Skip to content

২২শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দ | শুক্রবার | ৭ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

জীবনানন্দের কবিতায় নারী

বাংলা সাহিত্যের পঞ্চপাণ্ডবের এক পাণ্ডব কবি জীবনানন্দ দাশ (১৭ ফেব্রুয়ারি ১৮৯৯- ২২ অক্টোবর ১৯৫৪)। রবীন্দ্রবলয়ের বাইরে এসে সৃষ্টি করেন আপন জগৎ। যার কবিতায় মেলে আধুনিকতার ছোঁয়া। নতুন বিন্যাস ও নবরূপে প্রকৃতি, নারী, প্রেম, মানুষের হতাশা, বিচ্ছেদ, বিচ্ছিন্নতা, বেদনা, ক্লান্তি, পরাবাস্তবতা সবই স্থান পেয়েছে। জীবনের সমগ্ররূপ তিনি দেখিয়েছেন ভিন্ন ভিন্ন সাজে। জীবনানন্দ নামের ক্ষেত্রে জীবনের সঙ্গে আনন্দের যোগ থাকলেও বাস্তবজীবনে তিনি ছিলেন একজন অসুখী মানুষ। দাম্পত্য জীবনের সেই টানাপড়েন-অসুখও তাঁর কবিতায় উঠে এসেছে। কিন্তু কবিতাকে তা গ্রাস করেনি বরং করে তুলছে আরও সংবেদনশীল। হৃদয়গ্রাহী। জীবনানন্দের কবিতায় তাই নারীর রূপ যতটা মোহনীয়, ঠিক ততটাই কল্পনাবিলাসী অধরা কেউ। যাকে তিনি পেতে চেয়েছেন আপন করে কিন্তু সেই আপন জগতের মাঝে যোজন যোজন দূরত্ব।

জীবনানন্দের কবিতার নারী অনেক নামেই অভিহিত। কেউ বনলতা, কেউ সুরঞ্জনা, কেউ সুচেতনা, শ্যামলী আবার কেউবা আকাশলীনা নামেই সম্বোধন করেছেন। এই প্রেয়সীর মধ্যে কারও কাছে পেয়েছেন দুদণ্ড শান্তি আবার কাউকে কবি পরপুরুষের সান্নিধ্যে যেতে নিষেধ করেছেন। চেহারায় মাধুর্যতায় কখনো বিগলিত হয়েছেন আবার কখনো খুঁজতে চেয়েছেন নিজের মানসিক প্রাশান্তি। তাই কবির মনের প্রেম চেতনায় তার নারীকে বা প্রেয়সীকে নবরূপে সাজিয়েছে বারংবার। গড়ে তুলতে সহয়তা করেছে নারীর আপন মূর্তি।

জীবনানন্দ প্রেয়সীকে খুঁজে ফিরেছেন বাদলের গোধূলি আঁধারে, মালতী বনে, কদমের তলে, নিঝুম ঘাটে কিন্তু যাকে খুঁজে তিনি শরতের ভোর, হেমন্তের হিম পার করেছেন সেই প্রেয়সী পৃথিবীর সাঁজদীপে তার হাতে কোনদিন আলো জ্বালেনি। রাত্রির নির্জনতাকে সাক্ষী করে যার সঙ্গে চুপিসারে তার প্রেমের আলাপন চালিয়েছেন সেই প্রিয়া তাকে ভুলে গেছে। কবি যখন তাঁর প্রেমকে নিবেদনে ব্যস্ত তখন এই প্রেয়সীই তাকে ফাঁকি দিয়ে দূরে সরে গেছে। কবির হৃদয়াকুতি তাই ধ্বনি-প্রতিধ্বনি হয়ে তার কাছেই ফিরে আসছে। আর কবি গভীর বেদনায় মুষড়ে পড়ছেন প্রেয়সীর সন্ধানে!

কবি বলেন-
মর্মর কেঁদে ওঠে ঝরাপাতাভরা ভোররাতের পবন-
আধো আঁধারের দেশে
কার সুর!
কোন্ সুদূরের তরে হৃদয়ের প্রেতপুরে ডাকিনীর মতো।
মোর কেঁদে মরে মন!
(একদিন খুঁজেছিনু যারে)

জীবনানন্দের পাণ্ডুলিপি উদ্ধারকর্তা ডা. ভূমেন্দ্র গুহ কবি’র সাহিত্যিক নোট গবেষণা করে বলেছেন, সন্দেহ নেই যে কবি প্রেমে পড়েছিলেন। এবং সেখানে উল্লেখিত ‘ওয়াই’ মেয়েটির তার কাঙ্ক্ষিত নারী। তিনি গবেষণা করে দেখিয়েছেন, এই মেয়ের নাম শোভনা। কবির কাকা অতুলান্ত দাশের কন্যা। ১৯৩০ সালে লাবণ্যদাশের সঙ্গে পরিণয়ে আবদ্ধ হওয়ার আগেই তার প্রতি কবির গভীর অনুরাগ জন্মেছিল। তাঁর উপন্যাসেও এ নামটি ভিন্নভাবে এসেছে। লাবণ্য দাশের সঙ্গে বিয়ে এবং দাম্পত্য জীবনের অসুখই তাঁর প্রাক্তন অনুরাগকে জাগিয়ে তুলেছে বলে ধারণা করা হয়। এই বালিকার প্রতি অনুরাগ-ই কবির চেতনায় যেন বারবার হানা দিয়েছে।

