Skip to content

৩রা মে, ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দ | শুক্রবার | ২০শে বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

জাতিগতভাবে বাবা দিবস পালনের কতটুকু উপযুক্ত আমরা?

জুন মাসের তৃতীয় রবিবার আজ। দিনভর হয়তো পত্র-পত্রিকা, টিভি-চ্যানেলের নিউজ আর সোশ্যাল মিডিয়ায় বিশ্বের সকল বাবাকে নিয়ে উদ্দেশ্য করে বিভিন্ন ফিচার, ডকুমেন্টারি কিংবা অজস্র হ্যাশট্যাগ (#) হ্যাপি ফাদার্স ডে বা বিশ্ব বাবা দিবসের পোস্ট চোখে পড়বে। অধিকাংশই আমাদের প্রত্যেক সন্তানের জন্য তার পিতার সারাজীবনের আত্মত্যাগ আর সন্তানের জন্য দুঃখ-কষ্টকে উৎসর্গ করা আবেগটুকু প্রকাশ পাবে।

 

কিন্তু এর মাঝেও নীরবে এই দিবসকে কাটিয়ে দিবে বাবার অধিকার হতে বঞ্চিত কিংবা কখনোই বাবার দেখা না পাওয়া অগণিত সন্তানেরা। আবার উল্টো ঘটনাও দেখবেন যদি মানবিক চোখে খুঁজে বেড়ান। সন্তানের দেখা ছাড়াই বাবা দিবসের উদযাপন চলে অসংখ্য বৃদ্ধাশ্রমে। তাহলে বলুন, জাতিগতভাবে বাবাকে ছাড়াই বাবা দিবসের উদযাপন ঠিক কেমন করে কাটে এই সোনার বাংলায়?

 

এক জরিপে দেখা যায়, বাংলাদেশের প্রায় ৪৪ লাখ অনাথ শিশু রয়েছে। অর্থাৎ, পিতৃ অধিকার-বিহীন বড় হতে থাকা শিশুর সংখ্যা যে দেশে এতো বিশাল, সে দেশে বাবা দিবস নিয়ে জাতিগত উদযাপন বা পালন দৃষ্টিকটু লাগে না? আরেকটু ব্যাখ্যা করি।

 

আগে বলে নেই, ৪৪ লাখ অনাথ শিশু রয়েছে বলে এ দেশে বাবা দিবস কিংবা মা দিবস পালন করা যাবে না, তা কিন্তু নয়। কিন্তু একই সমাজে থেকে যে সন্তানেরা কখনো বাবা নামক অধিকারের সম্পর্ক থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, তাদের কাছে বাবা দিবসের আয়োজন দেখে অবাক লাগে না? এই অবাক হওয়ার সংখ্যা কিন্তু কম নয় আর এই জন্যই মানবিক দিক থেকে আমাদের ভেবে দেখবার বিষয়। 

 

আচ্ছা, আরেকটা বিষয়ে চোখ বুলিয়ে নেই। সম্প্রতিকালের সকল জরিপ আর নিউজ আর্টিকেলের দিকে দৃষ্টি দিলে দেখবেন, দেশের সুশীল সমাজ আমাদের দেশের ক্রমবর্ধমান প্রবীণ সংখ্যা নিয়ে খুবই চিন্তিত। দেশের জনসংখ্যার প্রায় ৭ শতাংশ নাকি প্রবীণ, সংখ্যায় যা প্রায় দেড় কোটি। ২০২৫-এ এই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়াবে ২ কোটিতে আর ২০৫০ সালে হবে ৪ কোটি। প্রবীণ বৃদ্ধির হার জন্মহারের তুলনায় বেড়ে যাবে। এবং বয়স ৬০ এর উপরের এই বিশাল জনগোষ্ঠীর স্বাভাবিকভাবে চাকরির বয়সসীমা বর্তমানে ৫৯, আর মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য ৬১ বছর পর্যন্ত।

 

কিন্তু দেশের বর্তমান গড় আয়ু ৭২.৬ বছর(তথ্যসূত্রঃ বিবিএস)। অর্থাৎ জীবনের সবচাইতে নাজুক সময়ে এই বাবাদের জীবন কাটে একাকীত্ব, আর্থিক টানাপোড়েন আর অবহেলার মাঝে। নগরায়নের এই যুগে গ্রামীণ বাংলার সেই একান্নবর্তী পরিবারের তো দেখা মেলে না, তাই অবহেলা শব্দটা বিশেষভাবে উল্লেখ্য।

 

লে চিন্তা করেন, দেশের মাত্র ৬টি সরকারি বৃদ্ধাশ্রমে এই বিশাল সংখ্যক বাবা'দের কিংবা মা'দের  'বাবা দিবস' কিংবা 'মা দিবস' পালন কিভাবে সম্ভব?

