নারীনির্যাতনের সব কৌশল বন্ধ হোক
সম্প্রতি নারী নির্যাতনের কৌশলের শেষ নেই। ঘরে-বাইরে সব জায়গায়ই নারীরা নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। শুধু কৌশল পরিবর্তন হচ্ছে। ঘরে যখন স্ত্রীর ওপর নির্যাতন হচ্ছে তখন তা পারিবারিক নির্যাতনের চিত্র। এবং সেই নির্যাতনে অধিকাংশ সময়ই পরিবার-পরিজন, আত্মীয়-অনাত্মীয় সবই এই নির্যাতনকে ধর্তব্যে আনেন না। অধিকাংশেরই ধারণা সংসারে থাকতে হলে নারীকে অতোটুকু গঞ্জনা সইতে হয়। নাহলে তা পরিবার কিভাবে! ফলে নারীরাও মুখ বুজে সহ্য করেন। স্বামী যদি শারীরিক নির্যাতনও করেন তবু চুপ থাকেন কারণ স্বামী তো। তার তো বউয়ের ওপর অধিকার আছে শাসন করার।
এক্ষেত্রে আজও গ্রামাঞ্চলে একবাক্যে স্বীকার করা হয় এবং বিশ্বাস করা হয়, সংসারে যত সমস্যা গড়ে ওঠে সব নারীকে কেন্দ্র করে। নারী যদি ভালো হয় তবে সে সংসার সোনার মতো জ্বল জ্বল করে। আমাদের দেশে প্রবাদেই আছে, ‘সংসার সুখের হয় রমণীর গুণে’। বাকিঅংশে কী আছে তা কেউ কখনও দেখার চেষ্টা করেন না। এমনকি অধিকাংশ জানেনও না। পরবর্তী অংশ ‘গুণবান পতি যদি থাকে তার সনে’। তবে গুণবান পতি থাক বা না থাক সংসার সুখের করা লাগবেই। স্বামী যদি মদ-গাঁজা খেয়ে বউ পেটাতে অভ্যস্ত থাকেন তাও বউকে তথা নারীকেই কাঠগড়ায় তোলা হয়। কেনো স্বামীকে আঁচলে বাঁধতে পারলো না। নিশ্চয়ই নারীটির খামতি আছে। “নাহলে পুরুষ মানুষ কেনো সংসার-ধর্ম থুয়ে ওসব পথে পা বাড়াবে”। গ্রামের নিরানব্বই ভাগ মানুষ আজও এতেই বিশ্বাসী।
শ্বশুরালয়ে যাওয়ার পর নারী তাদের ঘরের সম্পত্তি। কখন খেতে হবে, ঘুমাতে হবে, কোথাশ যেতে হবে তা পরিবারের সদস্যরা নির্ধারণ করেন। পরিবারের সবচেয়ে শ্রদ্ধেয় ও বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তি থেকে সবচেয়ে ছোটটিও এতে সামিল থাকে। অর্থাৎ শ্বশুরঘরে নারী সম্পূর্ণ পরাধীন। নিজের জীবনের সব সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য, আহ্লাদ বিসর্জন তাকে আজও দিতে হয়। বাবার ঘরে যদি মেয়েরা সকাল ৭ টা পর্যন্ত ঘুমায় তবে বিয়ের জল গায়ে লাগার সঙ্গে সঙ্গে তাকে ৬ টায় ওঠার অভ্যেস পরিবর্তন করতে হয়। এক্ষেত্রে তাকে বাড়তি সময়ও কেউ দেয় না। অর্থাৎ একটা ভিন্ন পরিবেশ থেকে এসে মানিয়ে নেওয়ার বিষয়ে কেউই সাহায্য-সহযোগিতা করেন না। এই বিষয়কে হয়তো অধিকাংশই নির্যাতনের কাতারে ফেলবেন না। কারণ পরিবর্তনশীলতাই জীবন। তবু পরিবর্তন আনতে হয় ধীরে ধীরে। তবে তা স্থায়ী হতে পারে অনেকটা। কিন্তু হুট করে জীবনের রদ বদল ঘটানো কষ্টদায়ক। কিন্তু নারীকে তা ভোগ করতে হয়।
