বাংলা সাহিত্যে মা চরিত্র
মা বাংলা ভাষাভাষীদের জন্য একটি প্রচণ্ড আকর্ষণীয় স্নেহময়ী ও আবেগময় শব্দ। "মা" এই শব্দটির চেয়ে অধিক শ্রুতিমধুর ও প্রিয় শব্দ পৃথিবীতে আর নেই। মা কে ভালবাসে না কিংবা মাকে নিয়ে ভাবে না, এমন লোক হয়তোবা খুব কমই আছে। গর্ভজাত হোক অথবা দত্তকই হোক। সেখানে মা মানেই একটা মায়াবী স্নেহময়ী অবস্থান। পৃথিবীর প্রায় সব ভাষাতেই মাকে নিয়ে সাহিত্য রচনা হয়েছে। অতীতে মাকে নিয়ে সাহিত্য রচনা হয়েছে। বর্তমানে হচ্ছে। ভবিষ্যতেও মাকে নিয়ে সাহিত্য রচনা হবে। কি গল্প, উপন্যাস, কবিতা বা সিনেমা। মাও সন্তান সম্পর্কে প্রবচন ও সাহিত্য একটি কথা প্রচলিত সমগ্র বাংলায় ‘কুপুত্র যদি বা হয়, কুমাতা কখনো নয়’ অর্থাৎ মায়ের অবস্থানটি অত্যন্ত সহনশীল ও স্নেহময়ী। সন্তানেরা মায়ের সাথে অসদাচরণ করলেও মা কখনো সন্তানের অমঙ্গল কামনা করে না। যুগে যুগে মা-কে নিয়ে তেমনি রচিত হয়েছে অনেক সাহিত্য। এবং এর অধিকাংশই অনেক জনপ্রিয় হয়েছে এবং এই সব সাহিত্যের আবেদন কোনদিনই কমবে না। এমন কিছু বই নিয়ে আজ আমরা আলোচনা করবো।
জননী – মানিক বন্দোপাধ্যায় : বাংলা সাহিত্যে মা – কে নিয়ে রচিত একটি অসাধারণ উপন্যাস "জননী"। মানিক বন্দোপাধ্যায়ের সাহিত্য নিয়ে আমার বলার কিছু নেই। ইনি আমার খুবই প্রিয় একজন ঔপন্যাসিক। এই উপন্যাসে তিনি মা চরিত্রকে ফুটিয়ে তুলেছেন জীবন যুদ্ধে নিজের শরীরের শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে টিকে থাকার চেষ্টায় রত এক সংগ্রামী মহিলাকে। সব ধরনের বিপদ মোকাবেলাও করেও, চরম অসহায়ত্বের মাঝেও মা যে কতটা যত্নবতী হতে পারে, "জননী" সেরকমই একটি সাহিত্য। অনেককে বলতে শুনেছি, গোর্কির "মা" থেকে নাকি তিনি অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন।
বিন্দুর ছেলে – শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় : আরেকটি অসাধারণ উপন্যাস "বিন্দুর ছেলে"। মায়ের স্নেহ যে কতটা বিশাল হতে পারে, মাতৃছায়ার ছায়া যে কতটা বিস্তৃত হতে পারে, তা এই উপন্যাসে লেখক প্রকাশ করেছেন। মায়ের স্নেহ বলতে আমরা যে ধারণা আমাদের হৃদয়ে ধারণ করি তার আক্ষরিক রূপ এই উপন্যাসে পাওয়া যায়। "রামের সুমতি" নামে লেখকের আরেকটি উপন্যাস রয়েছে, যেটিও মা কে নিয়ে রচিত।
গোরা – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর : গোরা বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অনন্য একটি উপন্যাস। এই উপন্যাসের মা আনন্দময়ী চরিত্রটি সমস্ত সীমার ঊর্ধ্বে। অর্থাৎ, মা যে যেকোন জাতভেদকে মাড়িয়ে জননীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে পারেন, তাই এই উপন্যাসে দেখানো হয়েছে।
