ধর্ষকের সঙ্গে বিয়ে: ধর্ষণেরই টিকিট দেওয়ার সমান
আমাদের সমাজে ধর্ষণের শিকার নারীরা অস্পৃশ্য, তা আর নতুন করে বলার কিছু নেই! তবে নারীর প্রতি নিষ্ঠুর আচরণের সীমা পুরুষতান্ত্রিক সমাজ যে পার করেছে, সেটাও আর বলার অপেক্ষা রাখে না। প্রতিনিয়তই যেন নারী ভোগ্যপণ্য হিসেবে বিকোচ্ছে এ সমাজে।
নারীর নিজস্ব কোনো মূল্য নেই। মান-মর্যাদা নেই। নারীকে এ সমাজ পারলে জীবন্ত কবর দেওয়ার পর যদি আরও কোনোভাবে শাস্তি বা শোষণ করা যায়, ঠিক সেটাও করতে প্রস্তুত। যেই নারীরা বংশবৃদ্ধি থেকে শুরু করে সমাজকে মায়া-মমতার বন্ধনে আজও দাঁড় করিয়ে রেখেছে এ সমাজ, সেই নারীকেই অবজ্ঞা- অবহেলা করে চলেছে।
নারীকে অবহেলা-অপমান-অসম্মানের চূড়ান্ত রূপ প্রকাশ পেয়েছে ধর্ষকের সঙ্গেই নারীকে বিয়ে দিয়ে। নারীর মর্যদা কতটা ক্ষীণ হলে আমাদের আধুনিক সমাজ ব্যবস্থায়ও এরকম সিদ্ধান্ত গৃহীত হতে পারে!
গণমাধ্যমে প্রকাশিত ঘটনাটি এ পর্যায়ে তুলে ধরা বাঞ্ছনীয়। লালমনিরহাটে ধর্ষণের মামলার আসামি রকিব উজ্জামানের সঙ্গে ভিকটিমের বিবাহ পড়ানোর নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। সোমবার (২০ নভেম্বর) এ বিষয়ে এক আবেদনের শুনানি করে প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগের একটি বেঞ্চ এ আদেশ দেন। এ মামলার পরবর্তী তারিখ ৪ ডিসেম্বর নির্ধারণ করা হয়েছে।
লালমনিরহাটের জেল সুপারকে আদেশের কপি হাতে পাওয়ার ১৫ দিনের মধ্যে তাদের বিবাহ দেওয়ার নির্দেশ বাস্তবায়ন করতে বলা হয়েছে। গতবছর ভিকটিমের বাবা শাহাবুদ্দিন সাবু মেয়েকে অপহরণের অভিযোগে অপহরণ ও নারী নির্যাতনে প্রধান আসামি রকিব উজ্জামানের রকিব বিরুদ্ধে মামলা করেন।
২০২২ সালে ৮ এপ্রিল মামলাটি দায়ের করা হয়। ভিকটিমকে উদ্ধার করা হয় ৯ এপ্রিল। ইতোমধ্যে সে ২০ সপ্তাহের অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়ে। তখন মেয়ের বয়স ১৭ বছর বলে দাবি করেন পরিবার। অপহরণের পর তারা দুজনে একত্রে বসবাস করে। বিবাহবন্ধনেও আবদ্ধ হয়।
এমতাবস্থায় চলতি বছর আসামিকে জামিন দেন হাইকোর্ট। সেই জামিন আদেশের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ আবেদন করে। পরে জামিন স্থগিত করে চেম্বার আদালত এবং পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চে শুনানির জন্য পাঠানো হয়। এ সময়ের মধ্যে উভয় পক্ষ আপস-মীমাংসা করে বিবাহের শর্তে।
