Skip to content

৮ই সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দ | রবিবার | ২৪শে ভাদ্র, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

দেশ সেরা পাঁচ জমিদার বাড়ি

বাংলাদেশের আনাচে কানাচে শত শত জমিদার বাড়ি রয়েছে। যেগুলো ইতিহাস ঐতিহ্য ও আভিজাত্যের সাক্ষী। নানান ধরনের পৌরাণিক ইতিহাসের জানা-অজানা অনেক তথ্য মিলে সেই সব জমিদার বাড়িগুলোতে জমিদারদের জীবনযাপন থেকে শুরু করে তাদের অনেক ধরনের তথ্যই এই জমিদারদের বাড়িগুলোয় পাওয়া যায় । ইতিহাসের টানে হলেও এই জমিদার বাড়িগুলো অবশ্যই ঘুরে দেখুন।

শশী লজ
শশী লজ ময়মনসিংহ জেলা সদরে অবস্থিত একটি রাজবাড়ি। ঊনবিংশ শতকে মুক্তাগাছার জমিদার মহারাজ সূর্যকান্ত আচার্য চৌধুরী দৃষ্টিনন্দন প্রাসাদ নির্মাণ করেন। মহারাজ সূর্যকান্ত তার দত্তক ছেলে শশীকান্ত আচার্য চৌধুরীর নামানুসারে প্রাসাদটির নামকরণ করেন শশী লজ। স্থানীয়ভাবে ময়মনসিংহ রাজবাড়ি নামেও পরিচিত। ১৮৯৭ সালের ভূমিকম্পে ভবনটি ক্ষতিগ্রস্ত হলে শশীকান্ত আচার্য চৌধুরী পুনরায় নির্মাণ করেন। ৯ একর জায়গা ওপর নির্মিত শশী লজ ভবনের প্রধান ফটকে ১৬ টি গম্বুজ রয়েছে।
শশী লজের মূল ভবনের সামনে একটি চমৎকার বাগান রয়েছে। বাগানের মাঝখানে শ্বেতপাথরের ফোয়ারার সাথে গ্রিক দেবী ভেনাসের এক মর্মর মূর্তি স্থান পেয়েছে। ১৮ টি বিশাল কক্ষের মূল ভবনের পেছনে আছে দোতলা স্নানঘর, পুকুর ও মার্বেল পাথরে নির্মিত ঘাট। ১৯৫২ সালে শশী লজে মহিলা টিচার্স ট্রেনিং কলেজ প্রতিষ্ঠিত হলে বাড়িটির মূল ভবন অধ্যক্ষের কার্যালয় এবং দপ্তর হিসেবে করা হতো। ২০১৫ সালে ৪ এপ্রিল জাদুঘর স্থাপনের জন্য বাংলাদেশ সরকারের প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর শশী লজটি অধিগ্রহণ করে।
কিভাবে যাবেন
ঢাকা থেকে এনা, আলম এশিয়া, শামীম এন্টারপ্রাইজ, শৌখিন কিংবা নিরাপদ পরিবহনের বাসে করে ২৬০ টাকা ভাড়ায় ময়মনসিংহ যেতে পারবেন। ঢাকা থেকে ময়মনসিংহ যেতে আড়াই থেকে তিন ঘণ্টা সময় লাগে। মাসাকান্দা বাস স্ট্যান্ডে নেমে অটো অথবা রিকশায় চড়ে শশী লজ ঘুরে আসতে পারবেন। রিক্সা ভাড়া নেবে ৩০-৪০ টাকা।

