এইচআইভি থেকে বাঁচতে নারী হোক সচেতন
এইচআইভি মরণব্যাধি নামেই পরিচিত। এটি এমন একটি ভাইরাস, যা শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ধ্বংস করে দেয়। জীবাণু সংক্রমণের বিরুদ্ধে মানবদেহকে প্রতিরোধহীন করে তোলে। বর্তমান সময়ে এই মরণব্যাধি রোগে আক্রান্তের সংখ্যা ক্রমাগত বাড়ছে। যার মধ্যে নারী এবং শিশুর সংখ্যা আশঙ্কাজনকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। গবেষণায় উঠে আসছে ভয়াবহ সব তথ্য। গর্ভবতী নারীর শরীরে এইচআইভি পজিটিভ হলে প্রসব কৃত সন্তানও এইচআইভি ভাইরাসে আক্রান্ত হচ্ছে। এবং অজ্ঞানতা, অশিক্ষার ফলে সমাজে অস্পৃশ্য হয়ে উঠছে এসব শিশুরা। এটাও দেখা গেছে যে, শিশুর জন্মদানের পর পরই মায়ের মৃত্যু ঘটছে এরফলে অবহেলা, অনাদরে শিশুরও মরণাপন্ন অবস্থা সৃষ্টি হচ্ছে। এ বিষয়ে সঠিক জ্ঞান না থাকার কারণে আত্মীয়-স্বজন, পাড়া প্রতিবেশী পরিবারটিকে এক ঘরে করছে। সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতেই এইচআইভি আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা দিনে দিনে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ থেকে পরিত্রাণ পেতে প্রয়োজন সচেতন দৃষ্টিভঙ্গি।
পরিসংখ্যান অনুযায়ী , সীমান্তবর্তী খুলনা অঞ্চলে এইডসের ভয়াবহতা দ্বিগুণ হারে বেড়েছে। ২০২১ সালে খুলনা অঞ্চলে ২৮ জন পজিটিভ শনাক্ত ছিল। ২০২২ সালে এসে পজিটিভ শনাক্ত হন ৬৫ জন। পজিটিভ হচ্ছে শিশুরাও। গত তিন বছরের তুলনায় এ বছর খুলনায় মৃত্যু ও শনাক্তের হার সবচেয়ে বেশি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সীমান্তবর্তী হওয়ার কারণে খুলনা অঞ্চলে এইডসের ঝুঁকি বেশি। কারণ পার্শ্ববর্তী দেশে এ রোগীর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। সীমান্তে অবাধ যাতায়াতের কারণে ঝুঁকিও বেশি।
তবে বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে রক্ষণশীল সমাজে মেয়েরা সাধারণত এইচআইভি সংক্রমিত হন তাদের স্বামীর কাছ থেকে। আর মায়ের কাছ থেকে শিশুরা সাধারণত তিনটি উপায়ে এইচআইভি জীবাণুতে আক্রান্ত হয়। গর্ভাবস্থায়, প্রসবকালে এবং বুকের দুধের মাধ্যমে। তবে ৯৯ শতাংশ ক্ষেত্রেই শিশুরা তাদের মায়েদের কাছ থেকে এইচআইভি আক্রান্ত হয়। তাই সন্তান নেওয়ার আগে মায়েদের এ ব্যাপারে সবচেয়ে বেশি সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।
সীমান্তবর্তী এলাকায় হোক বা দেশের যেকোনো জায়গায় সচেতনতাই পারে এই মরণব্যাধি থেকে রক্ষা করতে। এইচআইভি আক্রান্ত ব্যক্তির শরীরে ফোঁটানো সুঁচ অন্যের শরীরে প্রবেশ করলে বা রক্তদানের মাধ্যমে এ রোগ ছড়িয়ে পড়ে। ইনজেকশন, যৌনকর্মী, মাদকসেবীদের মধ্যে বিস্তার বেশি হলেও গত পাঁচ বছরে গৃহবধূ ও গর্ভধারিণী নারীদের মধ্যেও এইচআইভি আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বেড়েছে। ফলে এই ভয়াবহতা রুখতে হলে দৈহিক মিলনের ব্যাপারে সচেতন হতে হবে। কারণ বাংলাদেশে এইচআইভি ছড়ায় বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পুরুষ ও নারীর মধ্যে শারীরিক সম্পর্কের মধ্য দিয়ে। নারী-পুরুষ যৌনকর্মী ছাড়াও বিবাহিত দম্পতিদের মাধ্যমেও এ রোগের বিস্তার ঘটছে। তাই বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার পূর্বে বা দৈহিক মিলনের পূর্বে রক্ত পরীক্ষা করা বাঞ্ছনীয়। এছাড়া গর্ভধারণের পূর্বে নারীদের শরীরের রক্ত পরীক্ষা করতে হবে। যদি নারীর শরীরে এইচআইভি পজিটিভ থাকে তবে ওষুধ সেবনের মাধ্যমে সন্তানকে এই ভয়াবহতা থেকে রক্ষা করা যেতে পারে।
