গার্হস্থ্যরূপ কিংবা রণরঙ্গিণী
কন্যা, জায়া, জননী- তিনরূপেই নারী অধিষ্ঠিতা। প্রতিষ্ঠিত সকল ক্ষেত্রেই। যে-হাতে দোলনা দোলায়, সে হাতেই বিশ্ব চালায়। নারীর মাঝেই বিদ্যমান সকল রূপ। নারী আজ দেবী দুর্গার প্রতিভূ শুধু মাতৃরূপে নয়Ñ শক্তিরূপে, বিদ্যারূপে, বুদ্ধিরূপে বিরাজমান ব্যক্তি ও সমাজজীবনের সকল স্তরে। বর্তমান সমাজে নারী যেখানে কোমল, ক্ষমতাহীন, যৌনতার প্রতীক সেখানে ‘শক্তি-রূপেন সংস্থিতা’ দেবী দুর্গার মহিষাসুর-মর্দিনী প্রতিমা স্মরণ করিয়ে দেয় আদিম মাতৃতান্ত্রিক সমাজের নারী-নেতৃত্বের কথা। প্রাচীন সমাজগুলোতে মাতৃদেবীর পূজাই ছিল প্রধান। দেবীদের মাহাত্ম্যসূচক পৌরাণিক আখ্যানগুলো মাতৃতন্ত্রের অবশেষরূপে সমাজে টিকে ছিল বহুকাল।
শরৎ-হেমন্তে ফসল তোলার সময় আবহমানকাল থেকেই এ জনপদে উৎসবের রীতি ছিল। সে উৎসবেরই একটি অংশ শারদীয় পূজা। ফসল তোলার সময় বাবা-মায়ের ঘরে বেড়াতে আসে প্রিয় কন্যা। সঙ্গে আসে তার স্বামী ও ছেলেমেয়েরা। দেবী দুর্গার পূজা রূপ পায় বাঙালির গৃহস্থ পরিবারের মিলনোৎসবে। কতটা আটপৌরে সাদামাটা জীবনের ছবি ভাসে আমাদের চোখের সামনে দেবী দুর্গাকে ঘিরে। অথচ তিনিই সময়ে আবির্ভূত হন কালী বা চন্ডীরূপে। অসুরের বিনাশকারী দেবী দুর্গাই সময়ে অসীম শক্তি ধারণ করেন। এটিই নারীর প্রকৃত রূপ। সময়ে নরম, সহজ-সরল গার্হস্থ্যরূপ, সময়ে রণরঙ্গিনী। নারী বহুরূপের আধার। একই সঙ্গে শান্তি ও শক্তি, একই সঙ্গে দশভুজা ও সর্বংসহা। শুভ ও কল্যাণের প্রতিই যেন নারীর সকল আকর্ষণ, প্রবল আকর্ষণ। অশুভের প্রতি তাই তার তীব্র প্রতিক্রিয়া, চন্ডীমূর্তি। যা অসুরের মতো পুরুষরা (সব পুরুষ নয়) সহ্য করতে পারে না। পুরুষতান্ত্রিক মানস ও সমাজ কাঠামো যাকে প্রতিনিয়ত পদাঘাত করে। আর তখনই নারী জেগে উঠতে চায় কিংবা জেগে ওঠে। নারীসত্তা তাই সকল সময়ে অসুন্দরের বিরুদ্ধে জেগে ওঠে, নারী তাই জাগরণীয়া। দুর্গা যেন শাশ্বত নারীরই প্রতিবিম্ব। নারী আর দুর্গা তাই এক ও অভিন্ন।
পূজাম-পগুলোতে যে ঐতিহ্যবাহী চেহারায় প্রতিমা দেখা যায় তার দশহাতে অস্ত্র, বাহন হিসেবে সিংহ এবং পায়ের নিচে অসুর থাকলেও দেবীর মুখ সুন্দর ও কোমল। এই দেবী পরিপূর্ণভাবে বাঙালি নারী। আর্যদের মতো তার চুল সোনালি নয়, বরং অনার্যসুলভ কালো ও কুঞ্চিত। তার শাড়ি বাঙালিঢঙে পরা; কণ্ঠহার, কঙ্কন, চন্দ্রহারসহ অলংকারগুলো প্রাচীন বাংলায় প্রচলিত অলংকারের প্রতিরূপ। তিনি ত্রিনয়না বটে, তবে তার দীঘল কালো চোখ ও মুখাবয়ব চিরন্তন বাঙালি নারীর। বাঙালি নারী ও দেবীরই প্রতিরূপ। দশভুজা দেবীর মতোই বাঙালি নারী ঘরে-বাইরে সব কাজ সামলে চলেন।