তাজহাট জমিদার বাড়ি
তাজহাট জমিদার বাড়ি  দেখতে হলে রংপুর বিভাগীয় শহর থেকে প্রায় ৬ কিলোমিটার দূরে মাহিগঞ্জের তাজহাট গ্রামে যেতে হবে। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ ভাগে রত্ন ব্যবসায়ী মান্নালাল ব্যবসায়িক কারণে মাহিগঞ্জে এসে বসবাস এবং পরবর্তীতে তাজহাট জমিদারির প্রতিষ্ঠাতা করেন। জমিদার মান্নালাল মারা যাবার পর তাঁর দত্তক পুত্র গোপাল লাল রায় বাহাদুর জমিদারি পরিচালনা শুরু করেন। বিংশ শতাব্দীর শুরুতে প্রায় ২০০০ রাজমিস্ত্রির নিরলস পরিশ্রমে বর্তমান তাজহাট জমিদার বাড়ি পূর্ণতা লাভ করে। ১৯১৭ সালে সম্পূর্ণ হওয়া এই জমিদার বাড়িটি নির্মাণ করতে তৎকালীন সময়ে প্রায় দেড় কোটি টাকা খরচ হয়।
তাজহাট জমিদার বাড়ির চত্বরে রয়েছে গাছের সারি, বিশাল মাঠ এবং প্রাসাদের দুই পাশে আছে দুইটি পুকুর। আর আছে বিভিন্ন রকম ফুল ও মেহগনি, কামিনী, আম এবং কাঁঠাল বাগান। জমিদার বাড়িটি দেখতে ঢাকার আহসান মঞ্জিলের মতো। লাল ইট, শ্বেত ও চুনা পাথর দ্বারা নির্মিত চারতলা বিশিষ্ট তাজহাট জমিদার বাড়ির তৃতীয় ও চতুর্থ তলায় জমিদার গোপালের ব্যবহৃত বিভিন্ন জিনিস রাখা আছে। এছাড়া রয়েছে থাকার কক্ষ, গোসলখানা ও অতিথিদের জন্য কক্ষ। প্রায় ২১০ ফুট প্রস্থের প্রাচীন মুঘল স্থাপত্যের অনুকরণে নির্মিত তাজহাট জমিদার বাড়িতে ইতালীয় মার্বেল পাথরে তৈরী ৩১ টি সিঁড়ি আছে। রাজবাড়ীর পেছনদিকে রয়েছে গুপ্ত সিঁড়ি পথ, যা বর্তমানে বন্ধ রয়েছে।
১৯৯৫ সালে বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ তাজহাট জমিদার বাড়িকে সংরক্ষিত স্থাপনা হিসেবে নথিভুক্ত করে এবং ২০০৫ সালে রংপুর জাদুঘরকে তাজহাট জমিদার বাড়ির দ্বিতীয় তলায় স্থানান্তরিত করে। জাদুঘরের প্রদর্শনী কক্ষে দশম ও একাদশ শতাব্দীর বেশকিছু টেরাকোটা শিল্পকর্ম স্থান পেয়েছে। এছাড়াও জাদুঘরে সংরক্ষিত রয়েছে মুঘল সম্রাট আওরাঙ্গজেবের সময়ের কুরআন, মহাভারত ও রামায়ণসহ বেশকিছু আরবি এবং সংস্কৃত ভাষায় লেখা প্রাচীন পাণ্ডুলিপি। কাল পাথরের বিষ্ণুর প্রতিকৃতি ছাড়াও জাদুঘরে প্রায় ৩০০ টি মূল্যবান নিদর্শন রয়েছে।

কিভাবে যাবেন
রাজধানী ঢাকার কল্যাণপুর, গাবতলী ও মহাখালী বাস টার্মিনাল হতে নিয়মিত ভাবে বিভিন্ন পরিবহণের বাস রংপুরের উদ্দেশ্যে যাত্রা করে। এসব বাসে চড়ে রংপুর যেতে জনপ্রতি ৬০০ থেকে ১০০০ টাকা ভাড়া লাগে। রংপুর বাসষ্ট্যান্ড থেকে রিকশাযোগে তাজহাট জমিদার বাড়ি যেতে মাত্র ২০ টাকা ভাড়া লাগে। তবে ঢাকা থেকে কুড়িগ্রামগামী বাসে চড়লে সরাসরি তাজহাট জমিদার বাড়ির সামনে নামা যায়।