তবে বিয়ে সম্পন্ন হলেও মনে প্রশ্ন জাগে, অপরাধের কি আদৌও কোনো শাস্তি দেওয়া হলো? নারী কি তার প্রাপ্যটুকু পেলো? এ প্রসঙ্গে আমাদের সমাজের অধিকাংশের মত হয়তো বিয়ের দিকে ঝুঁকতেই পারে। তাদের ধারণা এবং বিশ্বাস থেকেই তারা উপনীত হবেন যে, এই নারীর আর কোথাওই ভালো বিয়ে হতো না। ফলে ধর্ষকের সঙ্গে বিয়ে দেওয়াটাও ধর্ষকের জন্য একটা শাস্তি। কিন্তু ভেবে দেখুন তো, যে নারী ধর্ষণের শিকার হয়ে সমাজের দায়ে এই পুরুষকে বিয়ে করছেন তার মনের অবস্থা। তিনি কি সত্যিই কখনো মন থেকে ক্ষমা করতে পারবেন? এই পুরুষটিও নারীকে তার যোগ্য মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করবেন? এই প্রশ্নগুলোর সত্যিকার অর্থে কোন সদুত্তর নেই। তবে পরিবার-পরিজনের প্রথমত এবং শেষতক মত এটাই যে, ‘বাঁচা গেলো’ বা আপদ ‘বিদায় হলো’! কিন্তু এই ভুক্তভোগী নারীর ভবিষ্যৎ কী? যারা বিচারকার্য পরিচালনা করলেন তারাও কিন্তু তাদের কাজটির নিষ্পত্তি ঘটালেন এভাবে! কিন্তু নারীটির ভবিষ্যৎ কী? খুন, গুম, যৌতুকের চাপ, শারীরিক-মানসিক নির্যাতন নয় কী? তবে কেন নারীর সঙ্গে আজও এ সমাজ প্রহসনে ব্যস্ত। কোনো রকম বুঝিয়ে-সুঝিয়ে তাকে পাত্রস্থ করে দিতে পারলেই সাত খুন মাপ হয়ে যায়।
এই ঘটনায় কিছু প্রশ্ন স্বাভাবিকভাবেই এসে যায়:
প্রথমত, আমাদের সমাজ কি আর কখনওই নারীকে প্রকৃত সম্মান দিতে অভ্যস্ত হয়ে উঠবে না?
দ্বিতীয়ত, পরিবার-পরিজনের কাছে নারী তথা মেয়ের সম্মানের চেয়ে বিয়েটা কিভাবে বড় হলো?
তৃতীয়ত, একজন অপরাধীকে শাস্তি না দিয়ে বিয়ে দিয়ে পুরস্কৃত করায় অপরাধী কি আদৌ তার ভুল শুধরে নেবে বা এই ঘটনা থেকে অন্য পুরুষও কি অনুপ্রাণিত হবে না!
চতুর্থত, আর কবে নারী যোগ্য মর্যাদায় অধিষ্ঠিত হবে? পরবর্তীকালে নারীটির ওপর শারীরিক-মানসিক নির্যাতন হলে সে দায় কে নেবে?
আমাদের সমাজে নারীরা আজও কোনোভাবেই যেন সম্মানীয় হয়ে ওঠার দোরগোড়ায় পৌঁছাতে পারছেন না। পরিবেশ-পরিস্থিতির চাপে কিঞ্চিৎ মানুষ ওপর- ওপর ভালো আচরণে অভ্যস্ত হলেও মন থেকে আজও নারীকে ঠিক কলুরবলদই ভেবে চলেছে। নারী তাদের সম্পদ-সম্পত্তি। ইচ্ছে করলেই তাকে নিজেদের খেয়াল- খুশিমতো ভোগদখল করা যায়। ফলে বিচারকার্য থেকে শুরু করে সবজায়গায়ই নরীর সঙ্গে প্রহসন।
নারীকেই মানিয়ে নিতে হয় এ সমাজে। কারণ এ সমাজের চোখে কালোকাপড় বাঁধা। ফলে নারীর হৃদয়ের হাহাকার তার কর্ণ বিদারিত করে না। এ সমাজ বিশ্বাস করে, নারীর ভালোভাবে বাঁচার কিছু নেই। পচা, উচ্ছিষ্ট, বাসি খাবার যেমন অনাদরে-অবহেলায় ছুড়ে ফেলা হয় নারীরও তেমনই । কারও ইচ্ছে হলে সে নিজের মর্জি মতো উপভোগ করে ছুড়ে ফেলে ডাস্টবিনে! মানসিক ভারসম্যহীন নারী হয় অন্তঃসত্ত্বা, ছোট্ট কোলের কন্যা শিশুটি রাস্তায় গড়াগড়ি খায় শুধু মেয়ে বলে, পণ্য ভেবে নারীকে নেওয়া হয় পতিতালয়ে, আবার কাউকে বা ভোগ্যপণ্য করে রঙচঙ দিয়ে বাজারজাত করে এ সমাজ! কোথায় আছি আমরা! আর কোনদিকে এগুচ্ছি দিন দিন!
