মাতৃভাষার মর্যাদারক্ষায় নারীদের এগিয়ে আসতে হবে
১৯৫২ সালের ২১ শে ফেব্রুয়ারি (৮ ফাল্গুন ১৩৫৮) প্রাণের ভাষা বাংলাকে রক্ষায় তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে আপামর জনসাধারণ রাজপথে নামে। তাদের অপতিরোধ্য শক্তির কাছে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার শেষপর্যন্ত পরজয় স্বীকার করতে বাধ্য হয়। ১৯৫৪ সালের ৭ মে পাকিস্তান গণপরিষদে বাংলা অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে গৃহীত হয়। এছাড়া ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের প্রথম সংবিধান প্রণীত হলে ২১৪ নম্বর অনুচ্ছেদে বাংলা ও উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা মেনে নেওয়া হয়। এরপর ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হলে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলা প্রতিষ্ঠিত হয় এবং ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর ইউনেস্কো ২১ শে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষার স্বীকৃতি দেয়।
শত্রুর সঙ্গে পুনঃপুনঃ সংঘর্ষে জড়িয়ে জীবন বাজি রেখে বাংলার দামাল সন্তানেরা মুখের ভাষার স্বীকৃতি অর্জন করেছে। বুকের তাজা রক্তে রাজপথ রাঙিয়েছে তবু তাদের দুর্বার শক্তিকে জিইয়ে রেখে শেষপর্যন্ত মাতৃভাষার স্বীকৃতি আদায় করেছে বাঙালি জাতি। তবে দুভাগ্যজনক হলেও সত্যি যে, সম্প্রতি বাংলা ভাষার সঠিক চর্চা এবং শ্রদ্ধা অনেকটা কমে এসেছে। চাকরি, স্মার্টনেস বিবিধ বিষয়কে গুরুত্ব দিতে গিয়ে বাংলা ভাষার চর্চায় জাতি এখন উদাসীন। পোস্টার, ব্যানার, সেমিনার, সিম্পোজিয়াম, বিজ্ঞাপন এমনকি বহু স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের নোটিশ, শুধু তা-ই নয় সরকারি প্রজ্ঞাপন থেকে শুরু করে সরকারি বিভিন্ন অফিস- আদালতে বাংলা ভাষার শুদ্ধ ব্যবহার নেই! যে ভাষার জন্য আমাদের পূর্বজরা তাদের প্রাণ বিসর্জন দিয়েছে, জীবনের বিনিময়ে মাতৃভাষাকে ছিনিয়ে এনেছে বতর্মান জাতির কাছে বাংলার প্রতি সেই প্রগাঢ় মমত্ব শিথিল।
মাতৃভাষা শুধু মুখের ভাষা নয় বরং এটি মায়ের ভাষা অর্থাৎ সন্তান ভূমিষ্ট হওয়ার পর মায়ের কাছ থেকে প্রথম শোনা বুলি। পরবর্তীকালে যে বুলিতে সন্তান মনের ভাব আদান-প্রদান করে। তবে এই মায়ের ভাষা রক্ষার দায়িত্ব যে সবার সে কথা আমরা মনে রাখি না। বরং বহির্বিশ্বের সঙ্গে তাল মেলাতে গিয়ে ইংরেজি ভাষাকে খুব বেশি সাদরে গ্রহণ করার প্রবণতা পরিলক্ষিত হচ্ছে! মাতৃভাষা রক্ষার প্রধান দায়িত্ব মায়ের। কারণ মনে রাখতে হবে, মাতৃভাষার অপর নাম মায়ের ভাষা। ফলে দেশমাতৃকার ভালোবাসাকে পরিপূর্ণ করতে মায়েদের ভাষার প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে হবে। মা তথা নারী যদি মাতৃভাষার সঠিক চর্চা না করে তবে ভবিষ্যৎ প্রজন্মও মায়ের ভাষা চর্চায় অবহেলা করবে! আর মায়েরা যদি সন্তানকে শুদ্ধ মাতৃভাষার শিক্ষা দেন তবে ধীরে ধীরে দুর্বলতা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব।
ভাষা সর্বজনীন। আর তা যদি হয় রক্ত দিয়ে কেনা। তবে তার মমত্ববোধও গভীর-গহীনের। তবে আজকাল দেশে যে অরাজকতা বাসা বেঁধেছে তাতে ভয় পেতে হয় যে, যার জন্য আমাদের ভাইয়েরা তাদের বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিতেও পিছপা হয়নি সেই ভাষার কেনো এ হেন দশা! কেনো কারো ভেতরে সত্যিকার অর্থেই বাংলা ভাষার চর্চায় ভক্তি নেই! যতো ঘটা করে ইংরেজিকে আজকাল প্রধান্য দেওয়া হয় ঠিক তত ঘটা করে যদি মাতৃভাষার প্রতি মনোযোগ আকর্ষণ করা হয় তবে অবশ্যই ভাষার প্রকৃত মাধুর্য ছড়িয়ে পড়বে। শুদ্ধ চর্চায় বাংলা ভাষা সবার প্রাণকে আলোড়িত করবে সহজেই।
মনে রাখতে হবে, যে জাতি নিজের মাকে অপমান করে সে জাতির কাছ থেকে অন্যের মায়ের প্রতি ভালোবাসা আশা করা যায় না! অর্থাৎ যারা নিজ ভাষার প্রতি শ্রদ্ধাশীল নয় তারা অন্যের ভাষাকে কিভাবে শ্রদ্ধা করতে পারে! উল্লেখ্য যে, আজকাল তথ্য- প্রযুক্তি, বিজ্ঞানে সারা বিশ্বের মধ্যে শীর্ষ স্থান দখল করতে সক্ষম হয়েছে চীন/ চায়না। কিন্তু আশ্চর্যজনক হলেও সত্যি তাদের এই সাফল্যের পেছনের গল্প তাদের নিজেদের তৈরি। এমনকি বহির্বিশ্বের যেকোনো দেশের লোক তাদের দেশের বাইরে বা গণ্ডিতে তাদেরই ভাষা শিক্ষা গ্রহণ করতে বাধ্য। তারা নিজেদের ভাষার অমর্যাদা করে না। এর ফলস্বরূপ ক্রমগত উন্নতির চরম শিখরে তাদের অবস্থান।
তাই বাংলা ভাষার শুদ্ধ চর্চায় মনোনিবেশ করতে হবে। বাঙালি জাতির গর্বের ইতিহাস-ঐতিহ্য রক্ষায় ভাষার গুরুত্ব অপরিসীম। স্কুল – কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়, ব্যক্তিজীবনে শুদ্ধ বাংলা ভাষা চর্চাকে প্রাধান্য দিতে হবে। এ লক্ষে মায়েদের এগিয়ে আসতে হবে। সন্তানের ভাষা শিক্ষার প্রধান দায় মায়ের ওপর নির্ভরশীল। তাই মায়েরা তথা নারীরা যদি বাংলা ভাষার চর্চায় এগিয়ে আসেন তবে ধীরে ধীরে সব দুর্বলতা কাটিয়ে একদিন শহীদদের প্রকৃত মর্যাদা অধিষ্ঠিত করা হবে।