মা – আনিসুল হক : মুক্তিযুদ্ধের সত্যিকারের ঘটনা নিয়ে লেখা আনিসুল হকের উপন্যাস ‘মা’ (২০০৪)। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানী সেনা বাহিনী যখন ঢাকা শহর অবরুদ্ধ করে রেখেছিল, সে সময় অকুতোভয় গেরিলা গ্রুপ ‘অপারেশন ক্রাক প্লাটুন’ পাক-সেনাদের ওপর একের পর এক চালাতে থাকে সাহসী হামলা। তরুণ মুক্তিযোদ্ধা মাগফার আহমেদ চৌধুরী (আজাদ) ছিলেন ক্রাক প্লাটুন গ্রুপের অন্যতম সদস্য। কিন্তু পাক সামরিক জান্তা ১৯৭১ সালের ২৯ আগস্ট পুরনো ঢাকার বাড়ি থেকে গ্রেফতার করে তাকে। আজাদের মা সাফিয়া বেগম ধর্ণাঢ্য পরিবারের স্ত্রী হয়েও স্বামীর দ্বিতীয় বিয়েকে মেনে নিতে না পেরে ওই বাড়িতেই আজাদকে নিয়ে থাকতেন। পাকিস্তানী সেনা বাহিনীর চরম নির্যাতনের মুখেও মুক্তিযোদ্ধা আজাদ কওনও তথ্য দেননি। সে সময় কারাগারে মা দেখা করেন আজাদের সঙ্গে। মুক্তিযোদ্ধা আজাদ মাকে জানিয়েছিল, পাক সেনারা তাকে মাটিতে শুতে দিয়েছে। আর তাকে ভাতও খেতে দেয়নি। এই ছিল মায়ের সঙ্গে শহীদ আজাদের শেষ সাক্ষাৎ। এর পর শহীদ আজাদের মা সাফিয়া বেগম স্বাধীন দেশে ১৪ বছর ভাত না খেয়ে, মাটিতে শুয়ে কাটিয়েছেন। এসব সত্যি ঘটনাই উঠে এসেছে আবেগ তাড়িত ‘মা’ উপন্যাসে।
এই মা এখন আর আজাদের একার মা নন। তিনি এ দেশের কোটি বাঙালির মা। একজন অনন্য মা হিসেবে চিরকাল বেঁচে থাকবেন এ দেশের মানুষের হৃদয়ে।
জননী – শওকত ওসমান : বাংলা ভাষার অন্যতম লেখক শওকত ওসমানের গবেষক মৌরী তানিয়া ‘জননী’ (১৯৫৯) বইটি সম্পর্কে বলেন, ‘তিনি (শওকত ওসমান) রচনা করেছেন ‘জননী’-র মতো বিখ্যাত উপন্যাস। এই উপন্যাসটি ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন প্রবাসী বাঙালী ওসমান জামাল। ‘জননী’ প্রকাশিত হয়েছে লন্ডনের একটি নামজাদা প্রকাশনা সংস্থা থেকে। এই বিষয়ে শওকত ওসমান সাহিত্যের আরেক দিকপাল কবি শামসুর রাহমানকে তাঁর স্বভাবসুলভ চমৎকার ভঙ্গিতে বলতেন, ‘শোনো শামসুর রাহমান, আমি পাশ্চাত্যকে অন্তত একটি বাংলা শব্দ উপহার দিয়েছি – জননী।’ লন্ডনের দি গার্ডিয়ান পত্রিকা ‘জননী’ বিষয়ে সপ্রশংস আলোচনা প্রকাশ করেছে।’
মুক্তিযুদ্ধে মা – কে নিয়ে রচিত কিংবা মা- কেন্দ্রিক –
১. একাত্তরের দিনগুলি – জাহানারা ইমাম
২. জ্যোৎস্না ও জননীর গল্প – হুমায়ুন আহমেদ
এই উপন্যাসগুলো যদি না পড়ে থাকেন তাহলে জলদিই পড়ে নিন। এই উপন্যাসগুলো জানান দেয় সন্তানের প্রতি মায়ের স্নেহ, ভালোবাসা, ত্যাগ কতো দৃঢ় হতে পারে। এই উপন্যাসগুলি আপনাকে ‘মা’ চরিত্রকে ভালোবাসতে শিখাবে।