আজও এ সমাজ সেই কলিযুগের ছায়ায় আবিষ্ট। কে মুক্ত করবে এ সমাজের অন্ধকার থেকে? মানসিকভাবে দৈন্য-হীনণ্মন্যতা ঘুচাতে না পারলে নারীমুক্তি কল্পনাতীত। যতই যুগে যুগে রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন আসুক না কেন সমাজ থেকে যাবো সেই তিমিরতার গহীন শিকারে। নারীর প্রকৃত সম্মান দিতে হলে মনের কলুষতা দূর করতে হবে। নারী নয় বরং মানুষ রূপে নারীর সম্মান বৃদ্ধি করতে হবে। যেদিন মানুষ হয়ে সবাই একছায়াতলে এসে দাঁড়াবে হয়তো সেদিন ঘুচে যাবে অন্যায়- অবিচারের মানসিকতা।
ভুক্তভোগী নারীর সম্মানের কথা, তাকে ভালোমতো আত্মসম্মান নিয়ে বাঁচার তাগিদ পরিবার-পরিজন আমাদের সমাজের হর্তাকর্তাদের নেই। ফলে নারীকে ধর্ষকের কাছেই গছিয়ে দেওয়া হলো। যাতে নারী ন্যায় পায়! কি আশ্চর্য ন্যায় নির্ধারণী শক্তি আমাদের! শেয়ালের কাছেই মুরগি পাহারা দেওয়াতে প্রস্তুত আমরা। নারীর সঙ্গে এই প্রহসন এ সমাজের। অতি আদরের সন্তান হয়ে যাদের কোলে জন্ম সেই অভিভাবকদ্বয়ের। যারা সমাজ-সংসারের উর্ধ্বে উঠে নিজ সন্তানের মঙ্গল দেখতে সংকোচবোধ করেন!
ধর্ষণের ঘটানা কখনোই বিয়ের মাধ্যমে সুরাহা করা যায় না। সময় এসেছে এমন বর্বরোচিত নিয়মের পরিবর্তন আনার। শস্যের মধ্যেই যেন ভূতের জন্ম না হয়। এই বিয়ে এটাই প্রমাণ করে যে, ধর্ষণ করার পর তাকে বিয়ে করলেই সাত খুন মাফ। অর্থাৎ কোন পুরুষের যদি একটি নারীকে ভালো লাগে তবে সে তাকে যেভাবেই হোক ধর্ষণ করবে। তারপর বিয়ে করে নিয়ে সুখে সংসার পাতবে। এর মধ্যে দিয়ে কতোবড় অন্যায়কে প্রশ্রয় দিচ্ছে এ সমাজ। টনক কি নড়ছে না সুশীল সমাজের? আর এই বিচারকার্যের ফলে আরও পুরুষ মনে শক্তি জোগাতেই পারে তারও এভাবেই অধিগ্রহণ করবে কোন নারীকে। যে নারী স্বাভাবিক অবস্থায় বিয়ে বা প্রেমে রাজি নয় সেও! তাই অন্যায়ের শাস্তি হোক। তাকে প্রশ্রয় না দেওয়া হোক।
আমাদের মানসিক দীনতা মূর্খতার বলে নারীদের সর্বনাশ আর কত! কবে আসবে সুদিন? যেদিন নারী সত্যিকার অর্থে মানুষ রূপে গণ্য হবে এ সমাজে। তবু দিন গুনি সেদিনের অপেক্ষায়। ঘুচে যাক মিথ্যা দম্ভ। নারী পাক আপন অস্তিত্বের সন্ধান। মুক্তির স্বাদে জেগে উঠুক নব প্রাণের আলোড়ন। হার মানা হার গলে পরুক প্রতিটি নারী প্রাণ।