চিকিৎসকরা বলছেন, মা-বাবার কাছ থেকে জন্মগতভাবে শিশুরা এইচআইভি সংক্রমিত হতে পারে। কিন্তু এইচআইভি পজিটিভ হলেই তা এইডস নয়। সঠিক সময়ে সঠিক চিকিৎসার মাধ্যমে তাদের সুস্থ রাখা সম্ভব। কিন্তু অসচেতনতার কারণে কোমলমতি অনেক শিশু এগিয়ে যায় এইডস এর দিকে। বিশেষজ্ঞদের মতে, অর্থনৈতিক অসচ্ছলতা, অজ্ঞতা, সঠিক ও প্রয়োজনীয় চিকিৎসার অভাব, সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি, আত্মীয়স্বজনের অবহেলা এবং অযত্নের কারণে শিশুরা মরণব্যাধি এইডসের ঝুঁকির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।
বাসস্থান, চিকিৎসা আর শিক্ষার সুযোগও তারা পায় না। তাদের অপরাধ একটাই, তারা এইচআইভি পজিটিভ। অনেকের ধারণা তারা এইডস আক্রান্ত শিশু। রোগটি ছোঁয়াচে; এই ভ্রান্ত ধারণা থেকে তাদের একঘরে করে রাখে প্রতিবেশীরা। সংক্রমণের অমূলক আশঙ্কায় সাহায্য-সহযোগিতায় জন্য পাশেও দাঁড়ান না কেউ।
গত এক বছরে খুমেক হাসপাতাল (এআরটি) সেন্টার থেকে খুলনাসহ ১০ জেলায় ৬৫ জনের এইচআইভি পজিটিভ শনাক্ত হয়। এরমধ্যে শিশু রয়েছে তিনটি। এদের দুজনই খুলনার ও অপরজন যশোর জেলার। এই সময়ে পুরুষ ও নারীসহ ১৮ জনের মৃত্যু হয়েছে। মারা যাওয়াদের মধ্যে একটি শিশুও রয়েছে। সে খুলনার বাসিন্দা।
খুমেক হাসপাতালের দ্বিতীয় তলার ২২১ নম্বর রুমে এআরটি (অ্যান্টি রেক্ট্রোভাইরাল থেরাপি) সেন্টারের এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, গত এক বছরে (২০২১ সালের ২১ নভেম্বর থেকে ২০২২ সালের ২২ অক্টোবর পর্যন্ত) ৯২৩ জনকে এইচআইভি পরীক্ষা করে নতুন করে তিন শিশুসহ ৬৫ জনের শরীরে এইচআইভি শনাক্ত করা হয়। এরমধ্যে পুরুষ ৩৩ জন, নারী ২৯ জন ও শিশু রয়েছে তিনটি। শিশুর মধ্যে কন্যাশিশু রয়েছে দুটি ও ছেলেশিশু একজন। একই সময়ে মারা গেছে ১৮ জন। এরমধ্যে পুরুষ ১০ জন, নারী সাত জন ও ছেলেশিশু একটি। এবছর ৬৫ জন শনাক্তের মধ্যে খুলনা, নড়াইল, সাতক্ষীরা, যশোর, বাগেরহাট, পিরোজপুর, মাগুরা, ঝালকাঠি, চাঁদপুর ও বরিশালের বাসিন্দারা রয়েছে।
ফলে সীমান্তবর্তী এসব জেলায় নারীদের বিশেষভাবে সচেতন হতে হবে। ঝুঁকি মুক্ত রাখতে লজ্জা, সংকোচ পরিত্যাগ করতে হবে। বাংলাদেশে এইডস নির্মূলে কাজ করে ইউনিসেফ। এই কর্মসূচিতে সিলেট, ঢাকা, চট্টগ্রাম ও খুলনায় বেশি মনোযোগ দেওয়া হয়, কারণ এ জায়গাগুলোতেই এইডস আক্রান্তের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি । ইউনিসেফের কার্যক্রম বাড়াতে হবে। নারী-পুরুষ উভয়কেই সচেতন করে তুলতে হবে। এ লক্ষে সভা, সেমিনার, গ্রাম বৈঠক করতে হবে। এইচআইভি পরীক্ষা, চিকিৎসা এবং প্রতিরোধমূলক সেবা গ্রহণ করতে হবে। এসব গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় প্রচারণা চালানোর পাশাপাশি তথ্য-উপাত্ত এবং নমুনা সংগ্রহ করে সঠিক উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে একটি সুস্থ পৃথিবী উপহার দিতে সচেতনতাই পারে এসব ভয়াবহ মরণব্যাধি থেকে মুক্তি দিতে।