প্রেয়সী, তার স্নিগ্ধ মুখ-ই তিনি মনে জাগ্রত রেখেছেন। সময়ের শতকের মৃত্যু হলেও তাই প্রেয়সীর মুখশ্রী ম্লান হয়নি। তার স্নিগ্ধ মালতী সৌরভেই তিনি হারিয়ে গেছেন। তাই বড় বড় নগরীর বুকভরা ব্যথাও তিনি ক্রমেই ভুলে গেছেন। কিন্তু শত সমুদ্রের ক্ষয়ে যাওয়া অন্ধকারেও কবি চেয়ে থাকেন প্রেয়সীর পানে।

তাঁর ‘ শ্যামলী ‘কবিতায় তিনি এই নারীর প্রতিই যেন নিবেদন করলেন ভালোবাসা। সেকালের শক্তির মতোই যার মুখ। যার মুখের দিকে তাকালে কবি পৃথিবীর সমুদ্রের নীল দেখতে পান। নক্ষত্র, রাত্রির জল যুবাদের ক্রন্দন অনুভব করতে পারেন। সেই শ্যামলী যে কবির চিরচেনা। তারপরও অনেক কাল কেটে গেছ, পার হতে পারেনি রক্তনদী। তাইতো কবির আক্ষেপ,

অনেক অপরিমেয় যুগ কেটে গেলো;
মানুষকে স্থির—স্থিরতর হতে দেবে না সময়;
সে কিছু চেয়েছে বলে এত রক্তনদী।
অন্ধকার প্রেরণার মতো মনে হয়
দূর সাগরের শব্দ—শতাব্দীর তীরে এসে ঝরে :
কাল কিছু হয়েছিল—হবে কি শাশ্বতকাল পরে।
(শ্যামলী)

এই শ্যামলী-ই আবার ঘুরেফিরে যেন সুরঞ্জনা, সবিতা। এই সুরঞ্জনাকে তিনি করে তুলেছেন সমস্ত যৌবনবতী নারীর প্রতীকরূপে। নারী তার প্রেমের স্রোতে চির যৌবনা। সেখানে নতুনরপে খুঁজে পায় নিজেকে। কবির সুরঞ্জনা আজো পৃথিবীর পরে আছে। কালো চোখ মেলে পৃথিবীর নীলিমাকে ছুঁতে পেরেছে। শুধু ছুঁতে পারেনি তার ভালোবাসাকে। যা চেয়েছে তা সে পায়নি। সব গিয়েছে হারিয়ে। তাই কবি আবারও প্রেয়সীর কাছে নিবেদন করেন—

তুমি সেই অপরূপ সিন্ধু রাত্রি মৃতদের রোল
দেহ দিয়ে ভালোবেসে, তবু আজ ভোরের কল্লোল।
(সুরঞ্জনা)

‘মিতভাষণ’ কবিতায় কবি নারীর সৌন্দর্যকে অতীতের সঙ্গে আবার মেলাতে বসেছেন। তার কল্পনার প্রেয়সী, তার স্নিগ্ধ মুখ-ই তিনি মনে জাগ্রত রেখেছেন। সময়ের শতকের মৃত্যু হলেও তাই প্রেয়সীর মুখশ্রী ম্লান হয়নি। তার স্নিগ্ধ মালতী সৌরভেই তিনি হারিয়ে গেছেন। তাই বড় বড় নগরীর বুকভরা ব্যথাও তিনি ক্রমেই ভুলে গেছেন। কিন্তু শত সমুদ্রের ক্ষয়ে যাওয়া অন্ধকারেও কবি চেয়ে থাকেন প্রেয়সীর পানে। কবি বলেন—

তবুও নদীর মানে স্নিগ্ধ শুশ্রূষার জল, সূর্য মানে আলো
এখনও নারী মানে তুমি, কত রাধিকা ফুরালো।
(মিতভাষণ)

তাঁর সবিতাকে তিনি সম্বোধন করে বলছেন মানুষজন্ম পেয়েছেন তারা। আর সেই পথে হেঁটেছেন শাশ্বত রাত্রি। স্মৃতিচারণে জাগ্রত করে তুলতে চান তার প্রেয়সীকে। এই স্মৃতির আগুনে তাঁর কল্পিত নারী হয়ে উঠেছে এক চিরন্তন নারী।