 

শেষ বাক্যটা ব্যাঙ্গাত্মকভাবে বললেও, তা নিদারুণ সত্যি যে আমাদের চোখের সামনেই অসংখ্য বাবা, মা'র সামনে এই নিতান্তই নাটক ছাড়া আর কিছু নয়, যা বছরের পর বছর তারা দেখে আসছে। এ দেশের মানুষের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের দুনিয়াতে কিংবা পত্র-পত্রিকার জগত ঘুরে এ সকল দিবস পালন দেখে যতটা মনে শান্তি আসে, বাস্তব জগতের সম্পর্কের টানাপোড়েন দেখে মানবিক জায়গায় এই দেশের মেরুদণ্ড বহুকাল ধরে ভেঙে রয়েছে, তা অস্বীকার করা সম্ভব না।

 

গত ৯ই ফেব্রুয়ারি মেহেরপুর জেলার মুজিবনগর উপজেলার ৮০ বছর বয়স্ক মূসা করিম সাহেবের ঘটনা মনে আছে তো?   প্রবীণ এই মানুষকে পুত্রবধূ ও নাতি মিলে বাসা থেকে বের করে দেয়ার পর এলাকাবাসীর কাছে বিচার চেয়েছিলেন। তারপর শেষ ভরসা হিসেবে বিষের বোতল নিয়ে হাজির হয়েছিলেন স্থানীয় জেলা প্রশাসকের সামনে। সবার সামনেই এগুলো ঘটে চলছে। বছরের ৩৬৪ দিন এ ধরনের বিভিন্ন ঘটনা আমার, আপনার সামনে তামাশা হয়ে দাঁড়ায়, আর বছরের একদিন তা রূপ নেয় শ্রদ্ধা আর ভালোবাসায় স্মরণ করার, আর প্রবীণ মূসা করিম' রা বনে যায় শুধুই তার পরিবারের বোঝা।

 

আবারো বলছি, ব্যক্তিগতভাবে কেউ তার বাবাকে কিংবা মাকে ভালোবেসে এই দিবসকে আলাদাভাবে উদযাপন করবে, এতে কারোরই আপত্তি থাকার কথা নয়। কিন্তু যে জাতির এতো সংখ্যক শিশু পিতৃ-মাতৃহীন পরিচয়ে, অধিকারে এবং যত্ন-হীনভাবে বড় হয়, কিংবা দেশের প্রবীণদের থাকা খাওয়ার জন্য বৃদ্ধাশ্রম বাড়ানোর চিন্তায় কপালে ভাঁজ পড়ে যায়; সে জাতির বাবা দিবস উদযাপনের আগে জাতিগতভাবে ন্যূনতম লজ্জাবোধ চলে আসাটা জরুরি। জাতিগতভাবে চিন্তা করলে, প্রত্যেকের শুধুমাত্র নিজ নিজ বাবা, মা কিংবা পরিবার নিয়ে উদযাপনের ব্যাপারটি খুবই অমানবিক এবং জাতিগত অসচেতনতার প্রভাব। 

 

আপনি কল্পনা করতে পারেন, দেশের আড়াই কোটি ফেসবুক ব্যবহারকারী নিজ নিজ পারিবারিক চিন্তায় মশগুল এবং নিজেদের ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ করবে ভার্চুয়ালি, কিন্তু বছরকে বছর এদেশেরই এক বিশাল জনগোষ্ঠীর ব্যাপারে কারো কোনো মাথা ব্যথা নেই! আমাদের আজকের যে প্রজন্ম এমন জাতিগত উদাসীনতার পরিচয় দেয়, সেখানে বৃদ্ধাশ্রমের ব্যাপারে আরো গভীরভাবে চিন্তা শুরু করাই যথাযোগ্য হবে।

 

কেউ ব্যক্তিগতভাবে এই দিবস পালন করলে সত্যিকারই কোনো অভিযোগ মানায় না। তবে দিবস পালন বা উদযাপনের চাইতেও এই সকল দিবসের মর্মার্থ বা পালনের ভাবার্থ উদ্ধার করতে না পারলে, তা এর মূল উদ্দেশ্যকে ব্যহত করে। আমরা এই প্রজন্ম তাহলে কোন দীক্ষায় দীক্ষিত হলাম যে এতো বড় বৈষম্য আমাদের চোখে পড়ে না; দেশের কোথাও এই ব্যাপারে কোনো কর্মতৎপরতা, আলোচনা, হুলস্থূল, আশংকাপ্রকাশ কিংবা উদ্বেগ সৃষ্টি হয় না!

 

তাহলে এমন করে এই 'বিশ্ব বাবা দিবস' কিংবা 'মা দিবস' পালনে আমাদের স্বার্থকতা কোথায়? পিতৃহীন এই সন্তানদের কিংবা সন্তানদের দ্বারা অবহেলিত এই বাবা'দেরকে 'বাবা দিবস'-এর শুভেচ্ছা জানানোর দায়িত্ব কে নিবে? 

 

 

ডাউনলোড করুন অনন্যা অ্যাপ