উত্তরা গণভবন
নাটোরের বিখ্যাত দিঘাপতিয়া রাজবাড়ি বর্তমানে উত্তরা গণভবন নামে পরিচিত। নাটোরের রানী ভবানী তার নায়েব দয়ারাম রায়কে দিঘাপতিয়া পরগনা উপহার দেন। পরবর্তীতে নায়েব সেখানে কয়েকটি প্রাসাদ গড়ে তোলেন। প্রায় ৪৩ একর আয়তনের লেক ও প্রাচীর বেষ্টিত রাজবাড়িটিতে মোট ১২ টি ভবন রয়েছে। উত্তরা গণভবনের পিরামিড আকৃতির চারতলা প্রবেশদ্বারের চূড়ায় বিখ্যাত কোক অ্যান্ড টেলভি কোম্পানির তৈরি একটি ঘণ্টা ঘড়ি স্থাপন করা হয়েছে। আর মূল প্রাসাদ ভবনে প্রবেশ করলে রাজার সিংহাসন, আক্রমণ ঠেকানোর বর্ম এবং তলোয়ার দেখতে পাওয়া যায়। রাজ প্রাসাদের প্রাঙ্গণে ইতালি থেকে সংগৃহীত ভাস্কর্যে সুসজ্জিত বাগান রয়েছে। মনোমুগ্ধকর এই বাগানে স্থান পেয়েছে হাপরমালি, নীলমণিলতা, রাজ-অশোক, পারিজাত, কপূর, সৌরভী, হৈমন্তী, যষ্টিমধু, বনপুলক, পেয়ালি, সেঁউতি, তারাঝরা, সাইকাস, মাধবী ইত্যাদি বিভিন্ন প্রজাতির গাছ। এছাড়া আছে রাজা প্রসন্ননাথের অবক্ষমূর্তি, জমিদার দয়ারামের ভাস্কর্য, চারটি কামান, কুমার ভবন, তহশিল অফিস ও অতিথিশালা।
নাটোর জেলা শহর থেকে মাত্র ৩ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত উত্তরা গণভবনটি বর্তমানে উত্তরবঙ্গে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর স্থানীয় কার্যালয় এবং বাসভবন হিসাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। তাই উত্তরা গণভবন পরিদর্শন করতে জেলা প্রশাসনের অনুমতি নিতে হয়।
কিভাবে যাবেন
ঢাকা থেকে সড়ক ও রেলপথে নাটোর যাওয়া যায়। নাটোর বাস স্টপ কিংবা রেলস্টেশন থেকে সিএনজি চালিত অটোরিকশায় উত্তরা গণভবন যেতে মাত্র ১৫ মিনিট সময় লাগে। অথবা নাটোরের যে কোন জায়গা থেকেই উত্তরা গণভবনে যাওয়ার পর্যাপ্ত রিক্সা বা অটোরিক্সা পাবেন। নাটোরের মাদ্রাসা মোড় থেকে উত্তরা গণভবন যেতে ৩০ টাকা রিকশা ভাড়া লাগে।

মহেরা জমিদার বাড়ি
মহেড়া জমিদার বাড়ির  মত সুন্দর এবং যত্নে সংরক্ষিত জমিদার বাড়ি বাংলাদেশে খুঁজে পাওয়া কঠিন। টাঙ্গাইল সদর থেকে প্রায় ১৮ কিলোমিটার দূরে আট একর জায়গা জুড়ে মহেড়া জমিদার বাড়ি বিস্তৃত। মহেড়া জমিদার বাড়ি প্রাচীন সভ্যতা ও ঐতিহ্যের অমূল্য নিদর্শন স্বরূপ মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। জমিদার বাড়ির সাথেই ছোট পার্ক, চিড়িয়াখানা, পিকনিক স্পট ও বোট রাইডের ব্যবস্থা রয়েছে। রাজধানী ঢাকার বেশ কাছে হওয়ায় সকালে রওনা দিলে এক দিনেই জমিদার বাড়ি থেকে ঘুরে আসা যায়।
এই জমিদার বাড়ির প্রবেশ পথেই রয়েছে বিশাল দুইটি সুরম্য গেট। বিশাল তিনটি প্রধান ভবনের সাথে নায়েব সাহেবের ঘর, কাছারি ঘর, গোমস্তাদের ঘর, দীঘি ও আরো তিনটি লজ রয়েছে। প্রবেশ পথের আগেই বিশাখা সাগর নামে একটি দীঘি আছে। মূল ভবনে পিছনের দিকে পাসরা পুকুর ও রানী পুকুর নামে আরো দুইটি পুকুর রয়েছে।

কীভাবে যাবেন
ঢাকার মহাখালী বাস টার্মিনাল থেকে বিনিময়, ঝটিকা, ধলেশ্বরী ইত্যাদি বাস টাঙ্গাইলের উদ্দেশ্যে যাত্রা করে। এই সমস্ত বাস ভাড়া লাগে ১২০ থেকে ১৬০ টাকা। পছন্দমত কোন বাসে চড়ে নাটিয়াপাড়া বাস ষ্ট্যান্ডে আসতে হবে। নাটিয়াপাড়ায় বাস থেকে নেমে সিএনজি, রিকশা বা বেবী টেক্সী যোগে মহেরাপাড়া পুলিশ প্রশিক্ষন কেন্দ্রে আসতে হবে। মহেরা জমিদার বাড়িটিই বর্তমানে পুলিশ প্রশিক্ষণ কেন্দ্র হিসাবে ব্যবহৃত হচ্ছে।