তোমার নিবিড় কালো চুলের ভিতরে
কবেকার সমুদ্রের নুন;
তোমার মুখের রেখা আজো
মৃত কত পৌত্তলিক খ্রিষ্টান সিন্ধুর
অন্ধকার থেকে এসে নব—সূর্যে জাগার মতোন
কত আছে—তবু কত দূর।
(সবিতা)

তাঁর শোভনা যেন কোন এক দূরতম দ্বীপ । যে একসময় কাছেই ছিল। আজ সে কতদূর। মনের মিলনে পেতে হলেও তাঁকে গভীর রজনীতে বিনিদ্র থাকতে হবে, পার করতে হবে হাজার বছরের পথ তবু সে আর অধরা ।

গিয়ে থেমেছে। যে নারী তার বহু কালের পরিচিত। বহুযুগ অতিক্রম করলেও যে কবির হৃদয়ে একই সত্তায় বিরাজমান। সুচেতনা, সুরঞ্জনা, সবিতা, শ্যামলী, সুদর্শনা, বনলতা যে নামেই অভিহিত হোক না কেন সমগ্র রূপে কবির একক নারী এরা। কবির মনোজগতের প্রেয়সী।

পৃথিবীর মানুষের গভীরতর অসুখ যেন কবির হৃদয়ের অসুখের প্রতি ইঙ্গিত দেয়। তাই তার চোখে সবই ম্লান। সর্বত্রই মানুষের রূঢ় বেদনা তাকে দগ্ধ করে তোলে। প্রেয়সীর অধরা রূপ তাকে ক্ষত-বিক্ষত করে। কবি তাইতো এই প্রেয়সীকে বলেছেন,

সুচেতনা, তুমি এক দূরতম দ্বীপ
বিকেলের নক্ষত্রের কাছে;
সেইখানে দারুচিনি—বনানীর ফাঁকে
নির্জনতা আছে।
এই পৃথিবীর রণ রক্ত সফলতা
সত্য; তবু শেষ সত্য নয়।
(সুচেতনা)

কবির সব বেদনা, সব মলিনতার স্খলন হয়েছে বনলতা কবিতায়। হাজার বছর ধরে পথ হাঁটার পরই যেন তিনি সন্ধান পেলেন তাঁর প্রেয়সীকে। চারিদকে হাহাকার, বেদনার রূঢ়ধ্বনি থাকলেও যে তাকে দুদণ্ড শান্তি দিতে পেরেছিল। সেই বনলতাও কবির কল্পনার নারী বলেই ধরে নেওয়া হয়। তবে এই বনলতা সেনকে নিয়ে সাহিত্য পাঠকদের নানারকম মন্তব্য রয়েছে।

কেউ বলেন কবির উল্লিখিত নাটোরের ‘বনলতা সেন’ সে সময়ে নাটোরের এক পতিতা রমণী। ইতিহাসবেত্তা আকবর আলি খান এই বিষয়ে বিশদ আলোচনা করেছেন। তাঁর গ্রন্থে তিনি দেখিয়েছেন নাটোর ও তার আশেপাশে উত্তরাঞ্চালে এই স্থানটিতে জমিদারদের উপস্থিতি ছিল। ফলে এ স্থানটি কেন্দ্র করে অনেক বারবনিতা তাদের জীবকা নির্বাহ করতেন। অর্থাৎ কবির নাটোরের বনলতা সেন বলতে তাকে এই অঞ্চলের বলেই গণ্য করা হয়েছে।

তবে সব জল্পনা-কল্পনাকে রুখে দিয়ে সাধরণ্যে একধরনের স্বস্তির নিঃশ্বাস পড়ে। দুঃখের হাজার বছর পার করেও কবি দুদণ্ড হলেও শান্তি পেয়েছিলেন। সেই শান্তিই মানবমনে আজও স্থান করে আছে। যেন এ শান্তির বার্তা যতটা কবির নিজের তারচেয়ে বেশি তাকে শান্তিতে দেখা—স্বস্তিতে দেখার আকুল বাসনা পাঠকের। তাইতো বনলতা হয়ে উঠেছে কবির কল্পনাশ্রয়ী-ভাববিলাসী অন্যতম প্রেয়সী। যেই বনলতা আজও অমলিন।

জীবনানন্দের কবিতায় নারীর অনবদ্য রূপ প্রতিনিয়তই তাঁর সুরে প্রতিধ্বনিত হয়েছে। কিন্তু সব নারীর রূপই একসুরে গিয়ে থেমেছে। যে নারী তার বহু কালের পরিচিত। বহুযুগ অতিক্রম করলেও যে কবির হৃদয়ে একই সত্তায় বিরাজমান। সুচেতনা, সুরঞ্জনা, সবিতা, শ্যামলী, সুদর্শনা, বনলতা যে নামেই অভিহিত হোক না কেন সমগ্র রূপে কবির একক নারী এরা। কবির মনোজগতের প্রেয়সী।

ডাউনলোড করুন অনন্যা অ্যাপ