রিটিশ এম্পায়ারের নাইট উপাধিতে ভূষিত হন, ১৯৬২ সালে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় এবং ডারহাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সম্মানসূচক ডক্টর অব লেটার্স ডিগ্রি এবং ১৯৭১ সালে ফ্রান্স সরকার তাকে লেজিওঁ দনরের কমান্ডার উপাধিতে ভূষিত করেন।

 

১৯৭২ সালে ভেনিস চলচ্চিত্র উৎসব থেকে গোল্ডেন লায়ন পুরস্কার এবং লিংকন সেন্টার ফিল্ম সোসাইটি থেকে আজীবন সম্মাননা পুরস্কার লাভ করেন। লিংকন সোসাইটি প্রদত্ত পুরস্কারটি পরবর্তীতে চ্যাপলিন পুরস্কার হিসেবে প্রতি বছর চলচ্চিত্র নির্মাতাদের প্রদান করা হচ্ছে। ১৯৭২ সালে হলিউড ওয়াক অব ফেমে চ্যাপলিনের নামাঙ্কিত তারকা খচিত হয়। ১৯৭৬ সালে ব্রিটিশ একাডেমি অব ফিল্ম অ্যান্ড টেলিভিশন আর্টস (বাফটা) থেকে ফেলোশিপ প্রদান করা হয়। আমেরিকার লাইব্রেরি অব কংগ্রেস চ্যাপলিনের ছয়টি চলচ্চিত্রকে জাতীয় চলচ্চিত্র রেজিস্ট্রিতে সংরক্ষণের জন্য নির্বাচিত করেছে।

 

১৯৭৭ সালের বড়দিনে সুইজারল্যান্ডের বাড়িতে চার্লি চ্যাপলিন শেষ নি:শ্বাস ত্যাগ করেন। ১৯৭৭ সালে মৃত্যু বরণ করলেও তাঁর জনপ্রিয়তা এখন কমেনি বরং বেড়েছে।

 

 

ডাউনলোড করুন অনন্যা অ্যাপ