বালিয়াটি জমিদার বাড়ি
বালিয়াটি জমিদার বাড়ি দেখতে হলে আপনাকে যেতে হবে মানিকগঞ্জ জেলা থেকে প্রায় ৮ কিলোমিটার দূরে সাটুরিয়া উপজেলার বালিয়াটি গ্রামে। সাতটি ঐতিহ্যবাহী স্থাপনা নিয়ে বালিয়াটি জমিদার বাড়ি গৌরবের সাক্ষী হয়ে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে। দৃষ্টিনন্দন এই জমিদার বাড়ির বিভিন্ন ভবন একেক জন উত্তরাধিকারীদের মাধ্যমে পৃথক পৃথক সময়ে নির্মিত হয়েছে। বালিয়াটি জমিদার বাড়িটি বর্তমানে বাংলাদেশ প্রত্নতাত্ত্বিক বিভাগের মাধ্যমে সংরক্ষণ ও পরিচালনা করা হচ্ছে। আর জমিদার বাড়ির কেন্দ্রীয় ব্লকে রংমহল খ্যাত ভবনে যাদুঘর গড়ে তোলা হয়েছে। বালিয়াটি প্যালেস নামেও পরিচিত এই জমিদার বাড়ি।
ঊনবিংশ শতকে নির্মিত ঐতিহ্যবাহী প্রাসাদের চত্বরটি প্রায় ১৬ হাজার ৫৫৪ বর্গমিটার এলাকা জুড়ে অবস্থিত। জমিদার বাড়ির প্রবেশ ফটকের দুই পাশে স্থাপিত রয়েছে দুটি সিংহের মূর্তি। সমস্ত জমিদার চত্বর উঁচু প্রাচীর দিয়ে ঘেরা এবং জমিদার বাড়ির মূল ফটক দিয়ে প্রবেশ করলেই সুপ্রশস্ত সবুজের ঢাকা আঙ্গিনা চোখে পড়ে। আঙ্গিনায় গড়ে তোলা হয়েছে সুন্দর ফুলের বাগান। আঙ্গিনার পরেই পাশাপাশি চারটি বহুতল ভবন রয়েছে। এই ভবনগুলোর পেছনেই আছে চারটি পুকুর ও জমিদার অন্দরমহল। প্রাসাদের কক্ষ সংখ্যা ২০০ টি এবং প্রতিটি কক্ষেই সুনিপুণ কারুকাজ লক্ষ্য করা যায়। চুন-সুরকি, লোহার পাত আর কাদামাটিতে নির্মিত ভবনগুলোর প্রতিটি দেয়াল প্রায় ২০ ইঞ্চি পুরু। অনন্য নির্মাণ কৌশল আর কারুকার্য পূর্ণ বালিয়াটি জমিদার বাড়ী তৎকালীন জমিদারদের অভিজাত্যকেই ফুটিয়ে তোলে।

কিভাবে যাবেন
ঢাকার গাবতলী বাস টার্মিনাল থেকে আরিচা বা মানিকগঞ্জগামী যে সব বাস সাটুরিয়া হয়ে যায় সেইসব বাসে করে যেতে পারবেন। ভালো হয় গাবতলী থেকে সাটুরিয়া গামী এস বি লিংক পরিবহণে গেলে। সাটুরিয়া পার হয়ে সাটুরিয়ার জিরো পয়েন্টে নেমে যেতে হবে। বাসের সুপারভাইজারকে বালিয়াটি জমিদার বাড়ির কথা বললেই নামিয়ে দিবে। ঢাকা থেকে বাসে সাটুরিয়া জিরো পয়েন্ট যেতে সাধারণত ২ ঘন্টার চেয়ে একটু বেশি সময় লাগে। তবে জ্যামের কথা মাথায় রেখেই আপনাকে রওনা দিতে হবে। জিরো পয়েন্ট সেখানে থেকে জমিদার বাড়ির দূরত্ব ১ কিলোমিটার। ইজিবাইক বা সিএনজি দিয়ে ২০-৩০ টাকা ভাড়া দিয়েই যেতে পারবেন বালিয়াটি প্যালেসে। এছাড়া সাটুরিয়া বাস স্ট্যান্ডে নেমেও সিএনজি/ইজিবাইক দিয়ে যেতে পারবেন ৫০-৬০ টাকা ভাড়ায়।

ডাউনলোড করুন অনন্যা অ্যাপ