আধুনিক যুগে নারী নির্যাতনও হয় আধুনিক উপায়ে!
যুগ পাল্টেছে, সময় এগিয়েছে। নারীরাও যুগের সাথে তাল মিলিয়ে অনেকটা এগিয়েছে। তবে যুগ যুগ ধরে নারীদের উপর চলে আসা অত্যাচার- নির্যাতন কি কমেছে? অনেকেই উত্তর দিবেন, আজকাল সমাজ আধুনিক হয়েছে, নারীরা বহুদূর এগিয়েছে, নিজরে পায়ে দাঁড়িয়েছে তাই নির্যাতনও কমেছে। আদৌও কি তাই?
কাজি নজরুল ইসলামের ভাষায়, “বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর অর্ধেক তার করিয়াছে নারী অর্ধেক তার নর।” পুরো বিশ্ব নয় শুধু নিজের দেশের দিকেই তাকানো যাক। সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের যে অর্থনৈতিক উন্নয়ন বিশ্বকে বিস্মিত করেছে, সেখানেও নারীর অবদান চোখে পড়ার মতো। কিন্তু নারী যত সফলতাই এনে দাও না কেন পুরুষতান্ত্রিক সমাজে ‘নারী নির্যাতন’ এর মতো মারাত্মক ব্যাধি সহজে দূর হচ্ছে না। সমাজ ও সভ্যতা যত এগিয়ে যাচ্ছে, ততই যেন এ প্রবণতা বেড়ে চলেছে।
প্রতিদিন খবরের কাগজে চোখ রাখলেও দেখা যায় নির্যাতন, ধর্ষণ, অত্যাচারের খবর। সমাজের নানা ক্ষেত্রে নিপীড়িত ও অবহেলিত নারীরা। পরিবার ও কর্মক্ষেত্রে নারীর এগিয়ে যাওয়া, গতিশীলতা, অর্থনৈতিক সম্পৃক্ততা যেমন চোখে পড়ার মতো, নারী নির্যাতনও তেমনি চোখে পড়ার মতো। সমাজ অনেক এগিয়ে গেলেও নারী নির্যাতন কমছে না বরং নির্যাতনের ধরন বদলাচ্ছে।
প্রতিনিয়ত তৈরি হচ্ছে নতুন নতুন অপরাধ। নারীরা শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতিত হচ্ছে প্রতিনিয়ত। আগে নারীরা বিভিন্ন সামাজিক-প্রথা, কুসংস্কার, লোকলজ্জার ভয়ে ঘরের চারদেয়ালে বন্দি থাকতেন। বাইরের পৃথিবীতে পা বাড়ানোর সাহস দেখাতেন না। বর্তমান সময় নারীর সে ভয় ভেঙেছে। নারী আত্মনির্ভরশীল হয়েছে। তাই বলে কি নারীর চলার পথ মসৃণ হয়ে গিয়েছে?
এসময়ে এসেও পথেঘাটে, বাস-ট্রেনে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বা কর্মস্থলেও নারীরা ব্যাপকহারে নির্যাতিত হচ্ছে। ঘর থেকে শুরু করে কর্মস্থলে নারী বিভিন্ন ধরনের মৌখিক সহিংসতার শিকার হয়। শারীরিকভাবে না হলেও মানসিকভাবে নির্যাতন হচ্ছে বহু নারী। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আমাদের অবাধ বিচরণও নারী নির্যাতন কয়েকগুণ বাড়িয়েছে।
অনলাইনে নারীরা প্রতিনিয়ত এমন হয়রানির শিকার হচ্ছে। কেউ অচেনা কারো থেকে কেউ আবার পরিচিত কারো থেকে। বন্ধু বান্ধব, আত্মীয়স্বজন প্রায় সকলেই আছে এ তালিকায়। অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও সত্য বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নারীরা ভয়ে কিংবা অন্য কারণে এসব হয়রানির বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলতে পারেন না। আমাদের দেশের ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের হিসাব মতে, দেশের তিন-চতুর্থাংশ নারীই সাইবার বুলিংয়ের শিকার।
প্রাচীনকালে নারীকে শিক্ষার অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হতো, বর্তমানে নারী এ অধিকারটি আদায় করে নিতে সক্ষম হলেও তাকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পর্যন্ত পথ পারি দিতে শিকার হতে হয় বুলিংয়ের, লাঞ্ছিত হতে হয় শিক্ষক থেকে শুরু করে পুরুষ সহপাঠীদের কাছেও। আবার কর্মস্থলে প্রবেশ করতে তো একধরনের যুদ্ধই করতে হয় নারীদের। কখনও যুদ্ধ জয় করে প্রবেশ করতে পারলে সমাজ, পরিবার, আত্মীয়স্বজনদের কাছ থেকে শুনতে হয় কটু কথা আবার উচ্চ শিক্ষিত বসের বিশেষ নজরে পরলে তো কোনো কথাই নেই।
আজকাল যৌতুক না চেয়ে, কন্যার বাবার কাছে উপহার চান বরের বাবা। উপহার কোনোভাবে দিতে না পারলে বউকে সহ্য করতে হয় শারীরিক, মানসিক অত্যাচার। পরিসংখ্যানও বলছে সমাজে নারী নির্যাতন বিষয়টি এগোচ্ছে খারাপ ভাবে। প্রায় প্রতি বছরই নারী নির্যাতনের ঘটনা কয়েক শতাংশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। সরকারি পরিসংখ্যানে দেখা যায়, মহামারির মধ্যেও ২০২০-২০২১ অর্থবছরে ধর্ষণ ও নারী নির্যাতনের ঘটনা প্রায় ১৮ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ১০ মাসে মোট তিন হাজার ৬৭ জন নারী নির্যাতনের শিকার হয়েছে। শুধু অক্টোবর মাসেই কন্যাশিশুসহ ৩৭১ জন নারী নির্যাতনের শিকার হয়েছে। এর মধ্যে ধর্ষণের শিকার ৯১ জন, ধর্ষণের পর হত্যার শিকার হয়েছে দুজন। এ সময় নারী ও কন্যাশিশু পাচারের ঘটনা ঘটেছে ৬৩টি।
পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, ২০১৮ সাল থেকে পরবর্তী প্রতিবছরেই নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে মামলা বেড়েছে। এর মধ্যে ব্যাপক করোনা সংক্রমণের দুই বছর ২০২০ সালে সবচেয়ে বেশি ৩৯ শতাংশ এবং ২০২১ সালে ৩৬ শতাংশ বেশি মামলা হয়। ২০১৮ সালের তুলনায় ২০২২ সালে মামলা বেড়েছে ৫ শতাংশ।
যুগ আধুনিক হলেই, নারী সফলতার চূড়ায় আরোহণ করা শিখলেও পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ঠিকই আধুনিক উপায় বের করেছে নারীর পথ অবরুদ্ধ করার জন্য। যারা মনে করেন আধুনিক যুগে নারীদের জয়জয়কার চারদিকে ছড়িয়ে পরছে , নারীরা নিরাপদে সফলতার চূড়ায় আরোহণ করছেন , তারা বিভিন্ন সময়ে প্রকাশিত হওয়া সরকারি-বেসরকারি এসব পরিসংখ্যানে চোখ বুলিয়ে দেখবেন। যুগ পাল্টেছে তবে নির্যাতন কমেনি পাল্টেছে কেবল নির্যাতনের ধরণ।