মূলত, শারদীয় দুর্গোৎসব বাঙালির সামাজিক উৎসব। এ উৎসব মিশে আছে শরতের শিউলি আর ছাতিম ফুলের সৌরভে, কাশবনের শুভ্রতায়, শারদীয় আকাশের নীলে। মানবমনের ভিতরে যে অসুর বাস করে তার বিনাশ করার মাধ্যমেই মহাশক্তির জয়। জ্ঞান, বিদ্যা, মানসিক ঐশ্বর্য, বল ও বৈরাগ্যের মাধ্যমেই অসুর বিনাশ করে জগতের দুর্গতিনাশ করা সম্ভব। দুর্গোৎসব এই অসুর বিনাশের প্রতীক। বিভিন্ন পুরাণশাস্ত্রে দুর্গা দেবী মহামায়া, চ-ী, উমা, ভগবতী, পার্বতী প্রভৃতি নামে পূজিতা। তার মাতৃত্ববোধের পাশাপাশি সংহারী রূপের পূজারী সকলেই। তবে কেন ব্যক্তিজীবনে উপেক্ষিতা নারী? কেন আজও ঘরে বাইরে চলে নারী নির্যাতন, অত্যাচার ও অসামঞ্জস্যতা? কেন অসহায় শৃঙ্খলে আবদ্ধ নারীর মেধা, মনন, সৃষ্টিশীলতা ও স্বাধীনতা? কেন আজও প্রশ্নবিদ্ধ নারীর যোগ্যতা, দক্ষতা, ক্ষমতা ও উদ্যোগ? নারীত্বের এই অবমাননা কি মানবতাবোধের পরিপন্থী নয়?
আদ্যশক্তি দুর্গা প্রতিটি নারীর মধ্যেই অধিষ্টিতা। কর্পোরেট, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, সাংবাদিক থেকে শুরু করে বাড়ি বাড়ি রান্না করে অথবা ইট ভেঙে যে নারী সচল রাখে সংসার ও সমাজের চাকা, তিনি কেন পূজ্য নন? কেন প্রতিপদে সহ্য করতে হয় রক্তচক্ষুর শাসন? কেন নিরাপত্তাহীনতা নারীকে তাড়া করে ফেরে ঘরে, বাইরে, কর্মস্থলে? যে রাধে, সে চুলও বাঁধেÑ এই প্রবাদের গ-ি ছাড়িয়ে সর্বক্ষেত্রে পুরুষের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সমাজ উন্নয়নে লড়ছে নারী। চলুন, সকলেই যে-যার অবস্থান থেকে নিশ্চিত করি নারীর জন্য আবাস ও কর্মস্থল। অসুর নিধনে রণঙ্গিনী দুর্গাকে সমরে সাজাতে দেবতারা তার হাতে তুলে দিয়েছিলেন নিজেদের অস্ত্র।
চলুন, নারীর হাতেও তুলে দিই স্নেহ, মমতা, সহমর্মিতা, সত্যবাদিতা এবং নিজ শক্তিতে জ্বলে ওঠার অস্ত্র। চলুন, আদ্যাশক্তির মহিমায় উদ্ভাসিত হই সকলে।
ইয়া দেবী সর্বভূতেষু বুদ্ধি রূপেন সংস্থিতা…
নমোস্তেসৈ নমোস্তেসৈ নমোস্তেসৈ নমো নমো…