বিয়ের পর স্বামীর ঘরে নারী হয়ে পড়ে দাসী। আজও ঘরে ঘরে এমন চিত্র অহরহ। গ্লাসে জল ঢেলে খাওয়ার সামর্থ্যও পুরুষের থাকে না। সে ব্যাপারে নারীর সাহায্য চায়। কর্মব্যস্ত সময় পার করে পুরুষের একটু বিশ্রামের প্রয়োজন পড়লেও নারীর জন্য সে সুযেগ নেই। বাইরে যত কাজই তারা করুন না কেনো ঘরে ফিরে শ্বশুর-শাশুড়ি, আত্মীয়- প্রতিবেশীর সঙ্গে সদ্ভাবও বজায় রেখে চলতে হয়। সবার প্রতি সমান মনোযোগী হতে হয়। কিন্তু আশ্চর্যজনক হলেও সত্যি সব করতে গিয়ে নারীর নিজের জন্যই আর কোন সময় বরাদ্দ থাকে না।
ঘরের কথা তো আছেই এরপর কর্মস্থলে একজন পুরুষ সহকর্মীর কাছ থেকে নারীর যে ধরনের ব্যবহার পাওয়া উচিত তা তিনি পান না। বরং যত ধরনের নেতিবাচক ব্যবহার, মন্তব্য, উষ্ণতা সবই তাদের দিক থেকে আসতে থাকে। সব জায়গা- সব পরিবেশ এবং কর্মস্থল সমান এমন নয় তবে নারীদের কাজের ক্ষেত্রটা আজও অধিকাংশ সময় এমন। নারী সহকর্মীর চলাফেরা, প্রমোশন সবকিছু পুরুষ কলিগদের মধ্য ‘হট টপিক’। অর্থাৎ সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন হয়নি। এগুলোও নির্যাতন। তবে তার ধরণ আলাদা।
গণপরিবহনের কথা বললে সেখানে কোন ভালো দৃশ্য বা অভিজ্ঞতা বাংলাদেশের নারীদের জন্য রয়েছে এমনটা কল্পনাও করা যায় না। দেশের ৯৪ শতাংশ নারী গণপরিবহনে বিভিন্নভাবে হেনস্তার শিকার। চলতি পথে ইভটিজিং, বুলিং এর শিকার হওয়া নিত্য ঘটনা। এরপর যদি ঘরে ফিরি সেখানেও নারী অনিরাপদ। মোবাইলে নারীকে ব্লাকমেইলিং করা হচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বাজে বাজে মন্তব্যের শিকার হতে হচ্ছে। সামগ্রিক দেশের চিত্র যতোই ফলাও করে দেখানো হচ্ছে নারীরা এগোচ্ছে নিরাপত্তার দিক থেকে নারীরা ততটাই তটস্থ হচ্ছে। ভয়ে দিন গুজরান করছে। নারীদের জন্য নিরাপদ করে তোলা যায় ঘর- বাহির তবে এই নারীরা যে আরও কতদূর এগুতে পারে তা অকল্পনীয়। তবে হ্যাঁ, এই নারীরা সব বাধা ডিঙিয়ে সেটাও করে দেখাচ্ছেন৷
নারী নির্যাতন বন্ধ করতে হলে আগে মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি জরুরি। ঘরের বউমাটা মেয়ে নাহলেও মেয়ের মতো। অন্যের ঘরের আমানত যখন স্বামীর ঘরে যাচ্ছে তখন সেই ভালোবাসা-যত্নে রাখার দায় ওই পরিবারের। কষ্ট পেলেও কিন্তু তাদেরই ক্ষতি। এতে সংসারের মাঝে জটিলতা বাড়বে। ফলে আধুনিক চিন্তা -চেতনাকে সঙ্গী করে স্বাধীনতার স্বাদ নিতে দেওয়া প্রয়োজন। ঘরে নির্যাতন কমলে বাইরেরটাও কমবে। কারণ তাতে পারিবারিক বন্ধন এতটাই বৃদ্ধি পাবে যে, অন্য নারীর প্রতি খারাপ দৃষ্টিভঙ্গি কোনভাবেই আসবে না। নারী নির্যাতন এহেনও নানা কৌশলের বুকে পদাঘাত করতে হলে নারীকে মানসিকভাবে শক্তিশালী হতে হবে। ভালো-মন্দ বোঝার ক্ষমতা থাকতে হবে। তবেই জটিলতা কমবে।