প্রখ্যাত অভিনেতা হুমায়ুন ফরীদির জন্মদিন আজ
বাংলা টেলিভিশন জগতের কিংবদন্তি অভিনেতা হুমায়ুন ফরীদি। যিনি দীর্ঘ তিন দশক দর্শকদের উপহার দিয়েছেন বহু জনপ্রিয় নাটক, চলচ্চিত্র। তাঁর পুরো ক্যারিয়ার সাজানো ছিল বর্ণিল কাজের মাধ্যমে। তাঁর অভিনয়শৈলীতে বারংবার মুগ্ধ হয়েছেন দর্শকরা। আজ এই গুণী অভিনেতার ৬৯ তম জন্মদিন।
১৯৫২ সালের এই দিনে ঢাকা শহরের নারিন্দায় জন্ম গ্রহণ করেন হুমায়ুন ফরীদি। জন্ম ঢাকায় হলেও বাবার চাকরির সুবাদে শৈশব-কৈশোরের বেশিরভাগ সময়ই কাটিয়েছেন ঢাকার বাইরে। তিনি ১৯৭০ সালে চাঁদপুর সরকারি কলেজ থেকে এইচএসসি সম্পন্ন করেন। এরপর অর্থনীতি বিভাগে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক সম্পন্ন করেন।
তিনি ছিলেন তুখোড় মেধাবী। প্রথম স্থান অধিকার করে স্নাতক সম্পন্ন করেন তিনি৷ তবে ছোটবেলা থেকেই অভিনয়ের প্রতি ছিল তাঁর বিশেষ টান। তাইতো মাত্র ১২ বছর বয়সে অভিনয়ের হাতেখড়ি নেয়া শুরু করেন তিনি। তখন ১৯৬৪ সাল। কিশোরগঞ্জের মহল্লার নাটক ‘এক কন্যার জনক’-এ প্রথম অভিনয়ে করেন তিনি।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা চলাকালীন সময় নাট্যজন সেলিম আল দীনের সঙ্গে বেশ ভালো ঘনিষ্ঠতা তৈরি হয় তাঁর। এরপর ১৯৭৬ সালে সেলিম আল দীনের উদ্যোগে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে শুরু হওয়া নাট্যোৎসবে যোগ দেন তিনি। সে উৎসবে থাকে তাঁর নিজের রচনা এবং নির্দেশনা দেয়া ‘আত্মস্থ ও হিরন্ময়ীদের বৃত্তান্ত’ নামে একটি নাটক। যা তখন সেরা হিসেবে বিবেচিত হয়েছিল।
এরপর হুমায়ুন ফরীদি যোগ দেন ঢাকা থিয়েটারে। খুব কম সময়ের মধ্যে এখানে জনপ্রিয়তা লাভ করেন তিনি। ফণীমনসা, শকুন্তলা, কীত্তনখোলার মতো নাটকগুলোতে দুর্দান্ত অভিনয় করে অভিনয় জগতে তার নাম পাকাপোক্ত করার বেশ অভূতপূর্ব প্রমাণ দেন তিনি।
এ তো গেলো মঞ্চের পাঠ। এরপর টেলিভিশনের পর্দায় হুমায়ুন ফরীদির প্রথম দেখা মেলে আতিকুল ইসলাম চৌধুরীর ‘নিখোঁজ সংবাদ’ নাটক দিয়ে। এরপর ধীরে ধীরে সাত আসমানের সিঁড়ি, একদিন হঠাৎ, চাঁনমিয়ার নেগেটিভ পজেটিভ, অযাত্রা, পাথর সময়, দুই ভাই, শীতের পাখি, সংশপ্তক, কোথাও কেউ নেই, নীল আকাশের সন্ধানে, দূরবীন দিয়ে দেখুন, ভাঙনের শব্দ শুনি, বকুলপুর কতদূর, মহুয়ার মন, সমুদ্রে গাঙচিল, এমন বহু জনপ্রিয় নাটক দর্শকদের উপহার দেন।
তবে ১৯৮৩ সালে সেলিম আল দীনের রচনায় ‘ভাঙনের শব্দ শুনি’ নাটকে সেরাজ তালুকদারের চরিত্রে অভিনয় করে দেশব্যাপী ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেন তিনি। এরপর আর কখনো পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তাঁর। নব্বইয়ের দশকে এসে নাটকের পাশাপাশি নাম লেখান রূপালী পর্দায়ও। বাংলাদেশের টেলিভিশন জগতের সবথেকে জনপ্রিয় খলনায়কের খেতাব দেয়া যায় তাকে।
সন্ত্রাস, ভণ্ড, ব্যাচেলর, জয়যাত্রা, শ্যামলছায়া, একাত্তরের যীশু, বিশ্বপ্রেমিকসহ বেশ অনেকগুলো জনপ্রিয় চলচ্চিত্র দর্শকদের উপহার দিয়ে পৌঁছান সফলতার উচ্চশিখরে। তাঁর ঝুলিতে আছে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারসহ বহু সম্মাননা। ২০০৪ সালে মাতৃত্ব’ চলচ্চিত্রে অভিনয়ের জন্য সেরা অভিনেতা শাখায় জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার তিনি।
তিনি প্রথমবার বিয়ে করেন মিনু নামের ফরিদপুরের এক মেয়েকে। সেখানে তাঁর দেবযানী নামের একজন কন্যাসন্তানও রয়েছে। তবে প্রথম সংসারে ভাঙন ধরার পর তিনি দ্বিতীয়বার বিয়ে করেন বাংলা টেলিভিশন জগতের প্রখ্যাত অভিনেত্রী সুবর্ণা মুস্তাফাকে। ২০০৮ সালে অবশ্য তাঁদের মধ্যেও বিচ্ছেদ হয়ে যায়। এরপর বাকি জীবনটা একাই কাটান তিনি।
২০১২ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি মাত্র ৬০ বছর বয়সে সকল ভক্তদের কাঁদিয়ে না ফেরার দেশে পাড়ি জমান গুণী এই অভিনয়শিল্পী। এরপর আর তাঁর মুখ থেকে শোনা যায়নি নতুন কোন সংলাপ। সকলের আক্ষেপ, বেশ অনেক আগেই ঝড়ে গেলো বাংলা টেলিভিশন জগতের উজ্জ্বল এক নক্ষত্র। তবে তাঁর ছোট্ট এই জীবনকালে তিনি তাঁর সুনিপুণ অভিনয় দিয়ে বাঙালি জাতির মনে যে দাগ তৈরি করে রেখে গেছেন, তা তাঁকে বাঁচিয়ে রাখবে যুগের পর যুগ।